১.
ক্রিকেট নিয়ে যারা ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তাদের এই বিষয়টা জানা থাকার কথা যে সাধারণত যারা ব্যাটিং এ ওপেন করেন তাদের নতুন বলে ভালো খেলতে পারাটা জরুরী। নতুন বলে ফাস্ট বোলাররা কিছুটা সুবিধা পান। সুইং, বাউন্স, গতি – এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে যখন গতিদানবরা পিচে ঝড় তোলেন, তখন ব্যাটসম্যানদের টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে যায়। এই সময়ের ব্যাটসম্যানদেরকে তাই আক্রমণ করার আগে উইকেট টিকিয়ে রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হয়।
বিপরীত অবস্থা আবার লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। খুব অস্বাভাবিক কিছু না হলে তারা হাতে পায় শেষ দশ-পনেরো ওভার। পুরনো বলে স্পিনটা ভালো হওয়ার কারণে এই সময়টাতে স্পিনারদের সামলে চলতে হয়। তাছাড়া ফাস্ট বোলাররা এই সময়ে গতি নিয়ে খুব বেশি কাজ না করে রিভার্স সুইং এবং ভ্যারিয়েশনের এর দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। কাজেই, এই সময়ের ব্যাটসম্যানদেরকে মূলত পুরনো বলে দক্ষ হওয়ার সাথে সাথে রানের চাকাও সচল রাখতে হয়।
সাধারণত একটা দলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যাটসম্যানকে ব্যাট করতে হয় মিডল অর্ডারে, বিশেষ করে ৩-৫ নং পজিশনে। খুব দ্রুত উইকেট পড়ে গেলে এদেরকে মাঠে নেমে নতুন বলের মুখোমুখি হতে হয়, আবার ওপেনিং ব্যাটসম্যানরা টিকে গেলে শেষের দিকে নেমে পুরনো বলের কারুকার্য সামলে সময়ের দাবি মিটিয়ে রান তুলতে হয়। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা তাই দলের মেরুদণ্ড, এদেরকে তাই টেকনিক্যালি একটু শক্তপোক্ত হতে হয় এবং পারফরম্যান্সটাও ধারাবাহিক হতে হয়। বেশিরভাগ দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানরা সচরাচর মিডল অর্ডারেই ব্যাটিং করে থাকেন।
তবে কোন দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান যদি টানা ৪১ টি ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের দেখা না পান, এই ৪১ টি ইনিংসের মাঝে পাঁচটিই যদি শূন্য রানের হয় (যার মধ্যে টানা তিন ইনিংসে শূন্যও রয়েছে), তাহলে সেই দলের অবস্থা জঘন্যই হওয়ার কথা। হ্যাঁ, একটা সময় বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ের অবস্থা মোটামুটি জঘন্যই ছিল। তিনি যদিও সেই মূহুর্তে দলের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন না, তবে সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যানদের সারিতেই ছিলেন।
সেই ব্যাটসম্যানটার নাম হচ্ছে মুশফিকুর রহিম।
২.
