রিয়াল মাদ্রিদ: সদ্য অধঃপতনের পেছনের কারণগুলো

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ভিক্তোরিয়া প্লজনের বিপক্ষের ম্যাচটি ছিলো বাঁচা-মরা লড়াইয়ের, কারণ এ ম্যাচের আগে টানা ৫ ম্যাচ জয় বঞ্চিত ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এমনকি ৫ ম্যাচের ভেতর ৪ ম্যাচেই কোনো গোল করতে পারেনি হুলেন লোপেতেগির শিষ্যরা। ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম রিয়াল মাদ্রিদ টানা ৪ ম্যাচে গোল করতে ব্যর্থ হয়। এমন পরিসংখ্যান কখনোই কাম্য নয় রিয়াল মাদ্রিদের মতো শীর্ষস্থানীয় ক্লাবের কাছে। কিন্তু টানা ৩ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ক্লাবের এমন অধঃপতনের কারণ কি? এই অনুসন্ধানেই আজকের এই আর্টিকেলের অবতারণা। 

একজন রোনালদোর শূন্যতা

রোনালদো পাড়ি জমিয়েছেন জুভেন্টাসে; Image Source: Sky Sports

একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দলে থাকা মানে কতটা স্বস্তিদায়ক, তা এতদিন বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে রিয়াল মাদ্রিদ। আর বর্তমানে তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সেই একই রোনালদোর না থাকায় কি অবস্থা তৈরি হতে পারে।

যে সেভিয়ার বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ৩-০ গোলে হেরেছে, গত মৌসুমে এই একই দলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন পর্তুগীজ সুপারস্টার। এ মৌসুমে আলাভেজের বিপক্ষে কোনো গোলই করতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ, অথচ গত মৌসুমে এই দলের বিপক্ষেও একাই ৩ গোল করেছিলেন রোনালদো। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষেও কোনো গোল পায়নি তারা, অথচ রোনালদোর যেন অন্যতম প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রায় প্রতি মৌসুমে ৩০+ গোল করতেন তিনি। আর এ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের কোনো খেলোয়াড় একাই ৩০ গোল করবেন, এমন ভাবাটাও আকাশ কুসুম কল্পনার মতোই। যদিও ক্লাব রোনালদোর পরিবর্তে কোনো নতুন খেলোয়াড় কেনার চেষ্টাও করেনি, তাই তাকে ছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে প্রতি ম্যাচেই।

সমস্যা যখন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ

ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ; Image Source: Real Madrid

হুলেন লোপেতেগি কোচ হয়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আসার পর তার প্রথম চাওয়া ছিল এমন একজন স্ট্রাইকার, যিনি প্রতি মৌসুমে অন্তত ৫০ গোলের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন। মাউরো ইকার্দি ও রবার্ট লেভান্ডফস্কি ছিলেন লোপেতেগির পছন্দসই খেলোয়াড়। কিন্তু পেরেজ একজন স্ট্রাইকার কেনার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেননি, ক্লাব অলিম্পিক লিঁও থেকে ২৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফিরিয়ে এনেছেন তাদের অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা খেলোয়াড় মারিয়ানো ডিয়াজকে।

আর অন্যসব দল-বদল বেশ হিসাব-নিকাশ করেই করা। অনেক গল্প সৃষ্টি করে অবশেষে থিবো কোর্তোয়াকে দলে ভিড়িয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। মার্সেলোর একমাত্র বিকল্প লেফট-ব্যাক থিয়ো হার্নান্দেজকে লোনে পাঠিয়ে কিনেছে কার্ভাহালের বিকল্প রাইট-ব্যাক অড্রিয়োজোলাকে। অথচ নাচোর মতো ডিফেন্ডার দলে ছিল, যিনি একাধারে রাইটব্যাক ও সেন্ট্রালব্যাক ডিফেন্ডার হয়ে খেলতে পারেন।

“ডিয়ারিও এএস” এর মতে, ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এখনও নেইমারকে ভুলতে পারেননি। এখনও তিনি নেইমারকে দলে আনার স্বপ্ন দেখেন। একজন ভালো স্ট্রাইকারের পিছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ না খরচ করা এবং রোনালদোর মতো খেলোয়াড় চলে যাবার পরও তার শূন্যস্থান পূরণ না করার মতো ঘটনা তারই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু নেইমার যদি রিয়াল মাদ্রিদে আসেনও, তা অনেক পরের কথা। ভবিষ্যৎ ভালো করার চিন্তা করার জন্য যে বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ যে তাদের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার বোঝাটা নেবে কে?

