ক্রিকেটের রঙ এবং রঙ্গঃ হঠাৎ উধাও খেলোয়াড়দের গল্প

ক্রিকেট অদ্ভুত এক খেলা! কখনো সেটা হাসায়, কখনো কাঁদায়, কখনো আবার কপাল কুঁচকানো সব ঘটনার জন্ম দেয়। সেসব ঘটনাপ্রবাহের কতকগুলো নিয়েই শুরু করতে যাচ্ছি নতুন একটা সিরিজ, ‘ক্রিকেটের রঙ এবং রঙ্গ‘। এখানে থাকবে মজার কিছু গল্প, কিছু অদ্ভুত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, আবার থাকবে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিবরণ। তারই প্রথম কিস্তি হিসেবে আজ থাকছে ‘হঠাৎ উধাও খেলোয়াড়দের গল্প’

ক্রিকেট ইতিহাসে বেশ কয়েকবার এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ম্যাচ শুরু হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ ক্যাপ্টেনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানে ব্যাপারটা এমন নয় যে তিনি হারিয়ে গেছেন, আসলে হুট করে এদিক-সেদিকে চলে গেছেন। এমনকি টস করার পর হুট করে দেশে ফিরে যাওয়ারও অদ্ভুত ঘটনা রয়েছে! শুধু অধিনায়কই নয়, অভিষিক্ত খেলোয়াড়রাও নেহায়েত কম যাননি এদিক থেকে। এদেরই মধ্যে নির্বাচিত কিছু ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি এখানে।

মাইক গ্যাটিং; মেলবোর্ন, ১৯৮৬-৮৭

মাইক গ্যাটিং ©গেটি ইমেজ

১৯৮৬-৮৭ অ্যাশেজ সিরিজ শুরুর প্রাক্কালে মেলবোর্নে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের প্রস্তুতি ম্যাচ। সকালে পুরো দল মাঠে নেমে পড়েছে, একটু পর টস। হঠাৎ ডেভিড গাওয়ার আবিষ্কার করলেন, অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং এখনো মাঠে নামেননি! কিছুটা খোঁজার সাথে সাথেই জানা গেলো, অধিনায়কের এখনো ঘুমই ভাঙেনি! অগত্যা কি আর করা, ডেভিড গাওয়ারকেই আপৎকালীন অধিনায়ক করে টস করতে পাঠানো হলো। পরে গাওয়ার এই দেরি করার শাস্তি হিসেবে মাইক গ্যাটিংকে ফার্স্ট চেঞ্জ বোলার হিসেবে নিয়ে এলেন এক পাশে, আর গ্যাটিংও সেটা যেন লুফে নিলেন! একে একে তুলে নিলেন তিন ব্যাটসম্যানকে, নামগুলোও নেহায়েত অজানা নয়- জেমি সিডন্স, সাইমন ও’ডোনেল, টনি ডোডেমেইড। ইনিংসে গ্যাটিং শেষ করলেন ৩১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে, তবে ইংলিশ মিডিয়ার মুখ তাতে বন্ধ করে রাখতে পারেননি তিনি। এমনকি সেদিন ইংলিশ মিডিয়া গ্যাটিংকে তুলনা করে এডলফ হিটলারের সঙ্গে!

মার্কাস ট্রেসকোথিক; বরোদা, ২০০৫-০৬

মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত এক স্বভাব ছিলো মার্কাস ট্রেসকোথিকের। © গেটি ইমেজ

এবারের ঘটনাটাও ইংল্যান্ডেরই, যেটা ঘটেছিলো ২০০৫-০৬ মৌসুমে ভারত সফরে আসার পর। বরোদায় ‘প্রেসিডেন্টস ইলেভেন’ দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ চলছে, ইতিমধ্যে খেলা শুরুও হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কি মনে হলো, ইংলিশ অধিনায়ক চললেন মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে। কেন? সেটা যদি জানাই যেত, তাহলে তো হতোই! পরে অবশ্য রহস্যজনক এক ভাইরাসজনিত কারণে অসুস্থতার কারণ দেখান তিনি, তবে সেটার সত্যতা যাচাইয়ের বিশেষ সুযোগ ছিলো না।

শুধু সেবারই যদি এই কীর্তি করতেন ট্রেসকোথিক, তাহলেও হতো। এরপর একই কীর্তি আবার করে বসলেন কাউন্টি ক্রিকেটে, ২০০৫ সালের এপ্রিলে সমারসেটের হয়ে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে তিনি রওনা করলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য কারণ জানিয়েই গিয়েছিলেন, মেয়ের জন্মটা পাশ থেকেই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে পরে কমেন্ট্রিতে ফ্রেড ট্রুম্যান বলেছিলেন, “ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে উনি কি বোঝেননি, তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা?” ম্যাচটি পরে ইনিংস ব্যবধানে হারতে হয়েছিলো সমারসেটকে।

