গ্রামে গিয়েছিলাম তখন। ঢাকা শহরের বড় বড় অট্টালিকাকে ফাঁকি দিয়ে গ্রামে গিয়ে বেশ ভালো লাগছে, ফুরফুরে মেজাজে আছি তখন। তো, একদিন গ্রামের আমার চাচাতো ভাইদের নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছি। তখন আবার চলছিল ফসলের মৌসুম। আমাদের গ্রামের পরেই ধু ধু মাঠ। আর মাঠে ধানের চাষ আর সবকিছুর মাঝখানে একটা জিনিস খাপছাড়া ছিল; আর তা হলো, দুইটা বাঁশকে একসাথে আটকিয়ে তার মাথায় মাটির গোল পাতিল টাইপ জিনিস। অদ্ভুতভাবে একটা কালো ছেড়া পাঞ্জাবি পরানো সেটাকে। আর হ্যাঁ, ওই মাটির পাতিলে নানা ধরনের চিত্রকর্ম থাকে, যা মাঝে মাঝে ভয়ংকর দেখায়। তাদের দেখে একটা জিনিস ভাবি, কীভাবে এই এক জায়গায় এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, হোক না তারা কৃত্রিম মানবাকৃতি!
বিকালে চাচাতো ভাইরা সবাই মিলে মাঠে গেলাম ক্রিকেট খেলতে। আমি খুব ভালো ক্রিকেট পারি না। তো, সবাই সিদ্ধান্ত নিলো যে, আমাকে আম্পায়ার হিসেবে রাখবে। কী আর করার, খেলা যেহেতু পারি না, তাই আম্পায়ার হিসেবেই দাঁড়ালাম। খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর নিজেকে এক অন্য পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করলাম। নিজেকে তখন মনে হলো একটা বিশাল ধানের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কাকতাড়ুয়া। আসলেই তো, আম্পায়ার আর কাকতাড়ুয়াদের মাঝে পার্থক্য খুব কম! একজন থাকে বিশাল জমিনের কোনো এক পাশে, আরেকজন থাকে ক্রিকেট মাঠের ২২ গজের কোনো পাশে। একজনকে খেয়াল রাখতে হয়, যেন ফসলের মাঠে কোনো কাক বা অন্য পাখির আক্রমণ না হয়। আর অন্যদিকে আরেকজনের খেয়াল রাখতে হয়, মাঠে যেন কোনো ভূল বা কোনো বিতর্কিত ঘটনা না ঘটে। চলুন, আজকে ঘুরে আসা যাক ক্রিকেটের সেই সাদা হ্যাট পরা কাকতাড়ুয়াদের রাজ্য থেকে।
বিলি বাউডেন
তার সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল। হয় বসে বসে খেলা দেখা, নাহয় সামনে এগিয়ে যাওয়া। কেন জানেন? কারণ, মাত্র একুশ বছর বয়সে তার ধরা পড়েছিল আরথ্রাইটিস। ক্রিকেটকে ছেড়ে দিতে হবে, তাই বলে কি ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা কমে যাবে? একদমই না। নিউ জিল্যান্ড হেরাল্ডের এক বিজ্ঞাপনে বদলে গেল সব। যে ক্রিকেটকে এত ভালবেসেছেন, সেটিকে আরো বেশি ভালবেসে জড়িয়ে ধরলেন যেন। চিরগম্ভীর ভঙ্গিমা বদলে দিলেন বিনোদনপূর্ণ এক আম্পায়ারিং জগতে।
ক্রিকেট ভক্ত, অথচ ‘ক্রুকেড ফিঙ্গার’ নামটা শোনেননি, এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। আঙ্গুল বাঁকা করে আউটের সিগন্যাল দেয়া, এছাড়াও আরো নানান ভঙ্গিমায় তিনি সংকেত দিতেন।
এতক্ষণ যাকে নিয়ে বলছিলাম, তিনি আর কেউ না, নিউ জিল্যান্ডের হেন্ডারসনে ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয়া ব্রেন্ট ফ্রেজার বাউডেন। এখনো যদি বুঝতে পারেন, তাকে আমরা সবাই ‘বিলি বাউডেন’ নামেই চিনি। এখন পর্যন্ত আম্পায়ারিং করেছেন ৭৯টি টেস্টে, আর ১৮৪টি ওয়ানডেতে সাথে ১৯ টি-টোয়েন্টি।
সাইমন টফেল
তার চোখেমুখে তখন খেলা করতো ব্যাগি গ্রীন তোলার স্বপ্ন। ফাস্ট বোলিং করতেন তিনি। সেই সময় উইকেটের পেছনে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, আর কাপ্তান হিসেবে ছিলেন মাইকেল স্ল্যাটার। দলটা ছিল স্কুল পর্যায়ে, যারা প্রতিনিধিত্ব করতো তাদেরই রাজ্য দলের। না, তার আর ব্যাগি গ্রিন তোলা হলো না মাথায়। কারণ, ওই স্কুল পর্যায়ে থাকতেই বাদ সাধে পিঠের চোট। তাই খেলা থেকে বের হয়ে মাত্র বিশ বছর বয়সেই নেমে পড়লেন ফিফথ গ্রেডের একটা ম্যাচ পরিচালনা করতে। ঠিক পড়েছেন, মাত্র বিশ বছর বয়সে মাঠে আম্পায়ারিং করতে নেমেছিলেন তিনি!
