মুশফিকুর রহিমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটাই ভুল বোঝাবুঝি দিয়ে। ২০০৫ সালে যখন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করলেন, তখন সমর্থকদের অনেকে মেনে নিতে পারেনি এ ‘কিশোরকে’। কারণটা আর কিছুই না, উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হয়ে দলে ডাক পেয়েছিলেন। তখন আবার খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন না তৎকালীন উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট। যদিও তার অধীনেই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করেন মুশফিক। সবাই যেন ভাবছিল, পাইলটকে সরাতেই নির্বাচকদের এমন ‘ছেলেমানুষি’। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যখন পাইলট রঙিন পোশাকে বাদ পড়লেন, গ্লাভস উঠলো মুশফিকের তালুতে, তখন সেই পরিবর্তনের গায়ে আগুন জ্বালাতে অতি উৎসাহী হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু ইংল্যান্ডে নিজের অভিষেক সফরে এসেক্স ও নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৬৩ ও ১১৫ রানের দুই ইনিংস খেলে জাত চিনিয়েছিলেন।
পরের গল্পটা সবার জানা। নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে নিজের ফ্যানবেজ তৈরি করেছেন এই ক্রিকেটার। কিন্তু বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়ানোর ১৩ বছর পরও তার সাথে ভুল বোঝার সেই প্রথা রয়েই গেছে। আর আবেগী মুশফিক যেন নিজেকে থামাতে গিয়ে বারবার উল্টো রথে হেঁটেছেন। তাতে আরও সমালোচিত হয়েছেন। সেটা কখনো সমর্থকদের কাছে, কখনো গণমাধ্যমে, আবার কখনো নিজের বোর্ডের কাছেও।
তারপরও দিন শেষে মুশফিকের আসনটা পোক্ত। অন্তত ব্যাটিংয়ে তার বিকল্প বাংলাদেশ দলে খুঁজে পাওয়া ভার। সঙ্গে তকমা পেয়েছেন সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার হিসেবে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, তার এই পরিশ্রমও কখনো কখনো তার সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১
যতই পরিণত হয়েছেন, ততই নির্ভার হয়েছেন এবং নির্ভার করেছেন দলকে। পাশাপাশি তার সিদ্ধান্ত, গণমাধ্যমে করা মন্তব্য আর মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচিত হয়েছেন বারবার। ব্যাঙ্গালুরু স্টেডিয়ামে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তার ব্যাটে ভারতকে হারানোর স্বাদ নিতে পারতো বাংলাদেশ। উইকেটে অপর প্রান্তে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মিলেও শেষ পর্যন্ত সেই জয় এনে দিতে পারেননি। মাত্র ১ রান বাকি থাকতেই উইকেটের উপর উদযাপন শুরু করেছিলেন দুজনে। দুর্ভাগ্য, ১ রান তুলতে পারেনি কেউ। ঐ ম্যাচে মুশফিককে একরকম নিন্দার শূলে চড়িয়েছিল সমর্থক থেকে শুরু করে বোর্ড কর্তারা।
