প্যারাশুটের সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। এটি বড় ছাতার মতো গোল কিংবা একফালি চাঁদের মতো দেখতে একপ্রকার বিশেষ ধরনের কাপড় ও রশির সমন্বয়ে গঠিত। অতি উচ্চতা থেকে পতনের সময় প্যারাশুট গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিরাপদে অবতরণে সাহায্য করে। প্রতি বছর বিজয় দিবসের প্যারেডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ারবোর্ন ব্রিগেডের সেনাদের বিমান থেকে জাম্প করে প্যারেড গ্রাউন্ডে নেমে আসার দুঃসাহসিক যুদ্ধকৌশল আপনারা হয়তো দেখেছেন। সামরিক বাহিনীর প্যারাট্রুপার বা বিমানের পাইলট-ক্রুদের জন্য যে বস্তুটি জীবন বাঁচানোর মাধ্যম, সেটিকে একদল মানুষ খেলনা হিসেবে বানিয়ে নিয়েছে।
হ্যাঁ, বলছিলাম স্কাইডাইভারদের কথা। ভিডিওতে স্কাইডাইভিং বা প্যারাশুট জাম্প দেখতে সহজ মনে হলেও এটি আসলে বেশ বিপদজনক। ফিজিক্যাল ফিটনেসের পাশাপাশি প্রচুর সাহসের দরকার বিধায় এটি বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট হিসেবে বিবেচিত। এর কয়েকটি উপশাখা রয়েছে, যেমন- উঁচু স্থান থেকে প্যারাশুট নিয়ে দৌড়ে এসে বাতাসে ভেসে যাওয়া অথবা সমুদ্রসৈকতে স্পিডবোটে প্যারাশুট বেঁধে উড্ডয়ন (প্যারাসেইলিং), উঁচু ভবন বা পাহাড় থেকে সরাসরি জাম্প (বেজ জাম্প), এয়ারক্রাফট থেকে প্যারাশুট নিয়ে জাম্প (স্কাইডাইভ) , বিমানের ডানার মতো একপ্রকার বস্তু নিয়ে উড়ে চলা (উইংস্যুট জাম্প) ইত্যাদি। তবে যেভাবেই জাম্প করুক না কেন, উক্ত ব্যক্তির সাথে প্যারাশুট থাকবেই। কারণ অভিকর্ষের কারণে পড়ন্ত বস্তুর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৯.৮ মিটার করে বৃদ্ধি পায়। ফলে প্যারাশুট ছাড়া নিরাপদে ভূমিতে নেমে আসা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু লুক এইকিন্স নামের এই মার্কিন নাগরিক অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইলেন। ২০১৬ সালে তিনি প্যারাশুট বা উইংস্যুট ছাড়াই জাম্প করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেন। তা-ও আবার এক-দুই হাজার ফুট নয়, একেবারে পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে এই জাম্প দিয়েছিলেন তিনি!
কে এই ব্যক্তি?
লুক এইকিন্স ১৯৭৩ সালের ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্যারাশুট জাম্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি স্কাইডাইভ এবং ১৬ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো একাকী জাম্প করেন। এরপর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তিনি আঠারো হাজারের বেশিবার প্যারাশুট জাম্পের মতো দুঃসাহসী কাজটি সম্পন্ন করেছেন। পরবর্তীতে শখকে পেশায় রূপান্তরিত করেন। তিনি হেলিকপ্টার ও ছোট বিমান চালনার যোগ্যতাও অর্জন করেছেন। পেশাদার স্কাইডাইভার হিসেবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষদের নিয়ে জাম্প দিতেন। পরবর্তীতে United States Parachute Association এর প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। তার কাজ ছিল নবীন স্কাইডাইভারদের যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং তাদের দক্ষতা মূল্যায়ন করে লাইসেন্স দেয়া।
এছাড়া তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর এলিট কমান্ডো ফোর্স ‘নেভি সিল‘ বাহিনীর প্যারাজাম্প ইন্সট্রাক্টর হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন। এর বাইরে তিনি ফ্রিল্যান্সার এরিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিমান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর প্যারাশুট খোলার আগপর্যন্ত ফটোগ্রাফি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেটিও দক্ষতার সাথে করতে পারতেন লুক এইকিন্স। তার তোলা ছবি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ও পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। এসব