প্রতিভাবান এক ফুটবলার সম্বন্ধে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বর্ণনা করেছিলেন, “আমাদের সাইন করা যেকোনো তরুণ তারকার মতোই সহজাত প্রতিভা।“ এমনকি ফার্গুসনের কাছে তরুণ প্রতিভার বিচারে রুনি, গিগস ও ফার্ডিনান্ডের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন তিনি। খোদ ফার্ডিনান্ডও এই প্রতিভার বর্ণনায় বলেছিলেন, তার দেখা তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে সহজাত প্রতিভার অধিকারী। “ম্যাচ তো বটেই, এমনকি আমি তার প্রশিক্ষণ দেখতেও খরচ করতে চাইব।“
কিংবদন্তি ফার্গুসন ও ফার্ডিনান্ডের এরকম প্রশংসা বানী শুনে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, হয়তো কিংবদন্তীতুল্য কোন ফুটবলার বা বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা কোনো খেলোয়াড়ের কথা বলা হচ্ছে। না, আসলে প্রশংসার সব ফুলঝুরি প্রতিভার নিদারুণ অপচয় র্যাভেল মরিসনের জন্য, যিনি ছিলেন ইউনাইটেডের সেরা তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের একজন। অনেকেই হয়তো এই নাম প্রথমবারের মতো শুনলেন, কিন্তু জেনে রাখুন, এজন্য দায়ী খোদ মরিসন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন, কম-বেশি ঝামেলা পাকিয়েছেন, সেই সাথে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার।
২০০১-২০১২
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমিতে মরিসনকে অন্যতম সেরা প্রতিভা বিবেচনা করা হত, এটা তো আগেই বলা হয়েছে। প্রতিভার দরুন মাত্র ১৫ বছর বয়সেই এফএ ইয়ুথ কাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর মাত্র ১৭ বছর বয়সেই মূল দলের হয়ে অভিষেক হয়, ২০১০/১১ মৌসুমে লিগ কাপে ওলভসের বিপক্ষে বদলি হিসেবে নামেন। প্রায় ১২ মাস পর আবারও একই লিগ কাপে খেলেছিলেন ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে। যে মরিসনকে নিয়ে ফার্গুসন এত উচ্ছ্বসিত ছিলেন, সেই মরিসনকেই ইউনাইটেড থেকে বিদায় করে দিতে বাধ্য হন তিনি। কারণ, মাঠের প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রতিফলনের আগেই মাঠের বাইরে ঝামেলা বাঁধাতে শুরু করে দিয়েছিলেন মরিসন। ফলাফল যে সুখকর হয়নি, তা বলা বাহুল্য। নিজের প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র দুই দিন পরেই গ্রেফতার হয়েছিলেন এই খেলোয়াড় এবং সাক্ষীকে ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য ২০১১ সালে দোষী সাব্যস্তও করা হয়েছিল তাকে। বয়স কম থাকায় সমস্যা অল্পতে মিটলেও ওল্ড ট্রাফোর্ডে বিদায় ঘণ্টার শুরু অনেকটা তখন থেকেই।
চুক্তির ছয় মাস বাকি থাকলেও, তা আর নবায়ন করা হয়নি এবং ২০১২ সালের শীতকালীন দলবদলে মরিসনের জন্য নিউ ক্যাসলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ইউনাইটেড। ফার্গুসন বলেছিলেন, “আমরা তাকে প্রস্তাব করেছিলাম, কিন্তু সে তা ফিরিয়ে দেয়। তার দাবি ছিল অবাস্তব এবং তার এজেন্টও কঠোর পরিশ্রম করছিল নতুন কোনো ক্লাবে চুক্তি করতে।“ মরিসন অবশ্য চুক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছিলেন। অবশেষে একই বছরের দলবদলের শেষ মুহূর্তে তৎকালীন চ্যাম্পিয়নশিপের দল ওয়েস্ট হ্যামের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় তাকে। ফার্গুসন অবশ্য হ্যামারের কোচ স্যাম অ্যালারডাইসকে বলে দিয়েছিলেন, মাঠের বাইরের সমস্যা এড়িয়ে চলতে পারলে মরিসন একজন অসাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে। কিন্তু, এই মাঠের বাইরের সমস্যা থেকেই দূরে থাকা হয়নি খুব একটা।
