বাংলাদেশে ঘরোয়া লিগে প্রায়শ টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি সময়ে হুট করে বদলে ফেলা হয় বাইলজ, সেটা নিয়ে হইচই পড়ে যায় চারদিকে। এই ব্যাপারটিকেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে ফেলেছে, হুট করেই বদলে গেছে সুপার ফোরের ফিক্সচার। সেই ফিক্সচার অনুসারে, আজকের বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচে যারাই জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হোক না কেন, তাতে দৃশ্যত কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না কোনো দলেরই। কারা কার বিপক্ষে খেলবে, কোথায় খেলবে, কখন খেলবে- গ্রুপপর্বের থোড়াই কেয়ার করে এসিসি ইতোমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছে এই সব প্রশ্নের উত্তরই। এতে চটে গেছেন মোটামুটি সবাই, প্রকাশ্যে অসন্তোষ দেখিয়েছেন পাকিস্তানের দলাধিপতি সরফরাজ আহমেদ এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তাতে এসিসি’র কোনো পরোয়া নেই; উপরন্তু আজকের এই ম্যাচ যেখানে হতে পারতো গ্রুপপর্বের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ম্যাচগুলোর একটি, সেখানে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণী এই ম্যাচটা যেন হুট করেই ‘কৌতুক’ হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সুপার ফোরে যদি অবস্থান নির্ধারণী ম্যাচের কোনো প্রভাবই না থাকে, তবে এই গ্রুপপর্ব নামের প্রহসন কেন? ফলে, স্বাভাবিকভাবেই দুই দলেই এ ম্যাচে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে।
সম্মুখযুদ্ধ
আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের ওয়ানডে ফরম্যাটে শেষবার দেখা হয়েছিলো ২০১৪ সালের এশিয়া কাপে, যাতে বাংলাদেশকে ৩২ রানে হারিয়েছিলো আফগানরা। এরপর দুটো দলই লম্বা একটা সময় ধরে বিবর্তিত হয়েছে নতুন রূপে, হয়ে উঠেছে আরো পরিণত। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে পুরস্কারস্বরূপ আফগানরা পেয়েছে টেস্ট স্ট্যাটাস, অন্যদিকে বাংলাদেশও ২০১৪ সালের বিভীষিকা পেছনে ফেলে মাশরাফির যোগ্যতম নেতৃত্বে আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় এশিয়া কাপের শুরুটাও দুর্দান্ত করেছে দুই দলই, একপেশে ক্রিকেটে শ্রীলংকাকে একরকম উড়িয়ে দিয়েই এ ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে দুই দল।
এর আগে ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের দেখা হয়েছে পাঁচবার, যাতে বাংলাদেশের বিপক্ষে তিনটি পরাজয়ের বিপরীতে আফগানিস্তানের জয় দুইটি। এশিয়া কাপে একবারের মোকাবেলায় জয়ের হাসিটাও হেসেছিলো তারাই। পরিসংখ্যানের দিক থেকে কোনো দলই পরিষ্কার ব্যবধানে পিছিয়ে নেই, তবে সামগ্রিক বিচার একটা দিক থেকে হয়তো কিছুটা এগিয়েই থাকবে আফগানরা। অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা টি-টোয়েন্টি সিরিজে রীতিমতো পর্যুদস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ফরম্যাট বদলালেও ‘লেগস্পিন-জুজু’ যে তাদের বেশ ভোগাতে পারে এই ফরম্যাটেও, সেটা খুব ভালোভাবেই জানে দুই দলই। অন্যদিকে ব্যাটিং সামর্থ্যের দিক থেকে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ, যদিও ধারাবাহিকতার তীব্র অভাব বরাবরের মতোই বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের কপালে ভাঁজ ফেলছে।
এসিসি’র অদ্ভুতুড়ে ফিক্সচার-কেলেঙ্কারিতে শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচের তেমন গুরুত্ব না থাকায় দুই দলেই আসতে চলেছে একঝাঁক পরিবর্তন। আফগানিস্তানের জন্য যেখানে পরিবর্তনগুলো নিতান্তই ঐচ্ছিক, সেখানে বাংলাদেশের জন্য সামনে এছাড়া আর পথ খোলা নেই।