এর সাত বছর পর, অর্থাৎ ২৭ বছর বয়সে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া আর শ্রীলঙ্কার মাঝে ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে আসেন তিনি। আর ওই সময় একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারে সুসময় চলে। তিনি তার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে মোট ৪ বার আইসিসির সেরা আম্পায়ার হন। তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচের আম্পায়ারিং করলেও ২০১১ পর্যন্ত কখনো আইসিসি বিশ্বকাপের ফাইনালে আম্পায়ারিং করতে পারেননি। কারণটাও অদ্ভুত, ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রতি বিশ্বকাপ ফাইনালেই যে অস্ট্রেলিয়া খেলেছিল! ২০১১ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে অজিরা যখন ভারতের কাছে হেরে যায়, সেই বছর ফাইনালে আলিম দারের সঙ্গে আম্পায়ারিং করেন তিনি।
এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম, তিনি হলেন সাইমন জেমস আর্থার টফেল, যাকে আমরা চিনি ‘সাইমন টফেল’ নামে। যখন অন্যান্য ক্রিকেটাররা অবসর নিয়ে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে যুক্ত হন, সেই সময়েই, অর্থাৎ ৪১ বছর বয়সে আম্পায়ারিং থেকে অবসর নেন তিনি।
আলিম দার
লেগ স্পিন বোলিং দিয়ে বেশি দূর আসতে পারলেন না। বন্ধু কিংবা এক বড় ভাই পরামর্শ দিলেন আম্পায়ারিংয়ে ক্যারিয়ার শুরু করতে। কিন্তু ভাবলেন, আম্পায়ারিং করে কি আর জীবিকা চালানো যায়! চলে আসলেন আমেরিকায়, শুরু করলেন ট্যাক্সি চালানো। কিন্তু একজন ক্রিকেটপ্রেমীর মন কি আর ট্যাক্সির গ্লাস আর স্ট্রিট ল্যাম্পের মাঝেই থাকে? থাকে না। মন পড়ে রইলো সেই ক্রিকেটের বাইশ গজে, যে বাইশ গজে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন ভালো ক্রিকেটার হবার।
ছেড়ে দিলেন ট্যাক্সি চালানো, স্ত্রী আর শ্বশুরের পরামর্শে দেশে ফিরলেন। এবং এসেই ২০০৩ বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। কিন্তু ওই বিশ্বকাপের সময়ই তার এক মেয়ে মারা যায়। কিন্তু স্ত্রী বা কেউই তাকে বিষয়টা জানায়নি, পাছে যদি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে!
এতক্ষণ যে সিনেমার মতো কাহিনীটা দেখলেন, সেটি হলো বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত আম্পায়ার আলিম দারের গল্প। যিনি ২০১৫ বিশ্বকাপের পর সমালোচিত হয়েছেন বেশি। তারপর এলিট প্যানেল, সাইমন টফেলের সঙ্গে কয়েকবার সেরা আম্পায়ারিং টিমের পুরস্কার জেতার পর আইসিসির সেরা আম্পায়ার, টানা তিনবার!
