এককথায় বলে যায়, একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। একজন কোচ পাওয়া নিয়ে কত কিছু হলো। আমাজনে অভিযানের মতো অ্যাডভেঞ্চারও হলো। সেই এডভেঞ্চারে যোগ দিল ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ও ক্রিকেটপ্রেমীরা। তারপরও হলো না।
শেষমেষ এক বিদেশি এসে যেন বলে দিলেন, “এ আর এমন কী!“। কোচ খোঁজা তো পানি-ভাত! সেই বিদেশি হলেন গ্যারি কারস্টেন। সত্যিই কোচ খুঁজে দিয়ে ব্যাপারটিকে ‘পানিভাত’ করে ফেললেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানো এই কোচ। আর যাকে আনা হলো, তিনি হলেন স্টিভ রোডস। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার। বর্তমানে কাজ করছিলেন ইংলিশ কাউন্টি দল উস্টারশায়ারের কোচ হিসেবে। জাতীয় দল বলতে ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফ ছিলেন। সেই দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশেও সফর করেছেন। কিন্তু জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে এবারই প্রথম সুযোগ পাওয়া।
কতটা পারবেন রোডস? তিন ফরম্যাটেই ‘প্রায়’ দারুণ সময় কাটাতে থাকা বাংলাদেশ দলের বর্তমানে যে খানিকটা ধস নামা অবস্থা, সেখান থেকে আবারও আগের জায়গায় ফেরাতে ইংলিশ রোডসের ‘রোড টু কারিশমা’ কাজে দেবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সবকিছুর জন্য তার হাতে সুযোগ ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। প্রথমবারের মতো এমন মিশন শুরু করে স্টিভ রোডস নিজেও হয়তো চাইবেন তার ক্যারিয়ারকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে। সেটার বাস্তবায়ন করতে হলে তাকে ‘মিশন বাংলাদেশ’ পাস করাই লাগবে। তার সঙ্গী মাশরাফি বিন মুর্তজা থেকে শুরু করে উইন্ডিজ সফরে নতুন যে ছেলেটা ক্রিকেটার হিসেবে জাতীয় দলে ডাক পাবেন তিনিও।
১.
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর সেখান থেকেই যখন চান্দিকা হাতুরুসিংহে নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব ছাড়লেন, তখন বেশ বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু বিতর্ক হোক আর যা-ই হোক, শ্রীলঙ্কান কোচ হাতুরুসিংহেকে ফেরানোর সবরকমের চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কিন্তু তাতে হাতুরুসিংহের পাষাণ মন গলেনি। তিনি তার কাঙ্খিত দল শ্রীলংকা অর্থাৎ, নিজের দেশের হেডকোচের দায়িত্ব নিলেন। তারপর ৮ মাস কেটে গেল। এই সময়ের মধ্যে রিচার্ড পাইবাস-ফিল সিমন্স বাংলাদেশে এসেছিলেন কোচ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। বিসিবির কাছে সাক্ষাতকারও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকেই নিয়োগ দেয়নি বিসিবি।
জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক কিংবদন্তি অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলকেও কোচের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল বিসিবি। কিন্তু ইংল্যান্ডের দায়িত্ব ছেড়ে আসেননি ক্যাম্পবেল। ভিতরে ভিতরে আরও অনেককেই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। যে গ্যারি কারস্টেন কোচ খোঁজার জন্য এসেছিলেন, তাকেও কোচ হিসেবে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনিও রাজি হননি। পরে তাকে ক্রিকেট পরামর্শক হিসেবে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) নিজের দলের মিশন শেষ হওয়ার পর ঢাকা এসে কোচের বড় তালিকা করেছিলেন কারস্টেন। যদিও তিনি নতুন মন্ত্র দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের তিন কোচের কথা। নতুন এই ধারণার প্রশংসা করলেও শেষপর্যন্ত বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে বিসিবি। তারা কারস্টেনকে জানায়, তাদের এখন কেবল একজন হেডকোচই দরকার।
সেখান থেকেই উঠে আসা স্টিভ রোডসের। ইংলিশ এই কোচের নাম কারস্টেন-বিসিবি দু’পক্ষের পছন্দের তালিকাতেই ছিল। রোডস নিজেও আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলাফল, দুইয়ে মিলে যেতেই বাংলাদেশে সাক্ষাতকারের জন্য ডেকে পাঠানো হলো স্টিভ রোডসকে। তিনি এলেন, সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বেক্সিমকোর কর্মক্ষেত্রে সাক্ষাতকার দিলেন, পছন্দ হলো সবার, সেদিনই নিয়োগ পেলেন।
সাক্ষাৎকার শেষে সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন জানিয়ে দিলেন, রোডসকে আগামী ২০২০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের সঙ্গে চুক্তি করানো হচ্ছে। মূলত, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে সেই ভাবনা থেকে এটাও মাথায় রাখা হচ্ছে যে রোডস একজন ইংলিশ কোচ। তাই তিনি ইংল্যান্ডের কন্ডিশন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন।
২.
