২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক মধুর স্মৃতির মঞ্চ। বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়দের নিয়ে গড়া ভারতকে ভূপাতিত করে সুপার এইট পর্বে খেলেছিলো বাংলাদেশ। সুপার এইটে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকেও হারিয়েছিলো হাবিবুল বাশার সুমনের দল।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপের আসর আয়ারল্যান্ডের জন্যও রোমাঞ্চকর এক অধ্যায় ছিল। দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসে গৌরবময় সময়ের ধারক ২০০৭ বিশ্বকাপ। সেবারই প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলা আয়ারল্যান্ড তাক লাগিয়ে দিয়েছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে। স্বপ্নময় বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেয় আয়ারল্যান্ড। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী হয়ে সুপার এইট পর্বে উন্নীত হয় আইরিশরা।
তাদের স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত ছিল সুপার এইট পর্বেও, যেখানে তাদের শিকার ছিল বাংলাদেশ! বিশ্বকাপ অভিষেকেই দুই টেস্ট খেলুড়ে দেশকে হারানোর বাঁধনহারা আনন্দের স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরেছিলো ট্রেন্ট জনস্টনের দল।
তখন কী দুর্দান্ত দলই না ছিল আয়ারল্যান্ড। টপঅর্ডারে উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড, ইয়োন মরগান (বর্তমানে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে অধিনায়ক), মিডল অর্ডারে ও’ব্রায়েন ব্রাদারস (নেইল ও’ব্রায়েন, কেভিন ও’ব্রায়েন), বোলিংয়ে অধিনায়ক জনস্টন ও বয়েড র্যানকিন। তাদেরকেই বলা হয় আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্ম। পরে সেই তালিকায় এড জয়েস, জন মুনিদের নামও যুক্ত হয়েছে। এদের হাত ধরে ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর গৌরব অর্জন করেছিল দেশটি। ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও পরাজিত করেছিলো তারা।
আয়ারল্যান্ডের সেই সোনালী প্রজন্মের প্রতিনিধি নেইল ও’ব্রায়েন। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ষষ্ঠ আসরে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন ক্রিকেটকে বিদায় জানানো সাবেক এই বাঁহাতি উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। আয়ারল্যান্ডের সংগ্রামের, ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠার সময়টার সাক্ষী তিনি। বিপিএলে ধারাভাষ্য দেয়ার ফাঁকে নিজের দেশ, নিজের পরিবার, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছেন নেইল ও’ব্রায়েন।
ক্রিকেট পাগল পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। বাবা জিঞ্জার ও’ব্রায়েন ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার। পরে তারা দুই ভাই আয়ারল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। বোন সিয়ারা ও’ব্রায়েনও ক্রিকেট খেলেছেন। পরিবারের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে নেইল ও’ব্রায়েন বলেছেন,
আমরা সব ধরনের খেলা খেলেছি। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট সব খেলেছি। তবে ক্রিকেট আমার সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল। আমাদের পরিবারের সবাই ক্রিকেট খেলেছে। ছয় ভাই-বোনের সবাই প্রতিদিন ক্রিকেট খেলতাম। তবে আয়ারল্যান্ডের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে খেলা, বিশ্ব ভ্রমণ করা, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সুযোগ পাওয়া… সব কিছু মিলিয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলবো। এখন আবার অবসরের পর মিডিয়ায় ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে পারছি, এমন সুযোগের জন্যও আমি কৃতজ্ঞ।