স্টিভ বাকনর
স্কুলের গণিত শিক্ষক থেকে ক্রীড়াজগতে কোচ। আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে রেফারি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সেরা আম্পায়ার। জ্বি হ্যাঁ, আমি বলছিলাম স্টিফেন অ্যান্থনি বাকনর, তথা স্টিভ বাকনরের কথা। যিনি জ্যামাইকার ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার ফলে ২০০৭ সালে ‘অর্ডার অব জ্যামাইকা’ বা ‘ওজে’ পদকে ভূষিত হন।
১৯৪৬ সালে জন্ম নেয়া স্টিভ বাকনর তার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৭৮ সালে লিস্ট-এ ক্রিকেটে। ২২১টি লিস্ট-এ ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়ারিং করার পর ১৯৮৮ সালে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে আম্পায়ারিং শুরু করেন, এবং এর এক বছর পর ১৯৮৯ সালে অ্যান্টিগায় উইন্ডিজ ও ভারতের মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ারিং করে অভিষিক্ত হন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ঐ বছরই জ্যামাইকার কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে উইন্ডিজ আর ভারতের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ দিয়ে টেস্টে আম্পায়ারিং শুরু করেন তিনি। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ১২৮ টেস্ট এবং ১৮১ ওয়ানডেতে আম্পায়ারিং করেন। ২০০৯ সালে ২০ বছরের আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেন স্টিভ বাকনর।
ডেভিড শেফার্ড
২৮২টি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ম্যাচে ১০,৬৭২ রান। যার মাঝে ১২টি সেঞ্চুরি আর ৫৫টি হাফ-সেঞ্চুরি রয়েছে। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনের সবকিছু ভূলে পরে মন দিয়েছেন স্রেফ আম্পায়ারিংয়ে। কিন্তু ভূলে যাননি নিজের বা নিজ দলের রানসংখ্যা যখন নেলসন নাম্বারে, ঠিক তখন এক পা উঠাতে কিংবা হালকা একটু লাফ দিতে।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এই ‘নেলসন নাম্বার’টা কী? আসুন, জেনে নিই এই নেলসন নাম্বারের কাহিনী। ভাইস এডমিরাল হোরাশিও নেলসন কার্সিকায় এক যুদ্ধের সময় হারিয়েছিলেন এক চোখের দৃষ্টি। তারপর স্পেনের সান্তা ক্রুজ শহর দখল করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়ে হারিয়েছেন এক হাত। ১৮০৫ সালে ট্রাফালগারের যুদ্ধে গুলিতে মারা যাওয়া নেলসন কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই পায়েই। কিন্তু কাহিনীটা হয় এর পরেই। আমাদের দেশের গুজবের মতো সেই সময় মানুষের গুজবের সাথে এক পা বেমালুম হারিয়ে যায় ভাইস এডমিরাল সাহেবের। তারপর নিজ দেশেই শুরু হয়ে যায় এক অদ্ভুত রীতির। নেলসনের এক হাত, এক চোখ আর এক পায়ের সাথে শুরু হলো নেলসন নাম্বারের, আর তা হলো ‘১-১-১’ কিংবা ‘১১১’৷ আর এই ‘১১১’ কে ধরা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে।
কোনো প্লেয়ার বা দল যখন ১১১ রান করতো, তখন বলা হতো, সাবধানে থাকো। আর সেজন্য কেউ হয় এক পায়ে দাঁড়াতো, বা মাটি থেকে হালকা একটু উপরে লাফ দিতো। আর রীতিটা নিজের খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত পালন করতেন তিনি।
হ্যাঁ, এতক্ষণ বলছিলাম সেই বিখ্যাত ডেভিড শেফার্ডের কথা, যিনি তার বিশাল রাজকীয় ভূড়ি নিয়ে আম্পায়ারিং করতেন জমিয়ে, সাথে নাকের ডগায় থাকতো তার প্রিয় চশমা। সেই শেফার্ড, যিনি ২০০১ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে সাকলায়েন মুশতাকের তিনটা নো বল খেয়াল না করার পর ম্যাচশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আম্পায়ারিং থেকে অবসরে যাবেন। ভাগ্য ভালো, সেদিন আর অবসরে যাননি। আরো চার বছর ছিলেন আম্পায়ার হিসেবে। আম্পায়ারিং করেন ৯২ টেস্ট আর ১৭২ ওয়ানডেতে। তারপর ২০০৫ সালে বিদায় দেন ক্রিকেটকে। আর ২০০৯ সালে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ডেভিড রবার্ট শেফার্ড।