শ্রীলংকার বিপক্ষে ঘটনাবহুল ম্যাচে সুরাঙ্গা লাকমলের বল খেলতে গিয়ে তামিম ইকবাল ইনজুরিতে পড়ে এশিয়া কাপ থেকেই ছিটকে পড়েছেন, অন্যদিকে গত ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিমও ভুগছেন ইনজুরিতে। ১৪৪ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলার পথে বারবারই ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে দেখা গেছে মুশফিককে, পাঁজরের ভাঙা হাড় নিয়ে ঝড় তুলতে দেখা গিয়েছে। স্বভাবতই বদল আসছে এই দুই জায়গাতে। মুস্তাফিজুর রহমান জাতীয় দলে আসার পর অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন দলে, পারফরম্যান্স বরাবরই কথা বলেছে তার পক্ষেই। তবে দুর্বল শারীরিক কাঠামোর কারণে মুস্তাফিজকে ব্যবহারে বাংলাদেশকে হতে হয়েছে অতিরিক্ত সাবধানী, এমনকি বিদেশী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অনেকটাই ‘গুরুত্বহীন’ এই ম্যাচে বিশ্রাম পেতে পারেন মুস্তাফিজও। তবে সেই ‘বিশ্রাম’-এর সুযোগটা হয়তো মিলছে না সাকিব আল হাসান কিংবা অধিনায়ক মাশরাফির।
টুর্নামেন্টের শুরুতে বিসিসিআই কর্তৃক বিরাট কোহলির পরিবর্তে রোহিত শর্মার নেতৃত্বে স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়। কোহলির না থাকার কারণ হিসেবে এমএসকে প্রসাদ বলেন,
“কোহলির ওয়ার্কলোডের কথা ভেবেই আমরা এই টুর্নামেন্টে তাকে বিশ্রাম দিতে চেয়েছি। বেশ কিছুদিন ধরে সে একটানা খেলেই চলেছে, সেই আইপিএলের পর থেকে আর নিস্তার পায়নি। আমাদের যেসব খেলোয়াড় তিন ফরম্যাটেই খেলছে, যথেষ্ট ফিট রাখতে ওদেরকে বিশ্রাম দিতেই হবে আমাদের।”
অন্যদিকে, একদম বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। হাতের ইনজুরি নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটা দুর্দান্ত খেলেছেন সাকিব আল হাসান, তিনিই বাংলাদেশের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। সফরশেষে সাকিব এশিয়া কাপ থেকে ছুটি চেয়ে হজ্ব করতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে অবকাশ যাপনের জন্য পরিবার নিয়ে লন্ডনে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল, একবারে অস্ত্রোপচার শেষে তবেই ফিরবেন। কিন্তু বিসিবি প্রেসিডেন্ট কোনোমতেই ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’কে হারাতে রাজি নন, তাই ডেকে পাঠালেন। এরপর নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন সাকিব, অস্ত্রোপচারের সময় পিছিয়ে দিয়ে চলে এলেন এশিয়া কাপে। গত ম্যাচে স্বরূপে ছিলেন না, হয়তো তারও বিশ্রাম বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ‘বিলাসিতা’টুকু আর করার সুযোগ পাচ্ছেন না সাকিব, এই ম্যাচেও তার খেলার সম্ভাবনাই বেশি।
তামিম ইকবালের অবশ্যম্ভাবী পরিবর্ত হিসেবে আজ অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক নাজমুল হোসেন শান্ত। মুশফিকুর রহিমের পরিবর্তে বহুদিন পর একাদশে চলে আসতে পারেন মুমিনুল হক, মুস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্রাম দিয়ে অভিষেক হতে পারে আবু হায়দার রনি’র। আজও একাদশের বাইরে থাকতে পারেন আরিফুল হক এবং নাজমুল ইসলাম অপু, তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলে সাকিব আল হাসানকে বিশ্রাম দেওয়া হলে দু’জনের যে কেউ ঢুকে যেতে পারেন একাদশে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানে এমন ইনজুরি সমস্যা নেই। তবে আফগান উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ শাহজাদকে সুপার ফোরে ঝরঝরে অবস্থায়ই পেতে চাইবে তারা, হয়তো এ কারণে আজ তাকে বিশ্রাম দিয়ে একাদশে নিয়ে আসা হতে পারে নতুন মুখ মুনির আহমেদ কাক্বর কিংবা অভিজ্ঞ সেনানী সামিউল্লাহ শেনওয়ারিকে। এছাড়া দুই সিমার আফতাব আলম এবং গুলবাদিন নাইবের পরিবর্তে সু্যোগ পেতে পারেন সাঈদ শিরজাদ এবং ওয়াফাদার। তবে উইনিং কম্বিনেশন না ভেঙে অপরিবর্তিত একাদশ খেলানোর সুযোগটা থেকেই যাচ্ছে আফগানিস্তানের।