সেই দুঃসহ স্মৃতি ফিরতে পারতো নিদাহাস ট্রফিতেও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রেমাদাসা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২১৫ রানের রেকর্ড তাড়া করে জয় পায় বাংলাদেশ। সেটাও মুশফিকের ব্যাটেই। ক্রিকেটে অনেক ব্যাটসম্যানের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, বাউণ্ডারি কিংবা ছয় মেরে জয় নিশ্চিত করা। যে কাজটা করার চেষ্টা করতেন বা করেন মুশফিক। ব্যাঙ্গালুরুতে সেটা করতে গিয়েই সিঙ্গেল নেননি তিনি। এবার আর সেই ভুলের পথে পা বাড়াননি। ৩৫ বলে ৭২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলার শেষ মুহূর্তে এক রান নিয়ে জয় নিশ্চিত করেছিলেন। বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ব্যাট হাতে কতটা পরিণত তিনি।
অবশ্য তখনই তার ‘স্নেক ড্যান্স’ উদযাপন আবারো গড়বড় করে দেয় সবকিছু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে খানিকটা টানাটানি চলে। তাতে কী? দিন শেষে নায়ক তো মুশফিকই! ম্যাচ শেষে গণমাধ্যমের সামনে আসেননি মুশফিক। এসেছিলেন তামিম। শুরুতেই তাই ব্যাঙ্গালুরু প্রসঙ্গ। যে কাজটা সেখানে করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কলম্বোয় তাতে সফল মুশফিক। তামিম ইকবাল সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ব্যাঙ্গালুরুতে মুশফিক যে ভুল করেছিল, প্রেমাদাসা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেটা করেনি। ভালো ম্যাচ কিংবা খারাপ ম্যাচ, সব ম্যাচ থেকেই কিছু না কিছু শেখার থাকে। ব্যাঙ্গালুরুতে মুশফিকের যেভাবে সমালোচনা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি প্রশংসা এখন ও পাচ্ছে। পুরো ম্যাচ দায়িত্ব নিয়ে খেলেছে মুশফিক।”
অথচ, এ ম্যাচে তার ইনিংস দেখে নাকি অবাক হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি দাবি করেছেন, ৩০ বছর বয়সী মুশফিক যে এভাবে চার-ছক্কা মারতে পারে তা তিনি জানেনই না! ব্যাপারটা একরকম হাস্যকরই বটে।
সেই কলম্বোতে বসেই পাপন বলেছেন, “তামিম-সৌম্য মারতে পারে, তা জানি। লিটন মারতে পারে তা জানতাম না। মুশফিককে তো কাল বলেছি, তুমি যে এমন মারতে পার জানতামই না! গত দুই বছর দেখেছি, ছয় মারতে গেলেই সে বাউণ্ডারিতে ক্যাচ হয়! ও মারতে পারে, কিন্তু ছয় মারার খেলোয়াড় সে নয়।” অথচ পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালের চেয়েও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মুশফিকের স্ট্রাইক রেট বেশি। বাংলাদেশের হয়ে ৬৫টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ৫৭ ইনিংসে চার মেরেছেন ৭৫টি, ছক্কা ২৬টি। ১৯.৬৩ গড়ে মোট রান ৯০৩।
২
আলোচনা কিংবা সমালোচনা; মন্তব্যের উত্তর দিতে কখনোই পিছপা হন না মুশফিক। এ নিয়ে কম বিপাকে পড়তে হয়নি তাকে। যদিও সর্বশেষ পাপনের মন্তব্যকে ‘সহজভাবে’ নিতে ‘হয়েছে’ তাকে। কলম্বোয় বলেছেন, “এ ইনিংসের পর হয়তো তিনি (বিসিবি সভাপতি) ভাববেন যে আমি অন্তত পারি। হয়তো তিনি অন্যভাবে আমার খেলা দেখেছেন। গত দুই-তিন মাস ধরে হয়তো ফল আমাদের পক্ষে আসেনি। অনুশীলনে যে কঠোর পরিশ্রম করি, সেটার যখন ফল মেলে, ভালো লাগে। অনুশীলন হয়তো তিনি দেখেননি, তবে ম্যাচে দেখেছেন।”
সত্যিই তাই। মুশফিক বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার। এমনকি সবাই যখন, ছুটিতে থাকে তখন আর কেউ থাকুক আর না থাকুক, মুশফিককে অন্তত ইনডোরে বোলিং মেশিনের সামনেও ব্যাটিং অনুশীলনে পাওয়া যায়। অনেকে তাই পেছনে খোঁচা দেন, অনুশীলনেই যদি সব খেলে ফেলেন মুশফিক তাহলে আর ম্যাচের জন্য কী রাখবেন!
