অলিম্পিককে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ। প্রতি চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত যে মহোৎসবে বিশ্বের শতাধিক জাতির হাজার হাজার ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়ে থাকেন, তাকে আসলে এ রাজার উপাধি দেয়া ছাড়া গতিও নেই।
অলিম্পিক নিয়ে আজকের এ লেখার মূল আলোচনায় যাবার আগে চলুন একটি পার্শ্ব-আলোচনা সেরে নেয়া যাক। বলুন তো, অলিম্পিকে যে স্বর্ণপদক দেয়া হয় তা কি আসলেই স্বর্ণের তৈরি?
অবশ্যই না। অলিম্পিকে সর্বশেষ খাঁটি স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিলো প্রায় এক শতাব্দী আগে, ১৯১২ সালে। এরপর থেকে আর কখনোই ২৪ ক্যারাট স্বর্ণের তৈরি পদক গলায় ঝোলানোর সৌভাগ্য হয় নি কোনো অলিম্পিক অ্যাথলেটের।
আসলে পদকে বিভিন্ন উপাদান কী পরিমাণে থাকবে, সেই ব্যাপারে আয়োজক দেশটির অলিম্পিক কমিটিই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাই এক অলিম্পিকে পদকগুলোতে উপাদানের শতকরা পরিমাণ পরের অলিম্পিকের সাথে না মেলাটাই স্বাভাবিক। এ বছর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অলিম্পিকের কথাই ধরা যাক। এবার দেশটির অলিম্পিক কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো পরিবেশবান্ধব পদক প্রদানের। তাই পদকগুলোকে তৈরি করার সময়ও এ বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিলো। এবারের পদকগুলোতে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর শতকরা পরিমাণে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।
স্বর্ণপদক
স্বর্ণের পদকটি ছিলো মূলত রুপা দিয়ে বানানো। ৫০০ গ্রাম ভরের মেডেলটির ৯৮.৮ ভাগই ছিলো রুপার তৈরি (বিশুদ্ধতা ৯২.৫%)। বাকি ১.২ ভাগে ছিলো স্বর্ণের প্রলেপ (বিশুদ্ধতা ৯৯.৯%), যার ভর ছিলো ৬ গ্রাম। রিও অলিম্পিকের স্বর্ণপদকগুলোতে কোনো পারদের অপদ্রব্য ছিলো না। প্রতিটি স্বর্ণপদকের দাম ছিলো ৫৬৫$। যদি এটি খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে বানানো হতো, তবে তার দাম হতো ২১,২০০$ করে!
রৌপ্যপদক
রুপার পদকটি অবশ্য পুরোটাই রুপা দিয়ে বানানো হয়েছিলো যার বিশুদ্ধতা ছিলো ৯২.৫%। এবারের রৌপ্যপদকগুলোতে যে পরিমাণ রুপা ব্যবহার করা হয়েছে, তার শতকরা ৩০ ভাগই এসেছে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে। এ রুপার উৎস ছিলো ব্যবহার অনুপযোগী গাড়ির বিভিন্ন অংশ, এক্স-রে প্লেট ও আয়না। প্রতিটি রৌপ্যপদকের মূল্য ছিলো প্রায় ৩১৫$।
ব্রোঞ্জপদক
ব্রোঞ্জের তৈরি পদকটির শতকরা ৯৫ ভাগ ছিলো তামা (বিশুদ্ধতা ৯৩.৭%)। বাকি ৫ ভাগে ছিলো দস্তা (বিশুদ্ধতা জানা যায় নি)। এ পদকের কিছু তামা এসেছিলো ব্রাজিলের টাকশালে ব্যবহৃত তামার পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকৃত অংশ থেকে। স্বর্ণ ও রৌপ্যপদকের তুলনায় এর দাম ছিলো অত্যন্ত কম, মাত্র ২.৩৮$!
এখন আসা যাক মূল আলোচনায়। অলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্টে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হবার পর বিজয়ীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস তো আমরা সবাই দেখেছি। তারপর যখন তাদের গলায় পদকগুলো পরিয়ে দেয়া হয়, তখন আবেগের আতিশায্যে অনেককে চোখের পানি ফেলতেও দেখা যায়। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপারটি ঘটে এর ঠিক পরেই। বিভিন্ন মিডিয়ার ক্যামেরাম্যানদের সামনে বিজয়ীরা সেই পদকগুলোকে কামড়ে ধরে ছবি তুলে থাকেন! হাসিমাখা মুখে সেই পদক কামড়ে ধরা ছবি দেখে আমরাও কম মজা পাই না। আর পছন্দের ক্রীড়াবিদ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু বলুন তো, কেন তারা এভাবে পদক কামড়ে ধরেই ছবি তুলতে যান? সেখানে কি কোনো মিষ্টি পদার্থের আবরণ থাকে যা তাদের এমন কাজ করতে উৎসাহিত করে?