লোপেতেগির ট্যাকটিক্স

রীতিমতো ধরাশায়ী হয়েছে লোপেতেগি’র টেকনিক; Image Credit: Associated Press

টানা ৩ মৌসুম জিনেদিন জিদানের ট্যাকটিক্সে খেলে এসেছে রিয়াল মাদ্রিদ। জিদানের ট্যাকটিক্স মানেই আক্রমণাত্মক ফুটবল, যে স্টাইলে খেলতে আগে থেকেই অভ্যস্ত রিয়াল মাদ্রিদ। আসলে রোনালদো থেকে বেল বা মদ্রিচের মতো খেলোয়াড়ের সাথে এ ধরণের ফুটবলই বেশি মানায়।

রোনালদোর বিদায়ের পাশাপাশি জিদানও কোচের দায়িত্ব থেকে বিদায় নিলে রিয়াল মাদ্রিদের নতুন কোচ হিসেবে আসেন হুলেন লোপেতেগি। লোপেতেগি হলেন স্প্যানিশদের বিখ্যাত টিকিটাকায় পারদর্শী। তার ফুটবল দর্শন অনুসারে, বল দখলে এগিয়ে থাকা আর পাসিং ফুটবল খেলাটাই মুখ্য। ফলে এক পলকে বদলে গেলো রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণাত্মক ফুটবলের ধারা। বেল-আসেনসিও বা সার্জিও রামোস-মার্সেলোর মতো অ্যাটাকিং ডিফেন্ডারদের দিয়ে যে এমন ফুটবল মানায় না, তারই প্রমাণ হাতেনাতে পেলেন লোপেতেগি।

যদিও এমন বিরূপ ফলাফলের জন্য সম্পূর্ণ কোচকে দোষারোপ করাটাও ঠিক হবে না। দীর্ঘদিন অ্যাটাকিং ফুটবলের সাথে অভ্যস্ত থাকা দলকে মুহূর্তেই পাসিং ফুটবলে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। উপরন্তু, বেনজেমার ফর্মহীনতা এবং বেলের ইনজুরির কারণে দলে গোল করার মতো খেলোয়াড়েরও এই মুহূর্তে বড্ড অভাব। তবুও লোপেতেগি নতুন কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারেননি। তাই লোপেতেগিসহ দলকে এভাবে হতাশার বৃত্তে ঘুরতে হচ্ছিলো।

রক্ষণ দুর্বলতা

ক্লাবটির রক্ষণ দুর্বলতার অন্যতম কারণ সার্জিও রামোস ও মার্সেলোর অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক মনোভাব;
Image Credit: ChinaFotoPress/ChinaFotoPress/Getty Images

টানা ৪ ম্যাচ গোল করতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ। এমন ব্যর্থতার কাহিনী ১৯৮৫ এর পর এই প্রথম। গোল দিতে না পারলেও তারা সেভিয়ার কাছে হজম করেছে ৩ গোল, সিএসকেএ মস্কো আর আলাভেজ রিয়াল মাদ্রিদের জালে বল জড়িয়েছে ১ বার করে। ৪ ম্যাচে ৫ গোল হজম করার পেছনে দোষী কে? অবশ্যই রিয়াল মাদ্রিদ রক্ষণ।