২০০০ সালের দিকে নিজের শুরুর সময়টাতে আইরিশ ক্রিকেটের সংগ্রামী অধ্যায় সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে ৩৭ বছর বয়সী এই সাবেক ক্রিকেটার বলেছেন,
এখনকার তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না তখনকার সময়ে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট কেমন ছিল। কোনো চুক্তি ছিল না, ছিল না কোনো অবকাঠামো। খেলার জন্য কিট পাওয়াও মুশকিল ছিল। দুটি শার্ট ও একটি ক্যাপ, এছাড়া কিছুই ছিল না আমার। আপনি যদি ভাগ্যবান হন, তাহলে আপনি ব্যাটের স্পন্সর পাবেন। কিন্তু এখন তো ক্রিকেট অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেটাররা এখন ভালো অর্থ উপার্জন করছে। বিশ্ব ভ্রমণ করছে, টেস্ট ম্যাচ খেলছে। খেলাটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ক্রিকেট খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়েছে। আয়ারল্যান্ডের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল।
নেইল ও’ব্রায়েনের মতে, আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্মের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। বলেছেন,
আমাদের দলটা ভালো ছিল। স্থিতিশীল দল ছিল। আয়ারল্যান্ড খেললে সবসময় ৯-১০ জন প্লেয়ার চেনা মুখ একাদশে থাকবে এটা নিশ্চিত ছিল। জয়েস, ও’ব্রায়েন, জনস্টন, মুনি এরা খেলবেই, এটা সবাই জানতো। আমি মনে করি, আপনি যেটা বললেন, সোনালি প্রজন্ম, তখন নিজেদের এভাবেই চিন্তা করতাম আমরা। তবে এখন অনেক ভালো ক্রিকেটার বের হয়ে আসছে।
আয়ারল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার বিশ্বাসটা সবসময় ছিল ও’ব্রায়েনদের মাঝে, ২০০৭ সালে যা বাস্তবে রুপ নেয়। বিশ্বকাপ খেলার বিশ্বাস কতটা ছিল, জানতে চাইলে নেইল ও’ব্রায়েন বলেছেন,
হ্যাঁ, আমাদের বিশ্বাস ছিল। তবে আমি বলব, আমি কখনো ভাবিনি আমরা টেস্ট খেলতে পারবো। ভেবেছিলাম, আমাদের পরের প্রজন্ম টেস্ট খেলতে পারবে। গত বছরের মে মাস সেদিক থেকে অনেক বড় ঘটনা ছিল আমাদের ক্যারিয়ারের জন্য। তবে আমি বিশ্বকাপ খুব পছন্দ করতাম। আমি বড় মঞ্চ, বড় দলের বিপক্ষে পারফর্ম করে মজা পেতাম। সব মিডিয়া দেখবে, সারা দুনিয়া দেখবে, আপনি দলকে জেতাবেন, পুরো দুনিয়া কয়েক দিনের জন্য আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট নিয়ে কথা বলবে, এসব আমার ভালো লাগতো।
২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচে এই বাঁহাতি খেলেছিলেন ৭২ রানের ইনিংস। ওই ইনিংস নাকি বদলে দিয়েছিল নেইল ও’ব্রায়েনের জীবন। তিনি বলেছেন,
অবিশ্বাস্য ছিল। আমার জীবন বদলে দিয়েছে ওই ইনিংসটি। আমি খুবই বাজে ফর্মের মধ্যে ছিলাম, ভালো ব্যাটিং করছিলাম না। তবে কোচ আমার পক্ষে ছিলেন। তিনি আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। আমি ভালো কিছু করতে পারবো, এই বিশ্বাস তার ছিল। সেদিন সবকিছুই আমার পক্ষে গিয়েছে। ওই দিনটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আমি এরপরই বিপিএল, আইসিএল ও আরও অন্যান্য টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পাই। বিভিন্ন লিগে খেলার সুবাদে আমি বড় ক্রিকেটারদের সাথে পরিচিত হই। আমার জন্য অনেক বড় অভিজ্ঞতা ছিল।
প্রতিবেশী ইংল্যান্ডকে ২০১১ বিশ্বকাপে হারানোর মাহেন্দ্রক্ষণকে ঐতিহাসিক বলেই উল্লেখ করেন নেইল ও’ব্রায়েন। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেছেন,
রান তাড়া করে সেই ঐতিহাসিক জয়। আমরা তিনবার বিশ্বকাপে ৩০০ রান তাড়া করেছি। ২০১৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছি ৩২০ রানের লক্ষ্য তাড়া করে। ২০১১ সালে কলকাতায় নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েছি। তবে হ্যাঁ, সেই ম্যাচটায় বিশ্বের সামনে আরেকবার নিজেদের চিনিয়েছে আয়ারল্যান্ড। জানান দিয়েছি যে, ২০০৭ সালে পাকিস্তানকে হারানো অঘটন ছিল না। কেভিন খুবই ভালো খেলেছে। আয়ারল্যান্ডে সবার জন্যই স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল সেই দিনটি। পুরো আয়ারল্যান্ডে সেই সময়টা শুধুই ক্রিকেটময় ছিল। আর কেভিন ছিল মূল তারকা।