২০১২-২০১৫
ওয়েস্ট হ্যামের হয়ে মৌসুম শুরু করার পূর্বেই মরিসন জড়িয়ে পড়েন নতুন বিতর্কে। টুইটারে সমকামী-ভীতি মন্তব্যের জের ধরে এফএ তাকে ৭,০০০ ইউরো জরিমানা করে! ২০১২/১৩ মৌসুমেই তাকে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বার্মিংহ্যাম সিটিতে, যাতে তিনি সহজাত ফুটবলের ছন্দ ও অধরা শৃঙ্খলা খুঁজে পান এই আশায়। প্রথম দুই মাসে অবশ্য তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি এবং তার আচরণগত সমস্যায় বিরক্ত ছিলেন ক্লাবের কোচ ক্লার্ক। কিন্তু, এরপরই দারুণভাবে ফর্মে ফেরেন তিনি। তার পার্ফরম্যান্সের দরুন আরও এক বছর বার্মিংহ্যামে তাকে রাখতে চেয়েছিলেন ক্লার্ক। ২০১৩/১৪ মৌসুমেই ওয়েস্ট হ্যামের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। শুরুটা করেছিলেন এককথায় দুর্দান্তভাবে। মৌসুমের প্রথমার্ধেই সব প্রতিযোগিতায় আক্রমণাত্মক এই মিডফিল্ডার ৫ গোল করেছিলেন। এই মৌসুমে টটেনহ্যামের সাথে একক প্রচেষ্টার গোলটিতেই তার অসাধারণ প্রতিভার ছোঁয়া পাওয়া গিয়েছিল। অবাক হলেও সত্যি, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলে তার জায়গা পাওয়া নিয়ে কথাও হচ্ছিল মিডিয়াতে। ইংল্যান্ডের অনুর্ধ্ব-২১ দলে অবশ্য খেলেছিলেন তিনি, কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে আর মাঠে নামা হয়নি তার।
মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধেই এজেন্ট সংক্রান্ত ঝামেলায় আবারও খানিকটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই সাথে আবারও লোনে পাড়ি জমাতে হয় কুইনস পার্ক রেঞ্জার্সে। রেঞ্জার্সে সময়টা বেশ ভালো কেটেছিল মরিসনের, খেলছিলেন দারুণ ফুটবলও। এই দলটির হয়ে ৬ গোল করে প্লে-অফের মাধ্যমে লিগে জায়গা করে নিতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। এরপর, সেপ্টেম্বরে আবার ফিরে আসেন ওয়েস্ট হ্যামে। তখন তার সম্পর্কে অ্যালারডাইস বলেছিলেন, “এমন নয় যে, ফুটবলার হিসেবে আমাকে তার মুগ্ধ করতে হবে। আমরা ওর প্রতিভা সম্বন্ধে অবগত। প্রতিভা দিয়ে খেলা এবং জীবনে স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, র্যাভের এটাই প্রয়োজন। যদি এরকম হয়, তাহলে আমরা ওকে চাই এখানে।“
দুঃখজনক হলেও সত্যি, এরকম কিছুই হয়নি। পরের মাসেই লোনে কার্ডিফ সিটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মরিসনকে এবং সেখানেও মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। ওয়েস্ট হ্যামে ফিরে আসার পূর্বেই, দলবদলের তালিকায় নাম উঠে যায় তার। মরিসনকে নিয়ে হ্যামার কোচ অ্যালারডাইস আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “যাদের সাথে কাজ করেছি, তাদের মধ্যে প্রতিভার সবচেয়ে বড় অপচয়।“
২০১৫-২০১৯
ততদিনে বলতে গেলে বোহেমিয়ান জীবন হয়ে গেছে এই ইংলিশ ফুটবলারের। ইংল্যান্ডের পাট চুকিয়ে এবার ইতালিতে। লাৎসিওতে যোগ দেওয়া প্রথম ইংলিশ খেলোয়াড় ছিলেন মরিসন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ইতালিয়ান এই ক্লাবটির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ক্লাবটির হয়ে কোনো ম্যাচে মাঠে নামার আগেই বিতর্কের মাঠে ঠিকই নেমে পড়েছিলেন তিনি। তখন এমনও শোনা যাচ্ছিল যে, কোনো ম্যাচ না খেললেও তাকে কুইনস পার্ক রেঞ্জার্সকে প্রস্তাব করা হয় মরিসনের জন্য। আচরণগত সমস্যায় জর্জরিত মরিসন রোমে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। কোচের পরামর্শ অনুযায়ী ইতালিয়ান ভাষা শিখতে অপারগতা প্রকাশ থেকেই হয়তো শুরু।
