‘১৯৯৪ সালে শেন ওয়ার্ন যখন প্রথম পাকিস্তান সফরে গেলেন, আব্দুল কাদির ততদিনে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। সেই সফরে কোনো এক ম্যাচের পর কাদিরের বাসায় আমন্ত্রিত ছিলেন ওয়ার্ন। দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডার পর দু’জনেরই যেন কথা ফুরিয়ে গেল। পার্সিয়ান কার্পেটের ওপর মুখোমুখি বসে পদ্মাসনে বসে আছেন কাদির আর ওয়ার্ন; মুখে কোনো কথা নেই। কাদির শুধু বারবার বল ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আর ওয়ার্ন সেটা লুফে নিচ্ছেন। বহুকাল পর সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করে বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক মাইক সেলভি লিখেছিলেন, ‘হঠাৎ মনে হচ্ছিল, বল নয়; ওয়ার্নের হাতে ক্রিকেটের সবচেয়ে সুন্দর শিল্পটি তুলে দিচ্ছিলেন সেদিন কাদির। আফসোস; আজ কাদিরও নেই, ওয়ার্নও নেই।’ – সাদা হাতির যত্ন; দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
ক্রিকেটকে বলা হয় এক শিল্প। আর সেই শিল্পের মধ্যে মহোত্তম শিল্প হলো লেগস্পিন।
যুগে যুগে অল্প কিছু সত্যিকারের লেগস্পিনার এসে মায়ার ছলনায় ভুলিয়েছেন এই ক্রিকেট বিশ্বকে। কিন্তু এই মায়ার শিল্প একবার হারিয়ে যেতে বসেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়াবহ পেস-উত্থান আর লেগস্পিনারদের হারিয়ে যাওয়া মিলিয়ে অনেকেই বলেছিলেন, এই লেগস্পিন শিল্প শেষ হয়ে গেছে। আর সেই সময়ই পৃথিবীতে এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন আব্দুর কাদির। বলা যায়, আধুনিক লেগস্পিনের জনক তিনিই। নিজেকে বলতেন, স্পিনারের ছদ্মবেশে একজন ফাস্ট বোলার। আর তাকে যারা খেলেছেন, তারা বলতেন, সর্বকালের সবচেয়ে মায়াবী ঘাতক।
সেই মায়াবী ‘শিল্পী’ বিদায় নিলেন আমাদের মাঝ থেকে। চলে গেলেন কব্জির জাদুকর আব্দুল কাদির।
১৯৫৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লাহোরে জন্ম আব্দুল কাদিরের। বড় ভাই বাহাদুর ছিলেন একজন লেগস্পিনার। সম্ভবত ভাইকে দেখেই লেগস্পিনার হওয়ার আগ্রহটা তৈরি হয় তার। যাত্রা শুরু করেন ক্লাব ক্রিকেট দিয়ে।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন লাহোর, পাঞ্জাব ও হাবিব ব্যাংকের হয়ে। ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে ইউনাইটেড ব্যাংকের বিপক্ষে হাবিব ব্যাংকের হয়ে হয়েছিল প্রথম শ্রেণীর অভিষেক। অভিষেক ইনিংসেই ৬৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই খেলাটা জয় করতে এসেছেন।
২০৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ৯৬০টি উইকেট তুলে নিয়েছেন। গড় ছিল বিস্ময়কর, ২৩.২৪। ইনিংসে সেরা পারফরম্যান্স ছিল ৫৬ রানে ৯ উইকেট। আর ম্যাচে সেরা ছিল ১০১ রানে ১৩ উইকেট। ৭৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন, আর ২১ বার ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন বিস্ময়কর এই বোলার।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের দারুণ পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো কাদিরের। এটা ছিল ক্রিকেটের জন্য এক নতুন যুগের শুরু। কাদিরের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে পা রাখার ভেতর দিয়ে শেষ হলো ক্রিকেট দুনিয়া নিয়ে তৈরি হওয়া এক আশঙ্কার।
এই শতকের গোড়া থেকে বিকশিত হতে থাকা লেগস্পিন একটা ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলেছিল সত্তরের দশকে এসে। তিরিশের দশকে ছিলেন বিল ও’রাইলি, ক্লারি গ্রিমেট। ষাটের দশক পর্যন্ত সুভাষ গুপ্তে, ষাট থেকে সত্তরের দশকের শেষদিক অব্দি চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখরের বিদায়ের পর এই আশঙ্কাটা একবার তৈরি হয়েছিল। লেগস্পিনারদের ফুরিয়ে যাওয়া এবং ক্যারিবীয় পেসারদের অসামান্য উত্থান দেখে এই সময় অনেকেই রায় দিয়ে ফেলেছিলেন, আর কখনোই হয়তো ক্রিকেট মাঠে দেখা যাবে না লেগ স্পিনারের কবজির জাদু।
কিন্তু সব কল্পনাকে মিথ্যে করে দিয়ে সত্তর দশকের শেষদিকেই, পেসারদের দুনিয়াতেই লেগ স্পিনের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিলেন আবদুল কাদির। আবার মাঠে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই জাদু, ক্ল্যাসিক টার্ন আর গুগলি!