রোনালদোর বিদায়ের পর এখন নিয়মিত ক্লাবের দলনেতার দায়িত্ব পালন করছেন সার্জিও রামোস। সময়ের সেরা ডিফেন্ডার সার্জিও রামোস রিয়াল মাদ্রিদের এই ভরাডুবির পেছনের অন্যতম মুখ। তারই ভুলের কারণে শেষ মুহূর্তে আলাভেজের কাছে গোল হজম করে হারতে হয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদকে। অন্য সেন্ট্রালব্যাক ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানকে নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। মস্কোর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে তার করা শিশুতোষ ভুলে প্রথম গোল পেয়েছিলো রাশিয়ান ক্লাবটি। পরবর্তীতে আক্রমণভাগের ব্যর্থতার কারণে ম্যাচে ফিরতে পারেনি লোপেতেগির শিষ্যরা।

ক্লাবটির রক্ষণ দুর্বলতার অন্যতম কারণ সার্জিও রামোস ও মার্সেলোর অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক মনোভাব। কার্ভাহালও ইনজুরির কারণে নিয়মিত মাঠে নামতে পারছেন না। রিয়াল মাদ্রিদও আর আগের রূপে নেই। তাই একজন সেন্ট্রালব্যাক ও দলে নতুন আসা রাইটব্যাকের পক্ষে পুরো রক্ষণের ভার নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।

খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব

নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন লুকা মদরিচ; Image Source: Soccrates Images

রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে তারা টানা খেলেছেন। বিশ্বকাপেও খেলেছেন প্রতিটা ম্যাচে। এমনকি বিশ্বকাপের পর ক্লাব ফুটবলেও কোনো বিশ্রাম ছাড়াই প্রতিটা ম্যাচ খেলে যাচ্ছেন রাফায়েল ভারান ও লুকা মদ্রিচ। রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ বলেই প্রবল ক্লান্তিবোধ কিছুটা হলেও চেপে ধরেছে তাদের, তাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক খেলাটা মাঠে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বকাপের পর থেকে প্রবল ফর্মহীনতায় ভুগছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই খেলোয়াড়। একই কথা ক্যাসেমিরোর জন্যও প্রযোজ্য, তারও পর্যাপ্ত বিশ্রামের ভীষণ প্রয়োজন।

বার্সেলোনায় ইভান রাকিটিচও ধুঁকছেন ফর্মের সাথে। তারও বিশ্বকাপ-পরবর্তী দীর্ঘ বিশ্রামের অভাব রয়েছে। কিন্তু আর্থুর মেলো বা আর্তুরো ভিদালের মতো বিকল্প খেলোয়াড় থাকায় রাকিটিচের মাঝেমধ্যে বাজে খেলাটা তেমন একটা নজরে আসছে না। কারণ বার্সা কোচ প্রায়ই দ্বিতীয়ার্ধের পর তুলে নিচ্ছেন তাকে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদে মদ্রিচ ও ভারানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দলের সাফল্য আনতে এই দুই খেলোয়াড়ের প্রয়োজনীয়তাও অনেক। তাই খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব দলের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এভাবেই চলতে থাকলে দলের উপর দীর্ঘকালীন ফর্মহীনতার একটা ছাপ পড়ে যাবে, যেখান থেকে ফেরত আসা কঠিন। আর এমনও তো নয় যে, কোনো এক জিনেদিন জিদান আবারও উদ্ধার করবেন রিয়াল মাদ্রিদকে। ‘এল ক্লাসিকো’র বিভীষিকাময় ম্যাচটির পর ছাঁটাই হয়েছেন হুলেন লোপেতেগি, সান্তিয়াগো বার্নাব্যু’তে তার বদলে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হয়ে এসেছেন সান্তিয়াগো সোলারি। এবার দেখার বিষয়, দলের এই ক্রান্তিকালে তিনি দলের হাল কতটুকু শক্ত করে ধরতে পারেন। তবে আসন্ন শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে যে বেশ খরুচে হতেই হবে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই।

This article is in Bangla Language. It is an analysis why Real Madrid is underperforming in this season.

Feature Image: Denis Doyle/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version