বাংলাদেশ দলে মুশফিকুর রহিমের সুযোগ পাওয়াটা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ ছিল। মূলত উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবেই দলে জায়গা পান মুশফিক। তৎকালীন উইকেটকিপার পাইলটের বিকল্প হিসেবে দলে তৈরি করা হচ্ছিলো তাকে। ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরগামী দলে সুযোগও পেয়ে যান তিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে আকাশকুসুম প্রত্যাশা করাটা অনুচিত, নির্বাচকরাও হয়তো তেমন কিছু প্রত্যাশা করেননি। তবে প্রস্তুতি ম্যাচে সাসেক্সের বিপক্ষে ৬৩ আর নটিংহ্যাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে অপরাজিত ১১৫ রানের দুটি ইনিংস খেলে তিনি নির্বাচকদের নজর কাড়েন। কিপার-কাম-ব্যাটসম্যানের বদলে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেই তিনি দলে জায়গা পান। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৯ রান করে আউট হলেও সেটা খুব বড় ধরণের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি, কারণ সেই ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল মাত্র ২২ রানের এবং ২ অংকের রান করতে পেরেছিলেন মুশফিক বাদে মাত্র ২ জন। এছাড়া মুশফিকের (৫৬) চেয়েও বল বেশি খেলতে পেরেছিলেন একমাত্র ওপেনার জাভেদ ওমর বেলিম (৬০)।
ওয়ানডে দলে মুশফিক সুযোগ পান জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরোয়া সিরিজে। প্রথম তিনটি ওয়ানডেতে পাইলটের পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হওয়ায় পরের দু’টি ম্যাচে সুযোগ পান মুশফিক। এরপর ওয়ানডে দলে আর পাইলট ফিরতে পারেননি। মুশফিক তার প্রথম অর্ধশত রান করেন হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ৫৭ রানের সেই ইনিংস জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশকে জয় পেতে সাহায্য করে। তবে মুশফিকের অনবদ্য একটি ইনিংস ছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে। জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে হাঁকানোর জন্য তামিম ইকবাল বিখ্যাত হলেও সেই ম্যাচটা জেতার পেছনে মুশফিক আর সাকিবের অবদানও ভুলে গেলে চলবে না, ৭৯ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর এই দুইজনের ৮৪ রানের জুটিই বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করে। সাকিব ৫৩ রান করে আউট হয়ে গেলেও ৫৬ রান করে অপরাজিত থাকেন মুশফিক।
এরপরই শুরু হয় তার ৪১ টি ইনিংসের রান খরা।
৩.
কিপিংটা দিয়ে মোটামুটি উৎরে গেলেও ব্যাটিংয়ে আশানুরূপ সফলতা আসছিলো না। অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে থাকায় ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ বছরে যথাক্রমে ২৪.০০, ২১.৭৩, ১৫.৪২, ২৯.৭৭ এবং ২৫.৬২ গড় থাকার পরও দল থেকে বাদ পড়ার মতো ঝুঁকিতে কখনো সেভাবে পড়তে হয়নি তাকে। এই সময়ে ক্যারিয়ার গড় মাত্র ২৩.৫৫ এবং স্ট্রাইক রেট ৬৫.০০ থাকার পরও সুযোগ পেয়েছেন হয়তো বয়সটা অনুকূলে থাকার কারণেই।
এই সময়েই বাংলাদেশে শুরু হয় বিপিএল। মূলত এই টুর্নামেন্টের কারণেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে যাচাই করার সুযোগ পায়। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে শেষ ৫ ওভারে ৫০ রান তুলতে হলে স্ট্রাইক রোটেট করে এবং সময়োপযোগী বিগ শট খেলতেই হবে – এমন পরিস্থিতিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে আগে কখনো খেলোয়াড়েরা সেভাবে মুখোমুখি হননি। বিদেশী খেলোয়াড়দের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব বাংলাদেশী অনেক খেলোয়াড়দেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এর সুফলটাই হয়তো দেখা যায় মুশফিকের আন্তর্জাতিক পারফরম্যান্সেও।
প্রথম বিপিএল খেলার পরপরই সেই বছরে বাংলাদেশের হয়ে ৯ টি ম্যাচ খেলে ৩৭.৭১ গড় আর ৮১.৭৩ স্ট্রাইক রেটে করেন ২৬৪ রান, যা কিনা তার বিগত বছরগুলোর পারফরম্যান্সের তুলনায় অনেকটাই ভালো। ধীরে ধীরে মুশফিক নিজেকে বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডারে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন। ২০১৪ সাল (গড় ৪৪.০০, স্ট্রাইক রেট ৮৫.৩৩), ২০১৫ সাল ( গড় ৫১.১৩, স্ট্রাইক রেট ১০১.৫৯), ২০১৬ সাল (গড় ৩৯.৬০, স্ট্রাইক রেট ৯১.৬৭) এবং ২০১৭ সালে (গড় ৪৫.৮০, স্ট্রাইক রেট ৮২.৩৭) তার পারফরম্যান্স একজন উঁচুমানের আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যানের মতোই। শুরুর দিকের অপরিণত মুশফিক ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করে বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন।
‘মি. ডিপেন্ডেবল’ উপাধিটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার প্রতি বাংলাদেশ দলের নির্ভরতা কতটুকু।
৪.
