‘ফ্যাভ ফাইভ’ কিংবা পঞ্চপাণ্ডব নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কন্ডিশন, প্রতিপক্ষ যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশের পাঁচ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার তথা মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর তামিম ইকবাল; ঠিক রুখে দাঁড়াবেন। কিন্তু ক্রিকেট যখন ১১ জনের খেলা, তখন তো এই পাঁচে ভরসা চলে না! ভরসার প্রয়োজন বাকিদের কাছ থেকেও। বিশেষত তরুণ, অর্থাৎ নতুনদের প্রতি আশা একটু বেশিই থাকে। সেটাও আবার বিশ্বকাপের মতো আসর বলে আশার ভেলা ভেসে যায় আরও বহুদূর।
মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশ দলের বড় দুশ্চিন্তা ওপেনিং জুটি নিয়ে। তামিম ইকবালের সঙ্গে কে ব্যাট হাতে ইনিংসের উদ্বোধন করবেন তা নিয়ে বরাবরের মতো বিশ্বকাপের আগেও কপালে ভাঁজ ফেলতে হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টকে।
এক্ষেত্রে পরিকল্পনার বড় একটা অংশ তরুণদের ঘিরে। সেই পরিকল্পনার অগ্রীম আংশিক বাস্তবায়ন এরই মধ্যে করে দেখিয়েছেন ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার। এগিয়ে আছেন লিটন দাসও। দুজনকেই টপ অর্ডারের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মাত্র শেষ হওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের ফাইনাল ম্যাচে আবাহনী লিমিটেডের হয়ে দু’শো হাঁকানো (২০৮*) সৌম্যর উপর বিশ্বকাপে প্রত্যাশার ভার চড়া থাকবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে লিটন কিংবা সৌম্য দুজনেই সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যাশানুযায়ী ফর্মে নেই।
তারপরও দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ভাবনা, বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে সৌম্য-লিটনদের জন্য দারুণ একটা প্রস্তুতি হয়ে যাবে, যা বিশ্বকাপে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাবে।
উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান লিটন সর্বশেষ ব্যাট হাতে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন গেল বছরে এশিয়া কাপ ফাইনালে। ভারতের বিপক্ষে তার ব্যাটে এসেছিল ১২১ রানের দারুণ এক ইনিংস। এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ৮৩ ও উইন্ডিজের বিপক্ষে ৪৩ রানের ইনিংসের মনে রাখার মতো দুটি ম্যাচ। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অভিষেকের পর শুরুটা সৌম্য সরকারের ভালো হলেও ২০১৬ সাল থেকে দলে নিজের জায়গা নিশ্চিত করতেই সময় পার হয়েছে তার। তবে এ বছরের শুরুটা ভালো হয়েছে এই ওপেনারের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিল্টনে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন। পাশাপাশি কদিন আগে ২০৮ রানের অপরাজিত ইনিংসটি যেকোনো বাংলাদেশির পক্ষে ‘লিস্ট এ’ ম্যাচে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। সেদিক থেকে বলা যায় সৌম্য এই মুহূর্তে ফর্মে আছেন।
তামিমের মতে, বিশ্বকাপের আগে প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে সৌম্যর ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস তাকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে। যদিও, পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ব্যাট হাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। শেষ ম্যাচের আগে ১১ ম্যাচে তার ব্যাটে এসেছে মাত্র ১৯৭ রান। অর্থাৎ, শেষ ম্যাচটাই ছিল তার ফেরার ম্যাচ।