প্রথমবারের মতো কোনো জাতীয় দলের প্রধান কোচের পদ পেয়েছেন রোডস। অন্য সময় হলে হয়তো বাংলাদেশ বলে নাক সিটকাতেন অনেকেই। কিন্তু ২০১৪ সালের নভেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেই সুযোগ আর নেই। বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স, তিন ফরম্যাটেই তাদের প্রতিনিয়ত নিজেদেরকেই ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা অনেক বিদেশি কোচকেই মাশরাফি-সাকিবদের কোচ হতে চাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করেছে। রোডসও সুযোগ পেয়ে আনন্দিত।
তবে শুধু ক্রিকেট দলের চাপ নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল সমর্থকরাও যে অনেকটাই আবেগাপ্লুত, সে কথা অজানা নেই রোডসের। সেসবের মন্ত্র নিয়েই আসছেন তিনি। যদিও উস্টারশায়ারে তার দলে বাংলাদেশের সাকিব খেলেছেন। তখনই হয়তো অনেকটা টের পেয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্ক। যখন ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফ হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, তখনও টের পেয়েছেন।
সাক্ষাৎকার শেষে তাই নিয়োগ নিশ্চিত হতেই সংবাদ সম্মেলনে বললেন, “আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে কতটা গর্বিত, সে কথা আগে বলতে চাই। দারুণ একটা ক্রিকেটপাগল জাতি বাংলাদেশের মানুষ। এই সমর্থনগুলো বাংলাদেশ দলকে অনেকখানি এগিয়ে নেয়। কখনও বা এই সমর্থনই হতাশ করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বোর্ড থেকে পাওয়া এমন দায়িত্বে আমি খুব গর্ববোধ করছি। এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের।“
গ্যারি কারস্টেন ও বিসিবি; দুই জায়গার তালিকাতেই রোডসের নাম ছিল, এ কথাটা অবশ্য তিনি জানতেন না। যখন জেনেছেন তিনি খুশি হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে আমার সাথে নিজামের (বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন) সাথে কথা হয়েছে। গ্যারি কারস্টেন আমার নাম বলেছেন তা শুনে ভালো লাগছে। যখন প্রস্তাব পেয়েছি, অবশ্যই সাথে সাথে রাজি হয়েছি। এমন একটা দেশের জাতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবা যায় না।“
২০২০ সাল পর্যন্ত চুক্তি রোডসের সঙ্গে। এই সময়ের মধ্যে একটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। স্টিভ রোডসের লক্ষ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে যাওয়া।
রোডস বলেছেন, “আমি বোর্ড সভাপতিকে (বিসিবি) বলেছি বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অনেক ভালো করেছে। সেটাও ইংল্যান্ডেই। ছেলেরা প্রমাণ করেছে তারা ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে ভালো করতে পারে। সেমিফাইনালে জায়গা করাটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আমরা যদি এবারের বিশ্বকাপে ততটা করতে পারি, আমি এটুকু বলতে পারি, আমি স্বপ্ন দেখছি বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশ খেলবে।“
৩.
দল হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা নেই রোডসের। কিন্তু তার কাজটা এখন অনেকটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাপারগুলোকে সযত্নে গুছিয়ে আনা। চ্যালেঞ্জটা সেভাবেই নিতে চাইছেন রোডস। তবে তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে হাতুরুসিংহের সাফল্য। ২০১৮ সাল থেকে ৪ বছর বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন করা এই শ্রীলঙ্কান এখন পর্যন্ত যত কোচ বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করেছেন তার মধ্যে পরিসংখ্যানের হিসেবে সবচেয়ে সফল।
২০১৪ সালের মে মাস থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত হাতুরুসিংহের অধীনে বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ১৭টি। জিতেছে ৫টি, হার ৮ ম্যাচে। ড্র হয়েছে ৪ ম্যাচে। ওয়ানডে খেলেছে ৫১টি। জয় ২৩ ম্যাচে। টি-টোয়েন্টিতে ২৯ ম্যাচের ১০টিতে জয়। হাতুরুসিংহের অধীনেই ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জেতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ড্র, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সুযোগ পাওয়া এবং ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সরাসরি জায়গা পাওয়া; সবই হয়েছে হাতুরুসিংহের হাত ধরে।
বিশেষ করে কিছু ব্যাপার তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সবার আগে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে তার মধ্যে। গেল বছরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে হোয়াইটওয়াশ হওয়া, চলতি বছরের শুরুতে নিদাহাস ট্রফিতে ফাইনালে হার, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হোয়াইটওয়াশ হওয়া; এগুলো থেকে দ্রুত বাংলাদেশকে বের করে আনতে গিয়ে খানিকটা হলেও চাপে পড়তে পারেন রোডস। তাছাড়া মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ- এই পাঁচজনের বাইরে নতুন ক্রিকেটারদের বাজে পারফর্মেন্সও ভোগাবে তাকে।
দ্বিতীয়ত, অধিক পরিমাণে বিদেশ সফর। আফগানিস্তান সিরিজ দিয়ে শুরু হয়েছে। রোডসের ২০২০ সালের চুক্তি পর্যন্ত বিদেশেই বাংলাদেশের ম্যাচ বেশি। অন্যদিকে, বিদেশের চেয়ে দেশেই সাফল্যের হার বেশি লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। সে কারণে এগুলোও বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে স্টিভ রোডসের জন্য।
এছাড়া কেবল ওয়ানডেতে ভালো করতে থাকা দলকে অন্য দুই ফরম্যাটে আরও ভালো করানো, বর্তমান বোর্ডের অদৃশ্য চাপ, সমর্থকদের চাপ, তরুণ ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্সের ঘাটতি- সবকিছুই ভোগাবে স্টিভ রোডসকে।
শেষপর্যন্ত এসবের মধ্যে দিয়ে বের হয়েও চান্দিকা হাতুরুসিংহের উত্তরসূরি হিসেবে নিজে কতটা পথ খুঁজে পাবেন, আর বাংলাদেশ দলকে তাদের প্রত্যাশার পথকে কতটা প্রসারিত করতে পারবেন সেটাই এখন বাস্তব করার বিষয়। সেই পথের শুরু হবে জুলাইতে, উইন্ডিজ সফরের মধ্য দিয়ে।
ফিচার ইমেজ- Cricbuzz