অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল ২০০১ সালে যেবার ভারত সফরে এলো, তখন তারা টানা ১৫টি টেস্ট জিতে রীতিমতো আকাশে উড়ছে। ব্যাটিংয়ে স্টিভ ওয়াহ্, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং আর বোলিংয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা-শেন ওয়ার্নদের নিয়ে গড়া দল বলতে গেলে একরকম ‘অজেয়’ হয়ে উঠেছিল৷ ভারত সফর তাই তাদের জয়ের তালিকা আরও দীর্ঘায়িত করবে, এই প্রত্যাশা নিয়েই সবাই টিভির সামনে বসেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেট অন্যান্য ফরম্যাটের ক্রিকেটের মতো সহজ নয়। এখানে পনের সেশনের মধ্যে কমপক্ষে দশ সেশনেই আপনার দলের ট্রাম্পকার্ডগুলোকে জ্বলে উঠতে হবে। একটা ভুল ডিসিশনে আপনার হাত থেকে ম্যাচ বের হয়ে যাবে। ব্যাটসম্যানদের এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং করে যেতে হয়, পার্টনারশিপ গড়তে হয়। একটি ভুল শট ব্যাটসম্যানের সুন্দরভাবে শুরু করা ইনিংসের ইতি টেনে দিতে পারে। বোলারদের ওভারের পর ওভার ব্যাটসম্যানের মতি বুঝে বল করে যেতে হয়।
মোট কথা, টেস্ট ক্রিকেটে যেরকম পেশাদারিত্ব, ধৈর্য্য আর দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়, আর কোনো ফরম্যাটেই সেভাবে দিতে হয় না। তাই টেস্ট ক্রিকেট এখনও ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট হিসেবে স্বীকৃত।
প্রথম টেস্ট ম্যাচে ভারতকে নিয়ে ছেলেখেলা করে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম টেস্টের আগে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুতে ক্রিকেট বিশ্বের সবাই শোকাহত ছিল। এক মিনিটের নীরবতার পর টসে জিতে শুরুতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান অজি ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ্। মুম্বাইয়ের পিচে অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা সুবিধা পাবে, এই ভেবেই ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
অধিনায়কের ভরসার যোগ্য প্রতিদান দিয়েছিলেন শেন ওয়ার্ন-গ্লেন ম্যাকগ্রা। তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। ওয়ার্ন আর গ্লেন ম্যাকগ্রার বোলিং তোপে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৭৬ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল ভারত। এই দুই বোলার একত্রে নিয়েছিলেন সাত উইকেট।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে গিলক্রিস্ট আর হেইডেনের সেঞ্চুরিতে ৩৪৯ রানের দাঁড় করায় অস্ট্রেলিয়া। ১৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ভারত। রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুুলকার, সদাগোপান রমেশরা অজি বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। মাত্র ২১৯ রানেই শেষ হয় ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস।
প্রথম টেস্ট জিততে অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় মাত্র ৪৭ রান। দুই ওপেনার ম্যাথু হেইডেন আর মাইকেল স্ল্যাটার মিলে সাত ওভারেই লক্ষ্যে পৌছে যান। ১–০ তে টেস্ট সিরিজে এগিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। টানা ১৬ টেস্ট জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে।
কলকাতার ইডেন গার্ডেনের দ্বিতীয় টেস্ট নিয়ে ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের খুব একটা প্রত্যাশা ছিল না। দুরন্ত ফর্মে থাকা অজি ক্রিকেটারদের সামনে আরেকবার নাস্তানাবুদ হতে যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট দল – সবাই এমনটাই ধরে নিয়েছিল।
