কোয়ারেন্টিন – পৃথিবীর জন্য এই শব্দটি একদমই নতুন। কিন্তু এখন এই শব্দটাই বহুল ব্যবহৃত, বলা উচিৎ – বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সবাই এই শব্দটায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর অর্থ হলো, স্বেচ্ছায় নিজেকে সকল সামাজিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।
এই ‘কোয়ারেন্টিন’ এখন বহু অজানা আতঙ্কের অপর নাম। করোনা ভাইরাসে মৃতে সংখ্যা প্রতিদিনই যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, ততই যেন দৈনন্দিন জীবনের সাথে আরো বেশি করে মিশে যাচ্ছে এই শব্দটি। বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনের তিনজনও আছেন হোম কোয়ারেন্টিনে। তারা হলেন টেস্ট ওপেনার সাদমান ইসলাম, যুব দলের পেসার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডাক্তার দেবাশীষ চৌধুরী।
ছয় টেস্ট খেলা সাদমানের ইনজুরি ছিল কবজিতে, আর মৃত্যুঞ্জয়ের ইনজুরি ছিল কাঁধে। দু’জনই অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন অস্ত্রোপচারের জন্য। গত নয় মার্চ তারা দেশ ছাড়েন। দেশে ফিরে আসেন ১৭ মার্চ, মঙ্গলবার। তাদের সফরসঙ্গী ছিলেন ডাক্তার দেবাশীষ। দু’জনের অস্ত্রোপচারই সফল হয়েছে। আর দেশে ফেরামাত্রই তিনজনকেই নিয়মমাফিক সেলফ কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তো কেমন আছেন তারা কোয়ারেন্টিন জীবনে? সাদমান জানালেন, এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাকে আগে কখনোই হতে হয়নি। শান্তিনগরে নিজের বাসায় মুঠোফোনে বললেন,
‘আসলে, এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কখনোই হতে হয়নি আমাকে। এটা খুবই বিরক্তিকর। সময় কোনোভাবেই কাটছে না। শুরুতে মনে হয়েছিল, দেখতে দেখতে ১৪ দিন কেটে যাবে। এখন মনে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা এক জায়গাতে থেমে আছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের দু’টি ম্যাচ খেলে আসা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আছেন মোহাম্মদপুরের বাসায়। তিনি বলেন,
‘বাসাতেই আছি, বের হতে পারছি না একদমই। একেবারে যে একটা ঘরের ভেতরে আছি, তা না। সেটা আমার দ্বারা সম্ভবও না। আমার সার্জারি হয়েছে। ফলে, জামাকাপড় খোলা থেকে অনেক রকম সাপোর্টের দরকার হয়, যেটা ফ্যামিলির সাপোর্ট ছাড়া সম্ভব না।’
মৃত্যুঞ্জয় মনে করেন, ক্রিকেটারদের জীবনে এই একাকীত্ব আসতেই পারে। বললেন,
‘আমি বলবো, কোনো একাকিত্ব বোধ হয় না। ক্রিকেটারদের জীবনটা তো এরকমই। অনেক রকম ক্যাম্প করতে করতে একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তার ওপর আমার সার্জারি হয়েছে। দুই সপ্তাহ বিশ্রামেই থাকতে হবে। এমনিতেও বাইরে কোথাও যেতে পারতাম না। তাই আমি বলবো, আমার জন্য বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
এই অবসর সময় কাটাচ্ছেন কীভাবে? সাদমান বলেন,
‘এভাবে তো আসলে সময় কাটানো খুব কঠিন। সিনেমা দেখি কখনো কখনো। গান শুনি, টেলিভিশন দেখি। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ!’
অন্যদিকে, অবসরে মৃত্যুঞ্জয় বেশি পছন্দ করেন বই পড়তে। সেই প্রিয় কাজটাই অবসর জীবনে তার প্রধান সঙ্গী। বললেন,
‘আমি বই পড়তে পছন্দ করি খুব। তাই বই পড়েই সময় কাটাচ্ছি। সারাদিনই বই পড়া হয়। ইন্টারনেটে ঢুকলে আগেকার ক্রিকেট ভিডিওগুলো দেখি। এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে। তবে অবসরে বেশিরভাগ সময়ই আমার বই পড়েই কাটে।’
বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরৗ এমনিতে খুব ব্যস্ত জীবন কাটান। কিন্তু, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে তার হাতে এখন অনেক সময়। এই জীবনে মানিয়ে নেওয়াকে কঠিন বলেই মন্তব্য করলেন তিনি। বললেন,
‘আমাদের সবারই প্রতিদিনকার একটা রুটিন থাকে। সেটা থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। অবশ্যই খুব কঠিন ছিল আমাদের জন্য। নতুন একটা ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে হয়েছে আমাদের। তবে, এটাকে একটা অ্যাডভান্টেজ হিসেবে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
এই অবসর সময়ে নিজের জন্য জরুরী পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকছেন ডাক্তার দেবাশীষ। বললেন,