কাজ করতে গিয়েই হলিউড সিনেমার স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি Ironman 3, Godzilla মুভিসহ একাধিক মুভিতে এরিয়াল ভিডিওগ্রাফার ও স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে পানীয় কোম্পানি ‘রেডবুল’ এর স্কাইডাইভার টিমে যোগ দেন। লুক তাদের আয়োজিত স্ট্র্যাটোজাম্প ক্যাম্পেইনে আরেক বিখ্যাত স্কাইডাইভার ফেলিক্স বমগার্টনারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। ঐ ব্যক্তির ১ লক্ষ ২৮ হাজার ফিট উচ্চতা থেকে জাম্প দেয়ার ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পড়ুন: ফেলিক্স বমগার্টনার: এক দুঃসাহসী স্কাইডাইভার।
সেই দুঃসাহসী জাম্প
২০১২ সালে ‘গ্যারি কনারি’ নামে এক স্কাইডাইভার প্যারাশুট ছাড়া প্রথম জাম্প করেন বটে। তবে তিনি উইংস্যুট ব্যবহার করেছিলেন যেন নির্ধারিত ল্যান্ডিং জোনের দিকে পাখির মতো ভেসে যেতে পারেন। লুক এইকিন্স এই রেকর্ড ভাঙতে প্যারাশুট কিংবা উইংস্যুট, কোনোটি ছাড়াই জাম্প করার সিদ্ধান্ত নেন! সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে প্যারাশুট ছাড়া পড়ে গিয়েও বেঁচে যাওয়ার রেকর্ডটি একজন সার্বিয়ান বিমানবালার। ১৯৭২ সালে তার বিমানে একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে তিনি ৩৩,৩৫০ ফুট উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
লুকের ইচ্ছা ছিল এই রেকর্ডও নিজের করে নেয়ার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে জাম্পের উচ্চতা ২৫ হাজার ফুট নির্ধারণ করেন। ১৮ মাসের প্রস্তুতি শেষে ২০১৬ সালের ৩০ জুন তিনি বিমানে ওঠেন। বিপদজনক এই জাম্প তিনি হাজারো দর্শকের সামনে করবেন বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার ল্যান্ডিং জোন হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে ‘সিমি ভ্যালি’ নামক স্থানকে বেছে নেয়া হয়। এখানে ১০০ × ১০০ ফুট আকারের বিশাল এক জাল টাঙানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি কোম্পানি ৪৩ হাজার ডলার ব্যয়ে স্পেকট্রা নামের এক বিশেষ ধরনের হাই-ডেনসিটি পলিইথিলিন কর্ড ব্যবহার করে শক্তিশালী এই জাল বানিয়ে দেয়। এতে সাদা রং ব্যবহার করা হয় যেন এইকিন্স তার ল্যান্ডিং জোন ভালোভাবে দেখতে পান। জালের মাঝখানে ছিল একটি জিপিএস ডিভাইস। পাইলট যখনই ঠিক জাল বরাবর এসে পড়বেন তখনই তিনি সিগন্যাল পাবেন। সেসনা গ্রান্ড ক্যারাভান নামের ঐ বিমানে ২৫,০০০ ফুট (৭,৬২০ মিটার) উচ্চতায় যাওয়ার পর জাম্প করার আগে তিনি রেডিওতে জাল ঠিকমতো দেখতে পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমারু বিমানের বোমা ফেলার ন্যায় ড্রপিং ট্রাজেক্টরি হিসাব করে পাইলট এরপরই এইকিন্সকে জাম্পের গ্রিন সিগন্যাল দেন। তারপরই শুরু হয় সেই দুঃসাহসী জাম্প।
তার সাথে জাম্প দেয় আরো কয়েকজন। লুক এইকিন্স যদি বাতাসের কারণে ভারসাম্য হারান সেজন্য তাকে আকাশেই উদ্ধার করতে আগে ও পরে জাম্প করে সেই তিন রেসকিউম্যান। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই প্যারাশুট ও ক্যামেরা ছিল। লুকের নিজের হেলমেট ক্যামেরা, এরিয়াল ভিডিওগ্রাফারদের ফুটেজ ও নিচে থাকা শক্তিশালী টিভি ক্যামেরার কল্যাণে ফলে ল্যান্ডিং জোনে উপস্থিত দর্শকদের মাঝে তখন নখ কামড়ানো উত্তেজনা। ইউটিউবে লাইভ সম্প্রচার দেখতে থাকা দুই মিলিয়ন মানুষের চোখ তখন মনিটরে আটকে গেছে। বাতাসের ঝাপটাকে অগ্রাহ্য করে ভারসাম্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন এইকিন্স। কিন্তু অভিকর্ষজনিত ফ্রি-ফলের কারণে তার গতি হু হু করে বাড়তেই থাকে। এ সময় তার পতনের সর্বোচ্চ গতি (টার্মিনাল ভেলোসিটি) দাঁড়ায় ১৯৩ কি.মি./ঘন্টা! অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৭৬ ফুট করে নিচে পড়ছেন এইকিন্স। এই গতিতে যদি মরুভূমির বালুতে আছড়ে পড়েন, তবে তিনি অন্তত আড়াই ফুট গভীরে গেঁথে যাবেন!