কিন্তু ভাগ্যদেবতা অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য।
ইডেন গার্ডেনে এবারও টসে জিতলেন অজি ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ্। সোজা ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ্’র ১১০ এবং ম্যাথু হেইডেনের ৯৭ রানের উপর ভর করে প্রথম ইনিংসে ৪৪৫ রানের বিশাল স্কোর গড়ে অজিরা। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন হরভজন সিং। ১২৩ রানে সাত উইকেট নিয়েছিলেন সেই ইনিংসে।
নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আবারও প্রথম টেস্টের পুনরাবৃত্তি করে ভারত। ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নামা ভিভিএস লক্ষ্মণের ৫৯ রান ছাড়া বলার মতো রান করতে পারেননি আর কেউই। ফলাফল, ভারত ১৭১ রানে অলআউট। ভারতের ছয়জন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কে যেতে পারেননি। অজি ক্যাপ্টেন ভারতকে ফলোঅন করালেন।
ফলোঅনের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় ওপেনাররা আবার ব্যর্থ। ওপেনারদ্বয় শিবসুন্দর দাশ আর সদাগোপান রমেশ যথাক্রমে ৩৯ ও ৩০ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন। পরাজয় তখন চোখ রাঙ্গাচ্ছে বারবার।
কিন্তু ওপেনারদের বিদায়ের পর যা ঘটলো, তা স্বয়ং ভারতের ক্রিকেট খেলোয়াড়রাও ভাবতে পারেননি।
প্রথম ইনিংসে ভালো করার সুবাদে ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলি এবার ভিভিএস লক্ষ্মণকে তিন নাম্বারে ব্যাট করতে পাঠালেন। এই একটি সিদ্ধান্তই পাল্টে দিল পুরো ম্যাচের গতিপথ। একটি সিদ্ধান্তই অজিদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ম্যাচে চালকের আসনে বসালো ভারতকে।
তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ভিভিএস লক্ষ্মণ দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন। কিন্তু শচীন টেন্ডুলকার কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলী, কেউই তাকে উপযুক্ত সঙ্গ দিতে পারলেন না। টেন্ডুলকার ১০ এবং গাঙ্গুলি ৪৮ করে বিদায় নিলেন। ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন ‘দ্য ওয়াল’-খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়। পিচে গিয়ে ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গী হলেন।
ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়ের রসায়ন শুরু হয়েছিল বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। দু’জনে একসাথে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। জাতীয় ক্রিকেটে সাউথ জোনের হয়েও দু’জনে একসাথে খেলেছেন। রাহুল দ্রাবিড়ের ভাষ্যে,
“সাউথ জোন লেভেল থেকেই তার সাথে ব্যাটিং করা আমি খুব সুন্দর উপভোগ করি। আমাদের এই একসাথে খেলাটা জাতীয় দলের হয়েও অব্যাহত থাকায় আমি বেশ সুবিধা পাই।”
ভারত ৪ উইকেটে ২৫৪ রান করে তৃতীয় দিন শেষ করে। ভিভিএস লক্ষ্মণ ১০৯ ও রাহুল দ্রাবিড় ৭ রানে অপরাজিত ছিলেন। ভারত তখনও ২০ রানে পিছিয়ে। অস্ট্রেলিয়া প্রত্যাশা করেছিল, চতুর্থ দিনে যত অল্প রানে সম্ভব ভারতকে অলআউট করে দ্বিতীয় টেস্টও জিতে নেবে। কিন্তু ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড় দু’জনে মিলে চতুর্থ দিন সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছিলেন।
চতুর্থ দিনে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় জুটি পঞ্চম উইকেটে ৩৩৫ রান যোগ করেছিলো। পুরো নব্বই ওভার ব্যাটিং করেছিলেন তারা, একটি উইকেটেরও পতন হতে দেননি। সুনীল গাভাস্কার এই টেস্টের আগে ভারতের হয়ে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের মালিক ছিলেন, কিন্তু এই টেস্টের পর ভিভিএস লক্ষ্মণ তার জায়গা দখল করেন। টেস্টে ভারতের হয়ে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড নিজের করে নেন ভিভিএস লক্ষ্মণ।