আসলে বিজয়ী ক্রীড়াবিদদের এমন অদ্ভুত কাজের পেছনে মূলত দুটি বিষয় কাজ করে।
প্রথমত যে বিষয়টি এর পেছনে কাজ করছে তা হলো মিডিয়ার প্রভাব। আজকের দিনে সবাই চায় ভিন্ন কিছু করতে, ভিন্নতার স্বাদ জনতাকে উপহার দিতে। প্রতিযোগিতায় জেতার পর হাসিমুখে একজন বিজয়ী ক্রীড়াবিদ তার পদক গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন- এটা তো খুবই সাধারণ এক ঘটনা। সবাই এটা করে। তাই কিছুটা নতুনত্বের আশায় ফটোগ্রাফাররাই আজকাল বিজয়ী ক্রীড়াবিদদের এমন অদ্ভুত অনুরোধ করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই মনে করেন ‘The Complete Book Of The Olympics’ বইটির সহ-লেখক ডেভিড ওয়ালেচিন্সকি।
এবার তাহলে পদকজয়ী বিভিন্ন ক্রীড়াবিদের পদক কামড়ে ধরা কিছু ছবি দেখে দেয়া যাক।
তবে বর্তমান যুগের চাহিদার পাশাপাশি অতীতের আরেকটি মজার বিষয়ও এর পেছনে কাজ করে। অতীতে স্বর্ণ খাঁটি কিনা তা যাচাইয়ের জন্য স্বর্ণের তৈরি জিনিসটিতে কামড় দিয়ে পরীক্ষা করা হতো। যদি কামড়ে দাগ বসে যেতো, তাহলে বোঝা যেতো যে, জিনিসটি খাঁটি স্বর্ণের তৈরি। আর দাগ না পড়লে সেটি নকল।
পাইরাইট হলো এক ধরনের খণিজ পদার্থ যেটি আসলে আয়রন সালফাইড। এর ধাতব ঔজ্জ্বল্য এবং ফ্যাকাশে হলুদাভ রঙের জন্য একে অনেকটা স্বর্ণের মতোই দেখায়। ফলে ঠিকমতো না দেখলে কেউ একে স্বর্ণ ভেবেও ভুল করতে পারেন। এজন্য একে ‘বোকার স্বর্ণ’ও বলা হয়ে থাকে। কোনো জিনিস পাইরাইট নাকি খাঁটি স্বর্ণের তৈরি তা বুঝতে দাঁতের কামড়ের সাহায্য নিলেও এটি কিন্তু আসলেই নির্ভরযোগ্য এক পদ্ধতি।
১৮১২ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ ও খণিজবিদ ফ্রিডরিখ মোহ্স খণিজ পদার্থের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য এক স্কেল উদ্ভাবন করেন যেটি ‘Mohs Scale of Mineral Hardness’ নামে সুপরিচিত। এ স্কেলে প্রমাণ হিসেবে ১০টি পদার্থের দৃঢ়তাকে ব্যবহার করা হয়। নিচের টেবিলে সেই দৃঢ়তার স্কেলটি তুলে দেয়া হলোঃ
এখানে একটি খণিজকে টেবিলে উল্লেখ করা ১০টি খণিজ দিয়ে ঘষা দিলে তাতে দাগ পড়ে কিনা সেই অনুযায়ী তার দৃঢ়তা পরিমাপ করা হয়। ধরা যাক, একটি নমুনা A ও একটি প্রমাণ খণিজ (অর্থাৎ যেটির দৃঢ়তা জানা) B নিয়ে আমরা কাজ করছি। এমন অবস্থায় ৪ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে-
(১) যদি A B-এর উপর দাগ ফেলতে পারে, তাহলে A খণিজের দৃঢ়তা B খণিজ থেকে বেশি।
(২) যদি A B-এর উপর দাগ ফেলতে না পারে, তাহলে B খণিজের দৃঢ়তা A খণিজ থেকে বেশি।
(৩) যদি A ও B এর দৃঢ়তা খুব কাছাকাছি হয়, তাহলে তারা একে অপরের উপর সেভাবে দাগ ফেলতে পারবে না। পারলেও সেটা খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর হবে।
(৪) যদি নমুনা খণিজ A-এর উপর প্রমাণ খণিজ B দিয়ে দাগ দেয়া যায় কিন্তু ৩য় আরেকটি প্রমাণ খণিজ C দিয়ে দাগ দেয়া না যায়, তাহলে A-এর দৃঢ়তা B ও C এর মধ্যবর্তী হবে।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মোহ্সের দৃঢ়তা স্কেলে দাঁতের এনামেল, স্বর্ণ ও পাইরাইটের মান যথাক্রমে ৫, ২.৫-৩ এবং ৬-৬.৫। অর্থাৎ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে স্বর্ণের উপর দাগ পড়বে ঠিকই, কিন্তু পাইরাইটের উপর না। এজন্যই অতীতে স্বর্ণ খাঁটি কিনা তা যাচাইয়ে কামড়ানোর মতো এমন অদ্ভুত পন্থার উদ্ভাবন করেছিলো মানুষেরা।
এতক্ষণের আলোচনার ভিত্তিতে তাহলে আমরা বলতে পারি, যদিও আজকাল কেবল মিডিয়ার চাহিদা মেটাতেই অলিম্পিক বা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক খেলায় খেলোয়াড়েরা পদক কামড়ে থাকেন, তবে এককালে এটি করা হতো আসল-নকল যাচাইয়ের জন্য। তবে এখনকার স্বর্ণপদকে স্বর্ণ যে নামমাত্র পরিমাণে উপস্থিত থাকে তা তো খেলোয়াড়েরাও জানেন। তাই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম কারণটিকেই প্রধান ধরা যায়।
তবে পদক কামড়াকামড়ির অভ্যাস কিন্তু কখনো কখনো দুর্ভাগ্যও বয়ে আনতে পারে। ২০১০ সালে জার্মানির লুজার ডেভিড মোয়েলার তার রৌপ্যপদকটিকে ফটোগ্রাফারদের অনুরোধে কামড় দিতে গিয়ে এতটাই জোরে কামড় দিয়েছিলেন যে তার দাঁতের এক কোণা তাতে ভেঙেই গিয়েছিলো!