এরপর কোচ স্টেফানো পিওলি অভিযোগ করেন- ‘দলের জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে’। কোচের রোষানলের কারণে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মাত্র ৮ ম্যাচ খেলার পর ২০১৭ সালে তাকে সত্যিই লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রেঞ্জার্সে। লন্ডনে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ক্লাবটির যদিও সুযোগ ছিল মরিসনকে কিনে নেওয়ার, কিন্তু সেই শৃঙ্খলতাজনিত কারণেই তাকে আর নেওয়ার মতো ভুল করেনি দলটি।
দেশের পর এবার পালা মহাদেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে যাওয়ার। দ্বিতীয়বারের মতো লোনে মরিসন এরপর যোগ দিয়েছিলেন উত্তর আমেরিকার মেক্সিকোর অ্যাটলাস ক্লাবে। মোটামুটি ভালোই খেলেছিলেন সেখানে তিনি। অবশ্য বলার মতো তেমন কোনো পার্ফরম্যান্স নয়। লোন শেষে ২০১৮ সালে লাৎসিওতে ফিরলে ক্লাবটির হয়ে আর কোনো ম্যাচ খেলা হয়নি তার।
শেষ পর্যন্ত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে লাৎসিও থেকে তাকে কিনে নেয় সুইডেনের ক্লাব অস্টেসুনস। ইউনাইটেডে মূল দলে অভিষেক হওয়ার পর, ৯ বছরে ২টি মহাদেশের ভিন্ন ৪টি দেশের ৮টি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন এই প্রতিভাবান। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ এই খেলোয়াড় কিংবা ভাগ্য তার সহায় হয়নি। এতদিনে মাত্র ১৩৩টির মতো ম্যাচ খেলতে পেরেছেন তিনি, যেখানে তার বয়স ২৬ ইতোমধ্যে।
ইংলিশ এই খেলোয়াড়ের সামনে বলতে গেলে ইতিবাচক মনোভাবের সাথে শৃঙ্খলার সাথে প্রতিভার প্রতিফলন ঘটে এমন পার্ফরম্যান্স ব্যতীত ভিন্ন কোন পথ আর খোলা নেই। এখনই সময় নিজেকে প্রমাণ করার। তিনি নিজেও এখানে তার ক্যারিয়ার পুনরায় গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। “আমি এখানে এসেছি নিজেকে গড়ে তুলতে। এখানে উপভোগ করতে চাই এবং আবার ফুটবল উপভোগের সাথে আমরা সম্ভাব্য সব জিততে চাই,” বলছিলেন মরিসন। নতুন লক্ষ্যের প্রত্যয়ে তিনি আরও যোগ করেন, “আমি ম্যানচেস্টার থেকে আসা নম্র এক তরুণ। আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করব এখানে।” সর্বোচ্চ পরিশ্রমের সহায় ভাগ্য সহায় থাকলে সম্ভবত তার প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ ঝলক আমরা দেখতে পাব। কিন্তু এত বছরে প্রতিভার যে নিদারুণ অপচয় হয়েছে, সেই আক্ষেপ কোনদিন ঘুচবে তা হয়তো এখনই বলা যাচ্ছে না।
অন্তত ফার্গুসনের তো নয়ই। এই কিংবদন্তি তার বইয়ে মরিসনকে নিয়ে আক্ষেপ করেছেন, “দুঃখজনক, গিগস বা রোনালদোর মতো একই ধারার খেলোয়াড়ের কিছু উদাহরণ রয়েছে; যারা অত্যন্ত প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও, শৈশবের কষ্ট ও নিজের ভিতরের দৈত্যকে অবদমিত করার জন্য আবেগ ও মানসিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।“
“র্যাভেল মরিসন এরকম সবচেয়ে দুঃখজনক উদাহরণ। আমাদের সাথে চুক্তি করা যেকোনো তরুণ তারকার মতো সহজাত প্রতিভার অধিকারী ছিল সে। কিন্তু সে ক্রমাগত ঝামেলায় জড়াতেই থাকত।“