‘এই সময়টা কাজে লাগানোই ভালো। আমাদের যাদের লেখাপড়া করতে হয়, তারা এখন তো আর খুব একটা পড়ার সময় পাই না। তাই আমি নিজের জন্য বলবো, লেখাপড়ার জন্য বাড়তি সময় পাওয়া গেছে। আমি কিছু অনলাইন কোর্স করছি, নিজের কিছু শর্ট কামিংসকে ঠিক করার চেষ্টা করছি। আমার সাবজেক্টে আমার যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। আমি তো আসলে সময় পাই না খুব বেশি। এখন তো অজস্র সময়। সেটাকেই কাজে লাগাচ্ছি।’
তিনি জানালেন, কোয়ারেন্টিনে থাকাটা ক্রিকেটারদের ইনজুরির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। দুই ক্রিকেটারের ইনজুরির যা অবস্থা, তাতে নিজের কাজ তারা নিজেরাই করতে পারবেন। বললেন,
‘ওরা বাড়িতে থাকে, সেলফ-কোয়ারেন্টিনে থাকবে। ওদের তো নিজের কাজ করতে কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে না। এক হাতে সার্জারি আছে, আরেকটা হাত ফ্রি-ই আছে। অস্ট্রেলিয়ায় সার্জারির পর যে ক’টা দিন ছিলাম, খাওয়া-দাওয়া, জামাকাপড় পরা কোনোটাতেই কোনোরকম সমস্যা হয়নি।’
কোয়ারেন্টিন জীবনটা কারো জন্যই খুব বেশি সুখকর হচ্ছে না। কিন্তু, ডাক্তার দেবাশীষ মনে করেন, নিজেদের সুরক্ষার জন্য এটা মেনে চলা তাদের জন্য জরুরী। বললেন,
‘বিষয়টা ওদের (সাদমান ও মৃত্যুঞ্জয়) দু’জনকেই বোঝানো হয়েছে। বাদ বাকিটা তো পুরোটাই ওদের নিজের সচেতনতার ওপর নির্ভর করবে। ওরা বড় হয়েছে, পরিপক্ক হয়েছে। ওরা সবই বুঝে। আশা করি, ওদের যা যা বোঝানো হয়েছে, তার সবকিছুই ওরা মেনে চলছে।’
বিশ্বজুড়েই করোনা ভাইরাস এখন একটা মহামারী। চীনের উহান থেকে শুরু করে এই কোভিড ১৯ এখন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপে। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থায়ও খুব সুবিধাজনক নয়। ১৫০০’র ওপর মানুষ দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
সেই দেশ থেকে মাত্রই ফেরা মৃত্যুঞ্জয়রা জানালেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। মৃত্যুঞ্জয় বলেন,
‘আমি মেলবোর্নে ছিলাম। অল্প কয়েকটা দিনের জন্য সিডনিতে গিয়েছিলাম। মেলবোর্নে কোনো সমস্যা নেই। সব কিছু স্বাভাবিক। কিন্তু, সিডনিতে গিয়ে শুনলাম ওখানকার অবস্থা নাকি মারাত্মক। আমি আমার এক আঙ্কেলের বাসায় গিয়েছিলাম, উনি বললো, সবাই নাকি বাসায় বসে অফিস করছে। এরপর আমি দেশে আসার পর শুনলাম, অবস্থা নাকি আরো খারাপ। ওদের একটা সুবিধা কী, দেশটা অনেক বড়। ফলে, এক অঞ্চলে প্রকোপ দেখা গেলেও আরেক জায়গায় সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, যতটুকু দেখে আসছি, অবস্থা খুব ভাল মনে হয়নি।’
ডাক্তার দেবাশীষ বলেন,
‘আমরা যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরছিলাম, তখন পর্যন্ত অবস্থা ততটা খারাপ ছিল না। ওরা তখন পরিকল্পনা করছিল, কীভাবে কী করবে সেসব নিয়ে কাজ করছিল। আমরা আসার ঠিক আগের দিন ভিক্টোরিয়া রাজ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। তবে, সাধারণ মানুষের চলাফেরায় কোনো রকম সমস্যা চোখে পড়েনি।’
থমকে গেছে ক্রীড়াঙ্গন। গোটা বিশ্বের প্রায় সবরকম খেলাধুলার আসর বন্ধ হয়ে গেছে করোনা ভাইরাসের কারণে। বাংলাদেশেও আছে এর প্রভাব। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগসহ দেশের সকল খেলাধুলার আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর, আয়ারল্যান্ড সফর – সব আপাতত স্থগিত।
বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট স্থগিত হয়ে যাওয়াকে ক্ষতিকর বলে মানছেন মৃত্যুঞ্জয়। বললেন,
‘ক্ষতি তো অবশ্যই। ক্রিকেট তো সব সময়ই একটা প্রসেসের মধ্যে থাকে। একটা পরিকল্পনা ধরে এগোয়। বছরের এই সময় এটা হবে, ওই সময় ওটা হবে – এমন একটা সূচি থাকে। এটা ধরেই সবাই এগোয়। ফলে, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সেটার ব্যাপারে আগে থেকেই একটা দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। এই দিক-নির্দেশনাটা আয়োজকদের জন্য যেমন জরুরী, তেমনি জরুরী ক্রিকেটারদের জন্যও। এই প্রক্রিয়াটা তো অবশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। পুরো শিডিউলটাই এখন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।’
তবে, পুরো বিশ্বের সুরক্ষার স্বার্থে এই পিছিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করছেন মৃত্যুঞ্জয়। বললেন,
‘পুরো পৃথিবীতেই তো এখন একই অবস্থা। শুধু আমরা কিন্তু না, সবাই এখানে পিছিয়ে যাবে। আর যে করোনা ভাইরাসকে গোটা বিশ্ব অনেক গুরুত্ব সহকারে দেখছে, সেটাকে আমাদেরও গুরুত্ব নিয়েই দেখা উচিৎ।’