কাদিরের হাত ধরে যে মৃত লেগস্পিন জেগে উঠেছিল, পরের দু’দশকে সেটা শিল্প থেকে ত্রাসে পরিণত করেছিলেন মুশতাক আহমেদ ও শেন ওয়ার্ন, তর্কসাপেক্ষে অনিল কুম্বলেও।
খোদ শেন ওয়ার্ন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছেন, মহোত্তম এই লেগ স্পিনারের কারণেই তারা, মানে পরের প্রজন্মের বোলাররা লেগস্পিনে আগ্রহটা টের পেয়েছিলেন। কাদিরের কারণেই আজকের ইমরান তাহির, রশিদ খানরা বল করে যাওয়ার ধারাবাহিকতাটা পেয়েছেন।
কাদিরের অবশ্যই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই লেগস্পিন শিল্পের পুনর্জন্ম ঘটানো। কিন্তু একজন কার্যকর বোলার হিসেবেও তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরাদের একজন। রিচি বেনো তার সর্বকালের সেরা টেস্ট একাদশে রেখেছিলেন এই কাদিরকে। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ বলেছিলেন,
কাদির ওয়ার্নের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা একজন বোলার।
কাদিরের পুরো ব্যাপারটা ছিল প্রকৃতিপ্রদত্ত ভয়ঙ্কর এক প্রতিভা। এর সাথে দারুণ আগ্রাসন, কারো কারো মতে পেস বোলারদের মতো আক্রমণাত্মক মানসিকতা তাকে ওই সময়ের সবচেয়ে সফল স্পিনারে পরিণত করেছিল।
স্পিনারদের তুলনায় বেশ লম্বা একটা রানআপ ছিল, দুলে দুলে বল করতে আসতেন; কেউ কেউ ‘নাচুনে ত্রাস’ বলেও ডাকত। অস্ত্র ছিল বহুরকম। ক্ল্যাসিক লেগ স্পিনকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে রেখেছিলেন, সাথে দুই ধরনের গুগলি, টপ স্পিন, ফ্লিপার ছিল ভয়ানক। ওভারে ৬টা ভিন্ন ভিন্ন ডেলিভারি প্রায়ই করতেন।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে বিশ্ব মূলত চিনতে শিখল কাদিরকে। এরই মধ্যে অভিষেক সিরিজে দুবার ৫ উইকেট নিয়েছেন এবং লর্ডসে ৬ উইকেট নিয়েছেন। তারপরও কাদিরের বিরূপ কন্ডিশনে নিজেকে প্রমাণের বাকি ছিল।
সেবার অস্ট্রেলিয়া সফরে পরপর দুই ম্যাচে ৭ ও ১১ উইকেট তুলে নিয়ে টানা দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হলেন, ওই সিরিজে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তান প্রথম সিরিজ জিতল কাদিরের ওপর ভর করে। কাদির জাদু অব্যাহত রাখলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও।
১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কাদিরের সেরাটা দেখা গেল। ইংল্যান্ড সবসময়ই এই মায়াবী ঘাতকের সবচেয়ে পছন্দের দল ছিল, এদের পেলেই জ্বলে উঠতেন। কেনিংটন ওভালে কাদিরের আরেকটি ১০ উইকেট শিকারে পাকিস্তান আরেকটি সিরিজ জিতল।
তবে সেরাটা এলো এর মাস তিনেক পর ঘরের মাটিতে। ওই সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৩৭ রানে ৩০ উইকেট তুলে নিলেন। এটাই ছিল এক সিরিজে কাদিরের সেরা পারফরম্যান্স। এর মধ্যে ৫৬ রানে ৯ উইকেট নিলেন হোম গ্রাউন্ড গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে।
১৯৯০ সাল অবধি টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। এই সময়ে ৬৭ টেস্টে ৩২.৮০ গড়ে ২৩৬ উইকেট নিয়েছেন। ১৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন এই কিংবদন্তি।
১৯৮৩ সালে কাদিরের ওয়ানডে অভিষেক হলো। যদিও মনে করা হয় যে, সীমিত ওভারের ক্রিকেট লেগস্পিনারদের জন্য নয়। কিন্তু আজকের রশিদ খানদের জন্য কাদিরই পথ তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই ফরম্যাটেও সফল বোলার ছিলেন তিনি। ১২ ওভারে ২১ রান নিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটে। ১০৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২৬.১৬ গড়ে ১৩২টি উইকেট নিয়েছেন। এর মধ্যে দুবার ৫ উইকেট নিয়েছেন এক ম্যাচে।
খুব সামান্য সময় পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। অধিনায়ক হিসেবে সফল ছিলেন না তেমন। ৫টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে ৪টিতেই দলের পরাজয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন। ওয়ানডেতেও একটা এশিয়া কাপে অধিনায়কত্ব করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, অধিনায়ক কাদিরের দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলও একটা ম্যাচ খেলেছিল।
অবসর নেওয়ার পরও নানাভাবে ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক হিসেবে মনোনীত হন। শোনা যায়, কর্মকর্তাদের সাথে তার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। ২০০৯ সালে কোনো কারণ না দেখিয়েই পদত্যাগ করেছিলেন।
কোনো পদে না থাকলেও আজকের ইমরান তাহিরদের কাছে তিনি ছিলেন এক আলোক মশাল। সুযোগ পেলেই তারা ছুটে গিয়েছেন এই মহীরূহের কাছে। নিজের জ্ঞানটা ছড়িয়ে দিতে কখনোই কার্পণ্য করেননি কাদির।
এই ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বুকে ব্যথা বোধ করায় রওনা দিয়েছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু পথেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে চলে যান এই সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলার।
কাদির চলে গেলেন, কিন্তু আলো তিনি অন্ধকারে জ্বেলেছিলেন, তা আজ মশাল হয়ে ঘুরছে বিভিন্ন হাতে। লেগ স্পিন যতদিন থাকবে, কাদিরের নামটাও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।