তবে পরিণত হলেও এখন পর্যন্ত মিডল অর্ডার কিংবা ডিপেন্ডেবল ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিককে পূর্ণাঙ্গ বলা যাচ্ছে না। ইনিংস গড়া, বিপর্যয় সামলানো, প্রয়োজন অনুযায়ী সিঙ্গেলসের উপর নির্ভর করে রান বের করা কিংবা সময়োপযোগী বিগ হিট করা, বড় ইনিংস খেলা – এই গুণগুলো তার ভেতর থাকলেও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ গুণ এখনো অনুপস্থিত।
প্রথমটা হচ্ছে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ক্ষমতা। মুশফিক মাঝেমধ্যেই আবেগের বশে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন সব প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেন, যা কিনা ব্যক্তি এবং দল উভয়ের জন্যেই হিতে বিপরীত হয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে মুশফিকের টুইট-বিতর্ক কিংবা ভারতের বিপক্ষে ‘প্রিম্যাচিউর’ উদযাপনের কথা সহজেই মাথায় আসে।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, নিজের প্রতি পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাসে ‘সংশয়’। মুশফিক কিপিং করতে না পারায় অসন্তুষ্ট, অথচ মুশফিক এই মুহূর্তে যে মানের ব্যাটসম্যান তাতে দলে জায়গা পাওয়ার জন্য ‘কিপার’ ট্যাগ থাকাটা প্রয়োজনীয় নয়। কিপার হিসেবে দলে থাকলে ব্যাটিং কিছুটা খারাপ করলেও দলে জায়গা নিশ্চিত এই ধরণের ধ্যানধারণা নিজের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস না থাকারই প্রতিফলন।
তৃতীয়টি হচ্ছে, ফিনিশিংয়ে দুর্বলতা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১১ সালের ম্যাচটার কথা মনে পড়ে? মুশফিক ১০০ বলে ১০১ রান করার পরেও ম্যাচটাতে ৫ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ, অথচ শেষ ৫ বলে প্রয়োজন ছিল মাত্র ৬ রান। সবচেয়ে বড় কথা মুশফিক ছিলেন তখন স্ট্রাইকে। এরপরের উদাহরণটা তো আরো করুণ, ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে শেষ ওভারে বাউন্ডারি মেরে অতিরিক্ত উল্লাস করতে গিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছিলেন ভারতের হাতে। সেই ম্যাচটাতেও বাংলাদেশ হারে মাত্র ১ রানে। তবে একই সঙ্গে এই কথাটিও সত্য, যতগুলো ম্যাচে তুলির শেষ আঁচড়টুকু দিতে পারেননি, তার চেয়ে ঢের বেশি ম্যাচে একাই বদলে দিয়েছেন দলের গতিপথ।
তীরে এসে তরি ডুবানোর কাজটা যেন ভবিষ্যতে আর না হয়, সেটা নিয়ে কাজ করা উচিত মুশফিকের। বয়স এখন মাত্র ৩০ বছর. আরো অন্তত পাঁচ বছর মুশফিকের কাছ থেকে সেরা পারফরম্যান্স আশা করা যেতেই পারে। পরিণত মুশফিকের সাথে সাথে যদি পূর্ণাঙ্গ মুশফিককে পাওয়া যায়, শেষ পর্যন্ত তাতে বাংলাদেশেরই লাভ। এই কথাটা মুশফিক যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল।