মিরোস্লাভ ক্লোসা: বিশ্বকাপের বিস্ময়

শুধু বিশ্বকাপের বিস্ময় নয়, তাকে বলা উচিত আধুনিক ফুটবলের বিস্ময়।

আধুনিক ফুটবল মানে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের ফুটবল। এই ফুটবলে একজন ফরোয়ার্ড ক্লাবের হয়ে শয়ে শয়ে গোল করবেন, কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে গোলের সেই হার থাকবে না। একজন মেসিকেই দেখুন না; বার্সেলোনার হয়ে সর্বকালের সেরা স্কোরার তিনি। কিন্তু সেই মেসিরই গোলের অনুপাত জাতীয় দলে অনেক কম। এই সময়ে এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে একজন মিরোস্লাভ ক্লোসা এই সব সমীকরণ বদলে দিয়েছেন।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ওয়ের্ডার ব্রেমের, বায়ার্ন মিউনিখ, লাজিওর মতো দলে খেলেছেন। গোল করেছেন। কিন্তু কখনোই ঈর্ষণীয় হারে গোল করেননি। বায়ার্নের হিসাবটাই দেখুন। এখানে ৯৮ ম্যাচে মাত্র ২৪টি গোল ক্লোসার। সেই ক্লোসাই জাতীয় দলের হয়ে যখন খেলেন, তখন যেন হয়ে ওঠেন ভিন্ন জগত থেকে আসা এক স্কোরার। যার কাছে বক্সের ভিতর বল মানেই গোল। জাতীয় দলের হয়ে ১৩৭ ম্যাচে তার ৭১টি গোল।

জার্মানির সর্বকালের সেরা স্কোরার এই মিরোস্লাভ ক্লোসা। তবে বিস্ময়টা তিনি আরও জমিয়ে রাখতেন বিশ্বকাপের জন্য। চার বছর ধরে ক্লোসা যেমনই খেলুন, বিশ্বকাপ এলে হয়ে উঠতেন যেন গোল মেশিন। চারটি বিশ্বকাপে করেছেন ১৬টি গোল। হয়ে উঠেছেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী গোলের মালিক। এবার তারই উত্তরসুরী থমাস মুলার তাকে ছাপিয়ে না গেলে এই রেকর্ডটা কারো পক্ষে ভাঙাও খুব মুশকিল হবে

ওয়ের্ডার ব্রেমেনে যখন ছিলেন; সোর্স: উইকি

ক্লোসা চিরকালই যেন রইবেন বিশ্বকাপের বিস্ময় হয়ে।

নিজেকে বলেন, একজন ইউরোপিয়ান। তিনি পোলিশ নন, তিনি জার্মান নন, তিনি ফ্রেঞ্চ নন; তিনি একজন ইউরোপিয়ান। যদিও জার্মানির হয়েই ফুটবলটা খেলেছেন, জার্মান পাসপোর্টকেই সবচেয়ে বেশী দাম দিয়ে থাকেন। কিন্তু ক্লোসা নিজে বলেন, তিনি আসলে একজন ইউরোপিয়ান। এটা বলার কারণও আছে।

১৯৭৮ সালে পোল্যান্ডের সিলিসিয়ান অঞ্চলের শহর অপলে জন্ম তার। বাবা-মা দুজনই ছিলেন নামকরা অ্যাথলেট। বাবা জোসেফ ক্লোসা পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। মা বারবারা জেজ ছিলেন পোল্যান্ড জাতীয় নারী হ্যান্ডবল দলের সদস্য। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নটা পেয়েছেন ক্লোসা।

জোসেফ ওড্রা অপল দলের হয়ে ফুটবল খেলতেন। এরপর কমিউনিস্ট পোল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমিয়ে সেখানকার দল অক্সেরের হয়ে ফুটবল খেলেছেন জোসেফ। ক্লোসার জন্মের বছরই তার পরিবার পোল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যায়। ফলে জন্মসূত্রে পোলিশ হলেও ক্লোসা বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্সে।

ফ্রান্সেও বেশীদিন হাড়িতে কালি পড়লো না ক্লোসা পরিবারের। কারণ, বাবা জোসেফ চাচ্ছিলেন জার্মানিতে ফিরে যেতে। জোসেফ জন্মসূত্রে ছিলেন জার্মান। কারণ, তার জন্মের সময় সিলিসিয়া অঞ্চলটা জার্মানির মধ্যেই ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিলিসিয়া চলে গেলো পোল্যান্ডে। তবে সে সময় একটা আইন করা হয় যে, নৃতাত্ত্বিকভাবে যারা ইউরোপের যে দেশের নাগরিক ছিলেন, তারা ভবিষ্যতে চাইলে সেই দেশে ফিরে যেতে পারবেন। এই আইন কাজে লাগিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে জার্মানিতে পাড়ি জমান জোসেফ। ১৯৮৬ সালে আট বছর বয়সী মিরোস্লাভ ক্লোসা ও তার মা গিয়ে বাবার সাথে বসবাস শুরু করেন জার্মানির কুসেলে। সে সময় ক্লোসা নাকি মাত্র দুটো জার্মান শব্দ জানতেন!

এখানেই গ্রামের এক ক্লাবে ক্লোসার ফুটবল খেলা শুরু। ক্লাবটা তখন জার্মানির সপ্তম বিভাগে খেলে। ফুটবল খেলার পাশাপাশি ভবিষ্যত জীবিকার জন্য ক্লোসা তখন কাঠমিস্ত্রীর কাজ শিখছিলেন। সেই ছেলেটির জীবিকা যে ফুটবলেই, সেটা কে জানতো!

বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে গোল; সোর্স: ডিডব্লিউ

খুব দ্রুতই ক্লোসা নিজেকে বুন্দেসলিগায় নিয়ে যেতে পারলেন তার অবিশ্বাস্য স্কোরিং ও হেড করে গোল করার দক্ষতার কারণে। দিকে দিকে ক্লোসার এই ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিলো। এফসি হামবুর্গে শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। এরপর এফসি কাইজারস্লাটার্নে খেলার সুযোগ পেলেন। প্রথমে দলটির দ্বিতীয় দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। এরপর ২০০০ সালে বুন্দেসলিগায় খেলে ফেললেন। পরের মৌসুমে এই দলের হয়ে ১৬ গোল করলেন। মাত্র দুই গোলের জন্য টপ স্কোরার হতে পারলেন না। ততদিনে ক্লোসা নজরে পড়ে গেছেন।

এই পারফরম্যান্সের পরই ক্লোসার বাড়িতে এসে হাজির হলেন তখনকার পোল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ জেরি অ্যাঙ্গেল। তিনি এসে প্রস্তাব দিলেন, পোল্যান্ডের হয়ে খেলো। যেহেতু ক্লোসা জন্মসূত্রে পোলিশ, তাই চাইলেই তিনি এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারতেন। ক্লোসা এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। পরে সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আমি জার্মান পাসপোর্টের মালিক, জার্মানিতেই থাকি। আমার জাতীয় দলের হয়ে খেললে রুডি ফোলারের দলের (জার্মান দল) হয়েই খেলা উচিত বলে আমি মনে করেছিলাম।“

সেই স্বপ্ন পূরণ হতে খুব একটা দেরি হলো না। একদিকে আরও বড় ক্লাব থেকে ডাক পেয়ে গেলেন। চললেন এবার ওয়ের্ডার ব্রেমেনে। অন্য দিকে ফোলারও জার্মান জাতীয় দলে ডেকে নিলেন ক্লোসাকে। ২০০১ সালের ২৪ মার্চ আলবেনিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে অভিষেক হলো এই তরুণ স্কোরারের। ৭৩ মিনিটে বদলী খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন। মাঠে নামার দুই মিনিটের মধ্যে ক্যারিয়ারের প্রথম এবং জার্মানিকে সেই ম্যাচ জেতানো গোলটা করলেন হেড করে। গোল করে ‘ফ্রন্ট ফ্লিপ’ সেলিব্রেশন করলেন। ওই এক ম্যাচই ক্লোসার সারা জীবনের বিজ্ঞাপন হয়ে রইলো।

ক্লোসা মানে গোল, ক্লোসা মানে হেড এবং ক্লোসা মানে ফ্রন্ট ফ্লিপ সেলিব্রেশন বা সমারসল্ট! এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ক্লোসার গোল করা ম্যাচে জার্মানি কখনো হারে না; এই সত্য শুরু হয়ে গেলো ওই ম্যাচ থেকেই।

বাছাইপর্বে আরও কয়েকটা গোল, দুটো হ্যাটট্রিক ক্লোসার বিশ্বকাপ দলে জায়গা নিশ্চিত করে দিলো। বিশ্বকাপে পাঁচটি গোল করলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, পাঁচটি গোলই এলো মাথা থেকে। এই প্রথম বিশ্বকাপের ইতিহাসে কোনো খেলোয়াড় ৫টি হেড করে গোল করলেন। রিভালদোর সাথে যৌথভাবে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন। তবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো এককভাবেই। বিখ্যাত হয়ে গেলো তার সেলিব্রেশন। জার্মানরা আদর করে নাম দিলো ‘সাল্টো-ক্লস’।

যে ডিগবাজিটা দিতেন, ওটার নাম সমারসল্ট; জার্মান ভাষায় সাল্টো। সেখান থেকে সান্তাক্লজের সাথে মিলিয়ে নাম হলো সাল্টোক্লজ!

বিখ্যাত সেই ‘সাল্টো-ক্লস’; সোর্স: এপি

পরের ইউরোটা খুব ভালো গেলো না। হাঁটুর ইনজুরি থেকে সেরে উঠে সবগুলো ম্যাচ খেলতেও পারলেন না। এর মধ্যে বায়ার্ন মিউনিখে চলে এসেছেন। সেখানে খুব গোলের ফুলঝুরি ফোটাতে পারছেন না। তারপরও জাতীয় দলের প্রশ্ন এলেই ক্লোসার মাথা বিদ্যুতের মতো কাজ করতে থাকলো। তাই ২০০৬ বিশ্বকাপেও জায়গা করে নিলেন দলে। এবারও ৫ গোল করে হলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার।

২০০৮ সালের ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দুই গোল করলেন। ফাইনালে আর পারলেন না; জার্মানিও পারলো না। ২০১০ বিশ্বকাপ আসতে আসতে একটু বয়স হয়ে গেলো। তারপরও দলে আছেন, তারপরও গোলের বন্যা আছে। এবার বিশ্বকাপেও করলেন ৪ গোল। রোনালদোর চেয়ে মাত্র ১ গোল পেছনে। এখানেই কি তাহলে থেমে যাবে ক্লোসার হিসাব?

নাহ। জার্মানরা আরও একবার ভরসা রাখলো ক্লোসার ওপর। ক্লোসা প্রতিদান দিলেন। দুই গোল করলেন এবং প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি স্পর্শ করার সুযোগটা পেলেন। অবশেষে ক্লোসা একটা শান্তি নিয়ে অবসরে যেতে পারলেন। অবসরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জার্মান দলের কোচিং স্টাফে যোগ দিলেন। এখন তিনি মুলারদের গোল করা শেখান।

তাহলে এতদিনে ক্লোসা জার্মান হয়ে উঠেছেন?

না। বাসায় এখনও বাচ্চাদের সাথে পোলিশ ভাষায় কথা বলেন। আবার সেই বাচ্চাদেরই স্কুলে জার্মান শেখার তাগিদ দেন। তিনি কোনোভাবেই এক গন্ডিতে নিজেকে আটকাতে চান না। হয়ে ওঠেন খাটি ইউরোপিয়ান!

Related Articles

Exit mobile version