অধিনায়ক ছিলেন মুশফিক। একটা সময়ে পুরো তিন ফরম্যাটেই। এরপর শুধুই টেস্টে। কদিন আগে সেটিও হারিয়েছেন। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাকিব আল হাসানকে। মুশফিক বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কদের একজন। টেস্ট ক্রিকেটে তার অধীনে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে বাংলাদেশ দল। সর্বোচ্চ ৩৪ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়েছেন ৭ ম্যাচ। ড্র করেছেন ৯ ম্যাচে। সেরা সাফল্যের মধ্যে ছিল ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানো। ওয়ানডেতে ক্রিকেটে ৩৭ ম্যাচের ১১টিতে মুশফিকের অধীনে জিতেছে বাংলাদেশ। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২৩ ম্যাচে। জয় এসেছে ৮ ম্যাচে।
৩
ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানটা বাংলাদেশের হিসেবে এককথায় তাক লাগানো। ২০০৬ সালে অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত সাদা পোশাকের টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ৬০টি। ৩৪.৯৬ গড়ে রান তুলেছেন ৩,৬৩৬। ৫টি সেঞ্চুরি ও ১৯টি হাফ সেঞ্চুরি আছে ঝুলিতে। সবচেয়ে বড় কথা, মুশফিক টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান। ওয়ানডেতেও নজর কাড়া পারফরম্যান্স। ১৮৪ ম্যাচে ৩২.৯৯ গড়ে ৪,৭১৮ রান হয়েছে সব মিলিয়ে। সেঞ্চুরি টেস্টের সমান পাঁচটি। হাফ সেঞ্চুরি ২৮টি। টি-টোয়েন্টিতে ১৯.২৩ গড়ে মোট রান তুলেছেন ৯০৩। খেলেছেন ৬৫ ম্যাচ। মুশফিকের ধারাবাহিক ব্যাটিং পারফরম্যান্সের জন্য ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তার নাম দিয়েছেন ‘রান মেশিন’।
কিন্তু শুধু পরিসংখ্যান কিংবা মাঠের পারফরম্যান্স নয়, অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শেষ দুই বছরে বারবার বিতর্কিত হয়েছেন। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে উল্টো বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, তাতেই গণমাধ্যম ও বিশেষত বোর্ড সভাপতির তোপের মুখে পড়েছেন। গেল বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দুই টেস্টেই টসে জিতে ব্লুমফন্টেইন-পচেফস্ট্রুমে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন। অথচ ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল যৌক্তিক। তার এমন সিদ্ধান্ত তুমুল সমালোচিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনেই তোলে ৪২৮ রান। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মুশফিক বলেন, “এখন তো দেখি টসে জেতাটাই ভুল হয়ে গেছে।”
মুশফিক আরো বলেছিলেন, “ম্যাচ জিতলে কৃতিত্ব যায় টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে। হারলে দোষ হয় অধিনায়কের।”
চট্টগ্রাম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অধিনায়ক হয়েও বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করেছিলেন মুশফিক। এ অবস্থা নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের দিকে আঙুল তোলার আগে মুশফিককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে কোচের নির্দেশ ছিল! মুশফিকের এসব মন্তব্য ভালোভাবে নেননি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তার কথায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “সে কোথায় ফিল্ডিং করবে সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। টিম ম্যানেজমেন্ট বা কোচের ছিল না। কেউ তাকে চাপিয়ে দেয়নি।”
দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের প্রসঙ্গে সে সময়ে গুঞ্জন উঠেছিল অধিনায়কত্ব হারাতে পারেন মুশফিক। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে তা একরকম নিশ্চিত হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ২০১৮ সালে, ত্রিদেশীয় সিরিজের আগমুহূর্তে। এ সময়ের আগে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি একবারও। বরং বলেছিলেন, “গণমাধ্যমে কথা বলা শিখছি”।
আপাতত অধিনায়ক নন তিনি। নেই সাবেক কোচ চান্ডিকা হাতুরুসিংহের ছড়ি ঘোরানো পরিবেশ। বোর্ড কর্তার বুলি কিংবা গণমাধ্যমে সমালোচনা আপন করে নিয়েছেন মুশফিক। বাংলাদেশের ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ হয়ে ব্যাট হাতে সামনের পথগুলো আরও মসৃণ করার প্রত্যয়ে এগোচ্ছেন। বড্ড অভিমানী মুশফিক, আবেগী আর একজন সন্তানের বাবা। তবে নিজের যুদ্ধের লড়াইটা অন্তত ভালো বোঝেন।
ফিচার ইমেজ: The Quint