বাংলাদেশের পক্ষে লিস্ট এ ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়া অনেক বড় অর্জন। যদিও আমরা বিদেশে গেলে একেবারেই আলাদা কন্ডিশন এবং বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে খেলি, তারপরও ব্যাটে রান পাওয়া সবসময়ই ইতিবাচক ব্যাপার। এটা তাকে (সৌম্য) আত্মবিশ্বাস দেবে। তার আগের ইনিংসগুলো খারাপ হলেও সে এখন জানে কীভাবে রান করতে হয়, কিভাবে সে রান করেছে। আপনি যখন খারাপ ফর্মে থাকবেন, তখন রান করা ভুলে যাবেন। সবমিলিয়ে আয়ারল্যান্ড সিরিজের আগে ও রানে ফিরেছে এটা খুব ইতিবাচক ব্যাপার।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে তামিমের সঙ্গে ব্যাট হাতে ওয়ানডেতে ওপেনিং করেছেন পাঁচজন আলাদা ব্যাটসম্যান, সৌম্য সরকার, লিটন কুমার দাস, ইমরুল কায়েস, এনামুল হক এবং মোহাম্মদ মিঠুন। তামিম যখনই ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে চলে গেছেন, তখন প্রতিবারই টিম ম্যানেজমেন্ট নতুন নতুন ওপেনিং জুটি মাঠে নামিয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপে তামিমের সঙ্গে কে উদ্বোধন করবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে সৌম্য কিংবা লিটনদের একজন হবে তা আশা করা যেতেই পারে।
এদিকে সৌম্য যখন ফর্মে ফিরেছেন, লিটন সেই নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে তার অর্জন ৮ ম্যাচে দুটি হাফ সেঞ্চুরি। তবে তামিম মনে করেন, দুজনেরই বিশ্বকাপে ওপেনিং করার সমান দক্ষতা ও সম্ভাবনা রয়েছে।
তামিম বলেন,
নিয়মিত উদ্বোধনী জুটি মানে দুজনই দুজনের খেলার ধরনের ব্যাপারে ভালোমতো জানে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, আমি যদি মেরে খেলি তাহলে অপর প্রান্তে যে আছে তাকে সুযোগ নিতে হবে। একইভাবে আমিও তা-ই করবো। কিন্তু যে দলে নিয়মিত নয়, যে উইকেটে এখনও পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায়নি, তাকে এ কথা বলা যাবে না যে, ভাই তুমি ঝুঁকিটা নাও। কিন্তু লিটন-সৌম্য দুজনকে নিয়েই আমি আত্মবিশ্বাসী। তাদের দুজনের সামনেই সম্ভাবনা আছে। আমার মনে হয় এখনই সঠিক সময় পৃথিবীকে নিজের সক্ষমতা দেখিয়ে দেওয়ার।
বাংলাদেশ এখনও পরিপূর্ণ ওপেনিং জুটি পায়নি তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারোর। এমনকি তামিমও অস্বীকার করছেন না। তবে কালজয়ী কিংবদন্তি জুটির ব্যাপারে কিছু ভাগ্যেরও প্রভাব রয়েছে তা না মেনে উপায়ও নেই। এক্ষেত্রে তামিম অভিজ্ঞতা আর একসাথে অনেকদিন খেলাকে এগিয়ে রেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে তামিমের ভাবনা,
এটা আসলে প্রতিটি পেশাতেই হয়। আপনার সহকর্মী যখন আপনার সাথে গেল ২০ বছর ধরে রয়েছে, তখন সে জেনে যাবে কিয়াবে আপনি সব করেন, কোনটা পছন্দ করেন কোনটা অপছন্দ করেন। তাছাড়া সেরা ওপেনিং জুটির মধ্যে সবসময়েই বাড়তি বোঝাপড়া ছিল। সেটা আপনি হেইডেন-গিলক্রিস্ট, গাঙ্গুলি-টেন্ডুলকার কিংবা শেবাগ-টেন্ডুলকার; যার কথাই বলেন না কেন।
তিনি আরও বলেন,
আমাদের সেই সুযোগ নেই। কিন্তু পছন্দের তালিকায় দুজন রয়েছে যেখান থেকে বিশ্বকাপে একজনকে নেওয়া যাবে। আমি নিশ্চিত যে তারা দুজনেই বাংলাদেশকে আগামী ১০-১৫ বছর সার্ভিস দেবে। আমার মতে এটাই তাদের পারফর্ম করার সেরা সময়।
ওপেনিং ইস্যু একপাশে রেখে দিলেও, বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে কেমন করবে তার অনেকখানি নির্ভর করছে ইংল্যান্ডের কন্ডিশনের উপর। ঘরের মাঠে তামিমরা খেলেন স্লো এবং টার্নিং উইকেটে, যেখানে ইংলিশ আবহাওয়া মানেই পেস সহায়ক উইকেট। সেদিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশ কত দ্রুত ইংল্যান্ডের কন্ডিশনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সবকিছুই ত্রিদেশীয় সিরিজের উপর নির্ভর করছে বলে ভাবনা বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওপেনারের।
তামিম বলেন,
কন্ডিশন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা শেষবার যখন খেলেছিলাম, তখন উইকেট অনেক কঠিন ছিল। তাই আমি মনে করি প্রস্তুতি ও অনুশীলন ম্যাচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কীভাবে টুর্নামেন্ট সশুরু করছি সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিদেশীয় সিরিজের কথা বললে মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে উইন্ডিজ দারুণ ফর্মে আছে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের দল
তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, লিটন কুমার দাস, সাকিব আল হাসান, মোহাম্মদ মিঠুন, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সাব্বির রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং আবু জায়েদ রাহী।