লিওনেল লিস্টার; নর্দাম্পটন, ১৯৩৯

দৃষ্টিনন্দন শট খেলার সময় ফ্রেমবন্দী লিওনেল লিস্টার। © গেটি ইমেজ

লিওনেল লিস্টার ছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ারের জনপ্রিয় অপেশাদার অধিনায়ক, মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবেই খেলতেন দলে। ১৯৩৯ সালের আগস্টে নর্দাম্পটনের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নামার জন্য প্যাড পড়ে ড্রেসিংরুমে বসে ছিলেন, যেকোনো মুহুর্তে ব্যাটিং করতে নামবেন তিনি। হঠাৎ তাঁর ডাক এলো টেরিটোরিয়াল রেজিমেন্টের জন্য, আর সাথে সাথে ব্যাট-প্যাড খুলে পুরোদস্তুর সৈনিক বেশে একটু পরই ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন! কোচ কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন বটে, তবে সেভাবে কিছু বলে ওঠার সুযোগই দেননি লিস্টার। ফলে ওই ম্যাচে তাঁর নামের পাশে লেখা হলো ‘লিস্টার অ্যাবসেন্ট… ০’, যেটা কিনা পুরো ক্রিকেট ইতিহাসেই অত্যন্ত বিরল! সেটা ছিলো লিস্টারের ২২ ইনিংসের ক্যারিয়ারে অষ্টম শুন্য, এরপর আর কোনো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেননি তিনি।

রুনাকো মর্টন; শ্রীলংকা, ২০০২

অদ্ভুত এক কান্ড করে বসায় ‘সেনসিটিভ ফ্যামিলি-ম্যান’ ইমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো রুনাকো মর্টনের। © গেটি ইমেজ

এবার আর অধিনায়ক নয়, বরং সাধারণ খেলোয়াড়দের দিকে আসা যাক। রুনাকো মর্টন ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারকুটে টেস্ট ওপেনার, নিয়মিতই ছিলেন বেশ। তবে ২০০২ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি চলাকালীন সময়ে হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটিয়ে বসেন তিনি।

একটি ম্যাচ চলাকালীন সময়ে হঠাৎ মর্টন কোনোভাবে খবর পেলেন, তাঁর দাদী মারা গেছেন। দাদীর মৃত্যুশোকে অধীর হয়ে মর্টন বিন্দুমাত্র দেরি না করেই সঙ্গে সঙ্গে রওনা করেন বাড়ির উদ্দেশ্যে, যদি দাদীর অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেন! কিন্তু এরপর বাড়িতে পৌঁছে তিনি যেটা দেখতে পেলেন, সেটা দেখেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা মর্টনের।

জানা গেল, মর্টনের দাদী একজন মারা গেছেন ১৬ বছর আগেই, আর অন্যজন এখনো বহাল তবিয়তে দিব্যি বেঁচে আছেন অ্যান্টিগাতে! বিরক্ত এবং অসন্তুষ্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড এই ঘটনার জেরে মর্টনকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। তাঁর ‘সেনসিটিভ ফ্যামিলি-ম্যান’ রূপটা আবারও বেরিয়ে আসে, পরে যখন তিনি নিজের চাচাতো ভাইকে নিজেই ছুরিকাঘাতে আহত করেন।

ইয়ান পীবলস; দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯২৭-২৮

ইয়ান পীবলস। © গেটি ইমেজ

১৯২৭ সালে ১৯ বছর বয়সী ইংলিশ লেগ-ব্রেক বোলার ইয়ান পীবলসের অভিষেক হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, আর সে সিরিজেই একটি ট্যুর ম্যাচে এক অদ্ভুত কান্ড করে রীতিমত ইতিহাসে ঢুকে গেছেন তিনি। কনস্ট্যান্টিয়া নামের একটি দলের বিপক্ষে একাদশে ছিলেন পীবলস, ‘এমসিসি একাদশ’ নামে খেলা ইংল্যান্ড দলের ইনিংসটাও বেশ ভালোমতই চলছিলো। ফলে কিছুটা আশ্বস্ত অবস্থাতেই টেলএন্ডার ব্যাটসম্যান পীবলস ভাবলেন, এই ফাঁকে স্থানীয় কিছু ছেলেমেয়ের সাথে গিয়ে একটু নদীতে লাফঝাঁপ করে আসা যাক!