ডিকি বার্ড
বাবা ছিল একজন খনি শ্রমিক, বাস করতেন সাউথ ইয়র্কশায়ারের স্টেইনক্রস গ্রামে। ১৯৪৪ সালে একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে র্যালি সেকেন্ডারি মডার্নের জন্য বাড়ি ত্যাগ করেন তিনি।
কয়লা খনিতে কাজ করার সময় ভাবলেন, ‘না, এইটাও আমার জন্য না।’ তারপর নিজের প্রথম পছন্দ ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু করলেন। প্রফেশনাল ফুটবল খেলার সময় হাঁটুতে ভয়ানকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। এরপর ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে চলে আসেন দ্বিতীয় পছন্দের খেলা ক্রিকেটে। বার্নসলি থাকার সময় তিনি খেলতেন জিওফ্রে বয়কটের সাথে। এরপর তার সাথে বন্ধুত্ব হয় সাংবাদিক মাইকেল পার্কিনসনের। এবং এরপর খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন ইয়র্কশায়ারের সাথে। ১৯৫৬-৬৪ পর্যন্ত তিনি ইয়র্কশায়ার আর লেস্টারের হয়ে কাউন্টিতে খেলেন। আর খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসরের পর কাউন্টির কোচ এবং আম্পায়ার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো আম্পায়ারিং শুরু করেন তিনি। আর এই যাত্রাটা শুরু হয় কাউন্টি ক্রিকেটে। এরপর ১৯৭৩ সালে হেডিংলি লিডসে ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে আসেন তিনি। ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে পিচজনিত কারণে উইন্ডিজকে ১৭ রানে জয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপর বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ও আম্পায়ার দর্শকদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন, যার মাঝে একজন ছিলেন সেই সময়কার বিখ্যাত আম্পায়ার হ্যারল্ড ডেনিস বার্ড, যাকে সবাই চিনতো ‘ডিকি বার্ড’ নামে। ওই ঘটনার এক বছর পর বার্ড বাসে করে নিজ শহরে যাচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলেন, বাসের কন্ডাক্টর একটি সাদা টুপি পরা, যা দেখতে হুবহু তার টুপির মতো। তো এরপর বার্ড সেই কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করার পর কন্ডাক্টর বলেন,
‘জনাব, আপনি কি মিস্টার ডিকি বার্ডের নাম শোনেননি? আমার মাথার টুপিটি তার টুপিরই একটি। আমি এ টুপিটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলায় তার মাথা থেকে নিয়ে চলে আসি।’
১৯৯৬ সালে বার্ড তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট আম্পায়ারিং করেন। ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যকার ওই ম্যাচশেষে যখন তিনি মাঠ ছাড়ছিলেন, তখন তিনি দুই দল থেকেই গার্ড অফ অনার পান, এবং দর্শকরা তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। এর দুই বছর পর তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে আম্পায়ারিং থেকেও সরে আসেন। ২০০৭ সালে ত্রিদেশীয় গোল্ড বীচ সিরিজে শেষবারের মতো আম্পায়ারিং করে অবসরে যান এই বিখ্যাত মানুষটি। অবসর-পরবর্তী সময়ে নিজের জীবন নিয়ে একটি বই লেখেন, যার নাম দেন ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’। আর এর ভূমিকা লেখেছিলেন বন্ধু মাইকেল পার্কিনসন। প্রকাশের পর দশ লক্ষেরও বেশি বিক্রি হয় এই বই। ১৯৮৬ সালে তিনি রাণীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ উপাধি লাভ করেন তিনি। এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের সেরা আম্পায়ার মানা হয় তাকেই।
ইয়ান গোল্ড