শেন ওয়ার্নের মতো কিংবদন্তি লেগস্পিনারকে যেভাবে সামলেছিলেন, তা এখনও ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে লেগে আছে। ওয়ার্নের প্রতিটা বল দেখে খেলছিলেন লক্ষ্মণ। কখনো কাভার দিয়ে ড্রাইভ করছিলেন, কখনো মিড উইকেটে দর্শনীয় ফ্লিক করছিলেন। লক্ষ্মণের সেই মহাকাব্যিক ইনিংসের পর ওয়ার্ন বলেছিলেন,
“আমি তার (লক্ষ্মণের) পায়ে বল করছিলাম। কিন্তু সে সরে গিয়ে ড্রাইভ করছিলো, কখনো মিড উইকেটে খেলছিল। তার বিপক্ষে বল করাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল।”
ইনিংসে লক্ষ্মণ এবং দ্রাবিড় খুব কম কথা বলেছিলেন। লক্ষ্মণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তারা প্রতিটা বল বুঝে বুঝে খেলছিলেন। তার ভাষ্যমতে,
“আমরা যারা মাঠে ছিলাম, তাদের জন্য এটি একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি ছিল। ফলো-অনের পর আমরা তাদের (অজিদের) চেয়ে ২৭৪ রানে পিছিয়ে ছিলাম। আমরা যা করেছি, আমরা প্রতিটা বল বুঝে বুঝে খেলছিলাম।”
লক্ষ্মণ আরও বলেছিলেন,
“আমরা খুব বেশি কথা বলিনি। আমরা প্রতি ওভার শেষ হাত মিলাচ্ছিলাম, আর পরস্পরকে বলছিলাম ‘আরও এক ওভার’।”
জেসন গিলেস্পি, গ্লেন ম্যাকগ্রা ও শেন ওয়ার্নদের নিয়ে গড়া বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে ১০৪ ওভার ব্যাটিং করা কোনো সহজ বিষয় ছিল না। কিন্তু লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় জুটি সেটি করে দেখিয়েছিলেন। তাদের ৩৭৬ রানের জুটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এখনও পর্যন্ত ভারতের হয়ে সবচেয়ে বড় জুটির রেকর্ড হিসেবে অক্ষত আছে।
পঞ্চম দিনে যখন ব্যক্তিগত ১৮০ রানে রাহুল দ্রাবিড় রানআউট হলেন, তখন ভারত ইনিংস ঘোষণা করে। ততক্ষণে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ৭ উইকেটে ৬৫৭। জিততে হলে অস্ট্রেলিয়াকে ৩৮৪ রান করতে হতো৷ একজন ক্রিকেটপ্রেমী হলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, চতুর্থ ইনিংসে ৩৮৪ রান করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ, চারদিন বোলিংয়ের পর পঞ্চম দিনে পিচ বোলারদের পক্ষে থাকে।
প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও দুর্দান্ত বোলিং করেন হরভজন সিং। দ্বিতীয় ইনিংসে হ্যাটট্রিকসহ ছয় উইকেট নেন তিনি। তার সেই হ্যাটট্রিক ছিল ভারতের ইতিহাসেই প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক। ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যান হরভজন সিং।
অস্ট্রেলিয়া ২১২ রানেই গুটিয়ে যায়। ১৭২ রানের বড় জয় পায় ভারত। টেস্ট সিরিজে ১–১ সমতা নিয়ে আসে ভারত। অবধারিতভাবেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ।
আধুনিক ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ইনিংসে ফলোঅনে পড়েও টেস্ট জেতার ঘটনা মাত্র তিনটি। তার মধ্যে এই টেস্টটি একটি।
এই টেস্ট ম্যাচটিই ভারত দলের মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে ফেলে। পরের টেস্টেও ভারত দল জয় পায়, এবং ২–১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে যায়। আকাশে উড়তে থাকা অস্ট্রেলিয়াকে টেনে মাটিতে নামায় ভারত।
ইডেন গার্ডেনের বাইশ গজে সেদিন সত্যিই অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ। তার ইনিংসটি যে ব্যক্তি সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন, সেই রাহুল দ্রাবিড় তো আর এমনিতেই ‘একজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের খেলা সেরা ইনিংস’ বলে স্বীকৃতি দেননি!