তবে বিপত্তিটা হলো, নদীতে গিয়ে আর সময়ের হিসেবটা ঠিকমত রাখতে পারেননি। এরপর মাঠে যতক্ষণে ফিরলেন, অধিনায়ক রোনাল্ড স্ট্যানিফোর্ড রীতিমত ধুয়ে দিলেন তাঁকে। তবে এত রাগারাগির কোনো মানেই খুঁজে পেলেন না পীবলস, দল তো দিব্যি ভালোভাবেই ইনিংস শেষ করেছে!

পরদিন ‘কেপ টাইমস’ সংবাদপত্রে খেলার পাতা উল্টিয়ে স্কোরকার্ড দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো তাঁর! সেখানে পরিষ্কার হরফে লেখা, “Peebles absent bathing 0”!

জিওফ বয়কট; কলকাতা, ১৯৮১-৮২

জিওফ বয়কট © গেটি ইমেজ

ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য ‘বিখ্যাত’ জিওফ বয়কট ইংলিশ ওপেনার হিসেবেও খুব একটা খারাপ ছিলেন না। কৈশোরে একটি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর অস্ত্রোপচার করে পীহা অপসারণ করার পর থেকে তিনি নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি রকমের সতর্ক হয়ে যান।

১৯৮২ সালে কলকাতা টেস্টে গ্যারি সোবার্সের তৎকালীন রেকর্ড টেস্টে ৮,০৩২ রান অতিক্রম করার পর জিওফ বয়কট কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন, এ কারণে সে অজুহাতে ফিল্ডিং থেকে উঠে যান। কিন্তু এরপর কোনোরকম বিশ্রামের ধার না ধেরে সোজাসুজি গলফ কোর্সে গিয়ে ১৪ হোল গলফ খেলে নেওয়াটাকেই তিনি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলেন, অথচ অন্যদিকে ম্যাচ কিন্তু তখনও চলছিলো! এরপর বয়কট শারীরিক অসুস্থতার জন্য ব্রিটিশ ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নেওয়ার অনুমতি চাইলে ‘গলফ-কান্ডে’ প্রচন্ড বিরক্ত ম্যানেজমেন্ট সোজাসুজি না করে দেয় তাঁকে। ফলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বয়কট সেদিনই সোজা বিমানে চড়ে ফিরে যান দেশে, ম্যাচ শেষ না করেই!

মিডলসেক্স; টানব্রিজ ওয়েলস, ১৯৬৩

মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের লোগো। © গেটি ইমেজ

শেষটা এবার আর ক্রিকেটারদের নয়, একেবারে গোটা দল নিয়েই টানি। ১৯৬৩ সালে টানব্রিজ ওয়েলসে কেন্টের বিপক্ষে ম্যাচে প্রথমদিন শেষে বেশ শক্ত অবস্থানেই ছিলো মিডলসেক্স, ১২১ রানে ৩ উইকেট নিয়ে প্রথমদিন শেষ করেছিলো তাঁরা। বিপত্তি বাধলো দ্বিতীয়দিন খেলা শুরু করার আগে। দেখা গেল, মাঠে মিডলসেক্স দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উপস্থিত আছেন কেবল চারজন! এদের মধ্যে একজন রবার্ট হোয়াইট, যিনি প্রথমদিন শেষে অপরাজিত ছিলেন ; দ্বিতীয়জন সিডনি রাসেল, যিনি এরই মধ্যে আউট হয়ে গিয়েছেন ; আর বাকি দু’জন একাদশেই নেই! ফলে আম্পায়াররা ওখানেই ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়ে কেন্টকে ব্যাটিংয়ে নামিয়ে দেন, কোনোমতে জোড়াতালি মেরে মিডলসেক্সকে ফিল্ডিংয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়।

দিনের তৃতীয় ওভার শেষ হতে না হতেই এবার পুরো দল একসাথে মাঠে এসে হাজির হয়ে দেখে, খেলা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে! শুধু কি তাই? একটা উইকেটও পড়ে গেছে কেন্টের! বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে থার্ড আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ জানাতেই পুরো কাহিনী পরিষ্কার হয়ে গেলো মিডলসেক্স অধিনায়কের কাছে। এরপর জানা গেলো, গোটা দলটাই একসাথে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়াতেই সময়মত পৌঁছাতে পারেনি তাঁরা। কিন্তু সময়, নদীর স্রোত এবং ক্রিকেটের আম্পায়াররা যে কারো জন্য অপেক্ষা করেন না, সেটা কি আর তাঁদের জানা ছিলো?

 

তথ্যসূত্র

১) http://www.espncricinfo.com/magazine/content/story/258594.html

 

Related Articles

Exit mobile version