২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। বাংলাদেশ আর ভারত মুখোমুখি। সেদিন ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা দিন, কারণ বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে কোয়ার্টার ফাইনালে কোয়ালিফাই করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেই ম্যাচ ছিল আলোচনা-সমালোচনায় ভরপুর। নো বল আর বাউন্ডারি রোপের লাগার পরও আউটের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে দর্শকদের মাঝে আম্পায়ারের বিরুদ্ধে নিন্দার সৃষ্টি হয়। সেদিন আলিম দারের সাথে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন ইয়ান গোল্ড, সাবেক এলিট প্যানেল আম্পায়ার।
আইসিসির সেরা আম্পায়ারদের তালিকায় অন্যতম সেরা আম্পায়ার এই গোল্ড সাহেব। ১৯৫৭ বাকিংহামশায়ারের ট্যাপলোতে জন্ম নেন ইয়ান জেমস গোল্ড। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন একজন উইকেটরক্ষক, সাথে ছিলেন বামহাতি ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন ১৮টি ওয়ানডে, কিন্তু রান করেছেন মাত্র ১৫৫। ২০০৮ সালে ব্লুমফনটেইনে দক্ষিণ আফ্রিকা আর বাংলাদেশের টেস্ট খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেস্ট আম্পায়ারিংয়ে অভিষিক্ত হন তিনি। মোট ৭৪ টেস্ট, ১৩৫ ওয়ানডে আর ৩৭ টি-টোয়েন্টিতে আম্পায়ারিং করেন তিনি।
***
চলুন ফেরা যাক কাকতাড়ুয়ার গল্পে।
খেলা শেষ হলো। বাসায় ফিরলাম আর আম্পায়ারদের বায়োগ্রাফি পড়া শুরু করলাম। বাইশ গজের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকে কড়া রোদের মাঝে একটা খেলার প্রতিটা সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করতে হয়। একটু থেকে একটু ভূল হলেই সব শেষ। দর্শকদের গালি শুনতে হয়, মিডিয়া সাংবাদিকদের কটূক্তি শুনতে হয়। আম্পায়ারিং এমন এক পেশা, যেখানে আলোর ঝলকানি নেই, নেই কোনো বিনোদনের সুযোগ। এটা এমন এক পেশা, যেখানে আবেগের কোনো দাম নেই। একবার যদি ভূল করে, ওই ভূল শুধরে নেয়ার সুযোগ নেই। একটা ম্যাচে যখন টানটান উত্তেজনা চলছে, দর্শকরা গ্যালারিতে তাদের দলের জন্য গলা ফাটাচ্ছে। সেই সময় একজন আম্পায়ার তার চোখ দিয়ে তীক্ষ্মভাবে পরখ করতে হয় বোলারের বোলিং লাইন, যেন নো বল হলে চোখ না এডায়, বল আর ব্যাটসম্যানের প্যাড খেয়াল রাখতে হয় যেন সামান্যতম ব্যাটে-বলের স্পর্শ চোখ না এডায়। এছাড়াও আরো অনেক কিছু খেয়াল রাখতে হয় একজন আম্পায়ারের, যা আমাদের সাধারণ চোখে খুব কমই ধরা পড়ে।
এখন প্রযুক্তির যুগ। অনেক রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ক্রিকেটে। কিন্তু অনেক সময় এগুলার সাহায্য পাওয়া যায় না। একটা ডিসিশন হয়তো দিলেন, পরে রিভিউতে স্লো মোশনে দেখতে গিয়ে দেখা যায়, ডিসিশনটা ভূল ছিল। তখন একজন আম্পায়ারের মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! গ্যালারিতে হাজার হাজার দর্শকের কাছ থেকে কটূক্তি শুনতে হয়। ওই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা নিয়ে পরের বলেই আবার নতুন করে শুরু করতে হয়।
এরপরে কি হয়?
সবাই সাইমন টফেলের মতো আম্পায়ারদের কোচ হন না, সবার মূর্তি বসানো হয় না ডিকি বার্ডের মতো। শেফার্ডের মতো আম্পায়ারের খবর আসে তার মৃত্যুর পর। স্টিভ বাকনর, ইয়ান গোল্ড, শ্রীনিবাস বা ড্যারেল হেয়াররা কোথায় আছেন, সেটা খেয়াল রাখতেও আমরা ভুলে যাই। মার্ক বেনসন নামের এক আম্পায়ার ডিআরএস-এর চাপ সহ্য না করতে পেরে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ছেড়ে দিয়েছিলেন, কয়জন জানে সেই কথা?
কিন্তু দুনিয়ার সব চাপ একপাশে ফেলে রেখেও ম্যাচের পর ম্যাচ আম্পায়ারিং করে যান ওই বাইশ গজের কাকতাড়ুয়াদের। সাদা ‘কাউবয় হ্যাট’ পরা ওই মানুষদের কেউ বোঝে না, ভালোবাসে না। তাদের নামে গল্প জমে না, তাদের জন্য ভীড় জমে না। তবু দিনশেষে তারাও মানুষ, ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।