টেস্ট খেলার আশাটা ছিল না নেইল ও’ব্রায়েনদের মনে। ২০১৭ সালে অভিজাত আঙিনায় পা রাখার মতো অর্জনের জন্য আইরিশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। গত বছর মে মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্ট খেলে আয়ারল্যান্ড, যে দলে ছিলেন ও’ব্রায়েন ভ্রাতৃদ্বয়।
টেস্টের প্রথম দিনের সকালের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে ১ টেস্ট, ১০৩ ওয়ানডে ও ৩০ টি-টোয়েন্টি খেলা এই সাবেক ক্রিকেটার বলেছেন,
এককথায় অসাধারণ। প্রথম সকালে টেস্ট ক্যাপ হাতে পাওয়া, কয়েক ফোঁটা অশ্রু, স্নায়ুর চাপ, সব কিছু মিলিয়ে স্মরণীয় সময় বলা যায়। প্রথম কয়েকটা বল খুব নার্ভাস ছিলাম। তবে দ্রুত উইকেট পাওয়ার কিছুটা শান্ত হয়েছি। সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। তবে আমি খুব বেশি রান পাইনি। মোহাম্মদ আমির আমার দুই স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেছিলো। আমি উপভোগ করেছি, ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত।
ডাবলিনে ওই ম্যাচে নেইল ও’ব্রায়েন দুই ইনিংসে ১৮ রান করলেও কেভিন ও’ব্রায়েন ব্যাট হাতে দারুণ সফল ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৪০ রান করেছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন কেভিন। ২১৭ বলে ১১৮ রানের ইনিংস খেলেছেন।
নিজের ভাইয়ের গৌরবময় ইনিংস নিয়ে নেইল ও’ব্রায়েন বলেছেন,
ইনিংসটি অসাধারণ ছিল। এত ঠান্ডা মাথায় সে খেলবে, আমি ভাবিনি। সে বল ভালোই থামিয়েছে। ভালো টেকনিক, মানসিক শক্তি দেখিয়েছে সেদিন। বাজে বল শাসন করে খেলেছে সে। আমাদের পরিবারের জন্য খুবই আবেগপ্রবণ সময় ছিল। বাবা-মা দুজনই ছিলেন, পুরো পরিবার খেলা দেখেছে সরাসরি। মাঠের পাশেই ছিল সবাই। আবারো, অনেক অশ্রু, খুশির অশ্রু।
গত বছর ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন নেইল ও’ব্রায়েন। বেলফাস্টে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা ওয়ানডেই তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তবে দ্রুত বিদায় নিয়েছেন, এমনটা মনে করেন না তিনি। বলেছেন,
নাহ, আমি একদমই আফসোস করি না। আমি অনুশীলন করা উপভোগ করছিলাম না। গত ছয় মাস আমি অনুশীলন করা একদমই উপভোগ করছিলাম না। কিন্তু আমি সবসময় অনুশীলন উপভোগ করে এসেছি, পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে। আমি শতভাগ প্রস্তুতি নিতে পারছিলাম না। আমি যেমন খেলতে চাচ্ছি, ওই রকম পারফর্ম করতে না পারলে খেলা চালিয়ে যেতে চাইনি। আমি আমার সিদ্ধান্তে খুশি। আমি জীবনের পরের অধ্যায় উপভোগ করছি।
ধারাভাষ্যকারের নতুন ভূমিকা উপভোগ করছেন নেইল ও’ব্রায়েন। গত চার-পাঁচ বছর ধরেই ধারাভাষ্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বিপিএলে এসেছিলেন টুর্নামেন্টের মাঝপথে। এক যুগ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা তাকে সাহায্য করছে ধারাভাষ্যকারের দায়িত্বে। তিনি বলেছেন,
এখান থেকে আপনি খেলা নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন, খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়েই আলাপ আলোচনা করতে পারবেন। যখন আপনি মাঠে, তখন আসলে এত বিশ্লেষণ করা যায় না। তখন ওই মুহূর্তেই বাস করেন আপনি, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বল। যখন আপনি ধারাভাষ্য কক্ষে, মাইক্রোফোন হাতে, আপনি দেখতে পাবেন কীভাবে ম্যাচটা বদলাচ্ছে। ম্যাচের মধ্যে থাকলে আপনি প্রতিযোগিতায় আবেগপ্রবণ হতে বাধ্য।
ও’ব্রায়েন ব্রাদারস-জনসনরা জ্বালিয়ে গেছেন আয়ারল্যান্ডের ‘ক্রিকেট প্রদীপ’, যার শিখা বয়ে বেড়াচ্ছে নতুন প্রজন্ম। পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে আয়ারল্যান্ড অচিরেই বিশ্ব ক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলেই বিশ্বাস নেইল ও’ব্রায়েনের।