প্রায় দুই মিনিট ধরে ফ্রি-ফলের পর তিনি সফলভাবে জালে আছড়ে পড়েন। স্পেকট্রা জালের চার মাথায় চারটি কমপ্রেসড নাইট্রোজেন গ্যাস সিলিন্ডার বিশেষ কায়দায় বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে এইকিন্স ল্যান্ড করার পর ফিজিক্সের নিয়ম মোতাবেক ডিগবাজি না খেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসেন। দুর্ঘটনা এড়াতে জালের নিচে সেকেন্ডারি নেট ছাড়াও ফোমের তৈরি এয়ারব্যাগ থাকায় তার বিন্দুমাত্র আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল না। উপস্থিত দর্শকরা করতালির মাধ্যমে তাকে অভিবাদন জানায়। সবার আগে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন স্ত্রী মনিকা লি। একমাত্র শিশুসন্তান লোগান এইকিন্স তখনও বাবার কীর্তির মাহাত্ম্য বুঝে উঠতে পারছিল না।
লুক এইকিন্সের আগে অনেকেই প্যারাশুট ছাড়া জাম্প করেছেন বটে। কেউ জাম্প করে বাতাসে ভেসে ভেসে এক বিমান থেকে আরেক বিমানে গিয়েছেন। কেউ মাঝ আকাশে অন্য কোনো স্কাইডাইভার ব্যক্তি বা বিমান থেকে অথবা আগেই ফেলে দেয়া কন্টেইনার থেকে প্যারাশুট সংগ্রহ করে স্বাভাবিকভাবে ল্যান্ড করেছেন। কিন্তু লুক এইকিন্স প্রথম স্কাইডাইভার যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এত উচ্চতা থেকে প্যারাশুট ছাড়া জাম্প করে ভূমিতে নিরাপদে নেমে এসেছেন।
ভিডিওতে দেখুন সেই দুঃসাহসী জাম্পের মূহুর্তটি
একজন পেশাদার স্কাইডাইভার হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিপদজনক প্যারাশুট জাম্পের অভিজ্ঞতা লুককে এ ধরনের দুঃসাহসী কাজ করতে প্ররোচিত করেছে। এই জাম্পের মাধ্যমে তিনি দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। একটি সাক্ষাৎকারে তাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি আবারও এরকম প্যারাশুট ছাড়া জাম্পের আশা প্রকাশ করেছেন! দ্বিতীয়বার আরো অধিক উচ্চতা থেকে জাম্প করার পরিকল্পনা করছেন। তবে এটি বেশ বিপদজনক বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেদিন ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া পরিস্কার থাকায় লুক এইকিন্স প্রবল বাতাসজনিত কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি। সামরিক বাহিনীর অনেক প্যারাশুট দুর্ঘটনার তদন্তে দেখা যায়, প্রবল বাতাসের কারণে প্যারাট্রুপার নির্ধারিত ল্যান্ডিং জোনের অনেক বাইরে চলে গেছেন। ২৫ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা থেকে আবার জাম্প দিলে এইকিন্স কতটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন। তবে দুঃসাহসিক ব্যক্তিরাই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায়। হয়তো বা লুক এইকিন্স সেটিই আবার করে দেখাবেন।