প্রত্যাশা
গত ম্যাচে টপ অর্ডারের নিদারুণ ব্যর্থতায় এক রান তুলতেই দুই উইকেট হারিয়ে বসেছিলো বাংলাদেশ। শেষ অবধি মুশফিক-মিথুনের ব্যাটে পরিত্রাণ মিলেছিলো বটে, তবে তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে লিটন-শান্তদেরকে। গত ম্যাচের ব্যর্থতা কাটিয়ে সাকিব-রিয়াদের স্বরূপে ফেরার আশায় থাকবে বাংলাদেশের মিডল অর্ডার। বিশেষভাবে চোখ রাখতে হবে গত ম্যাচে দারুণ ফিফটি করার পর শিশুতোষ শটে ‘আত্মাহুতি’ দিয়ে আসা মোহাম্মদ মিঠুনের দিকেও। মাশরাফি ও রুবেলের সঙ্গে রনি কিংবা মুস্তাফিজ- পেসত্রয়ী বেশ শক্ত-সমর্থ বাংলাদেশের, সঙ্গে দারুণ স্মার্ট অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। তামিম-মুশফিককে হারানোর পরও সব মিলিয়ে দারুণ টিম কম্বিনেশন বাংলাদেশের। একইসাথে হয়তো হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ‘ড্রেস রিহার্সাল’টাও!
অন্যদিকে, গত ম্যাচে আফগানিস্থানের টপ অর্ডার দারুণ পারফর্ম করলেও অধিনায়ক আজগর আফগান এবং মোহাম্মদ নবীর উইলো সেভাবে কথা বলেনি। সুপার ফোরের আগে নিঃসন্দেহে আফগান শিবির চাইবে, এই দুই অভিজ্ঞ সেনানী যেন ছন্দে ফেরেন। নজর রাখতে হবে রহমত শাহ’র দিকে, এ বছর মাত্র ১৫ ইনিংস খেলেই ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন ৬৭২ রান। পঞ্চাশতম ওয়ানডে খেলার মাইলফলকের সামনে দাঁড়ানো এই ব্যাটসম্যান আছেন দারুণ ছন্দে। তবে আফগানিস্তান দলের সবচেয়ে শক্তির জায়গা খুব সম্ভবত তাদের স্পিন ডিপার্টমেন্ট। ‘বার্থডে বয়’ রশীদ খান এবং মুজিব-উর-রহমানের লেগ স্পিনের সঙ্গে অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবীর আঁটসাঁট অফস্পিন যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তোলার জন্য যথেষ্ট, সেটা গত টি-টোয়েন্টি সিরিজেই প্রমাণ করে দিয়েছে আফগানিস্তান। নিজের দিনে বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন মোহাম্মদ শেহজাদও, এ ম্যাচ খেললে একাই ম্যাচের মোমেন্টাম বদলে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন তিনিও।
দুই দলই এ ম্যাচে তারুণ্যের জয়গান গাইতে নামবে। হয়তো আরেকটি নখ-কামড়ানো উত্তেজনায় পরিপূর্ণ ম্যাচই দেখতে চলেছে বিশ্ব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই আবুধাবিতেই আফগানিস্তানের বোলিং দেখে মনে হয়নি শিশির খুব বড় কোনো প্রভাবক হতে চলেছে এই ম্যাচে। তবে দুই দলের শক্তিমত্তা বিচারে হয়তো দুই দলই টসে জিতে বোলিংটাই বেছে নিতে চাইবে।
সম্ভাব্য একাদশ
বাংলাদেশ:
লিটন দাস (উইকেটরক্ষক), নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক, সাকিব আল হাসান, মোহাম্মদ মিথুন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন, মেহেদী হাসান মিরাজ, মাশরাফি বিন মূর্তজা (অধিনায়ক), আবু হায়দার রনি, রুবেল হোসেন।
আফগানিস্তান :
মোহাম্মদ শেহজাদ (উইকেটরক্ষক), ইহসানউল্লাহ, রহমত শাহ, আজগর আফগান (অধিনায়ক), হাসমতউল্লাহ শাহিদী, মোহাম্মদ নবী, নাজিবুল্লাহ জাদরান, গুলবাদিন নাইব, রশীদ খান, আফতাব আলম, মুজিব-উর-রহমান।
Featured Image Credit: IndianExpress.com