বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের ক্রেসটোভস্কি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় স্বাগতিক রাশিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমেই পর্দা উঠবে ফিফা আয়োজিত বিশ্বকাপের আগের শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট কনফেডারেশনস কাপের। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির সাথে লড়বে স্বাগতিক রাশিয়া এবং নিজেদের মহাদেশ সেরা পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, চিলি, ক্যামেরুন, নিউজিল্যান্ড এবং মেক্সিকো। এই ৮টি দলের মধ্যে একমাত্র মেক্সিকোই নিজেদের ঘরে কনফেডারেশনস কাপের সোনালী ট্রফিটি ঘরে নিয়ে যেতে পেরেছে, অন্যদিকে প্রথমবারের মতো কনফেডারেশনস কাপ খেলার সুযোগ পাচ্ছে রাশিয়া, পর্তুগাল এবং চিলি।
ইতিহাস
কনফেডারেশনস কাপের আদলে প্রথম কোনো টুর্নামেন্টের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। উরুগুয়ে সেবার আয়োজন করে ‘মুন্ডিয়ালিতো‘ বা ‘ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন্স গোল্ড কাপ‘। বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিতে চুমু খাওয়া ৬টি দেশের অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় এই টুর্নামেন্ট। শেষমেশ ইংল্যান্ড এই টুর্নামেন্ট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সুযোগ পায় পরপর দু’বারের তৎকালীন রানার্স আপ নেদারল্যান্ডস। ছয় দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় এবং গ্রুপের শীর্ষ দল চলে যায় ফাইনালে। ফাইনালে পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৫০ সালের মারাকানা ট্রাজেডির, ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় উরুগুয়ে; ঘটনাক্রমে উরুগুয়ে দলের কোচ ছিলেন ১৯৫০ সালের উরুগুয়ে দলের গোলরক্ষক রোকে মাসপোলি।
মুন্ডিয়ালিতোর পর আবারও ফেডারেশন কাপ বিজয়ীদের একত্রিত করার চেষ্টা চালানো হয় আর্তেমিও ফ্রাঞ্চি ট্রফির মাধ্যমে; যেখানে মাত্র একটি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হতো যাতে পরস্পরের মুখোমুখি হতো ইউরো চ্যাম্পিয়ন এবং কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন। মাত্র দু’বার অনুষ্ঠিত হওয়া এ টুর্নামেন্টের ১৯৮৫ সংস্করণে উরুগুয়েকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফ্রান্স বিজয়ী হয়; অপরটিতে ডেনমার্ককে টাইব্রেকারে হারিয়ে ট্রফি ছিনিয়ে নেয় আর্জেন্টিনা।
কিং ফাহাদ কাপ
১৯৯২ সালে সৌদি আরবের বালিরঙা মাটিতে আয়োজন করা হয় কিং ফাহাদ কাপ; সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহের নামানুসারে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আসে তিন মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্র, আইভরি কোস্ট, আর্জেন্টিনা এবং স্বাগতিক ও এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন সৌদি আরব। নকআউট টুর্নামেন্টের ফাইনালে সৌদি আরবকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার কিং ফাহাদ কাপের স্বাদ নেয় আলবিসেলেস্তেরা।
তিন বছর পর আবারও মাঠে গড়ায় কিং ফাহাদ কাপ; দল বেড়ে হয়ে যায় ৬টি। তবে এবার আয়োজক হিসেবে টুর্নামেন্টে সুযোগ পায় সৌদি আরব। নিজেদের গ্রুপের সেরা হয়ে ফাইনালে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা এবং ডেনমার্ক। তবে এবার আর কিং ফাহাদ কাপের ট্রফিটি আর্জেনটিনাকে ছুঁয়ে দেখতে দেয়নি ডেনমার্ক; মাইকেল লউড্রপের গোলে দু’বছর আগের আর্তেমিও ফ্রাঞ্চি কাপে হারার প্রতিশোধটাও নিয়ে নেয় ড্যানিশ ডায়নামাইটরা।
১৯৯৭ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
সৌদি আরবে হওয়া আগের দুটি কিং ফাহাদ কাপ টুর্নামেন্টকে কনফেডারেশনস কাপের সমমর্যাদা দিলেও এবার ফিফা নিজেই টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। এশিয়ান কাপের চ্যাম্পিয়ন হলেও আয়োজক হিসেবে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করায় সুযোগ পেয়ে যায় এশিয়ান কাপের রানার্স আপ আরব আমিরাত। এদিকে ১৯৯৬ ইউরো কাপের বিজয়ী জার্মানরা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে সুযোগ পায় রানার্স আপ চেক রিপাবলিক।
১৯৯৪ এর বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল গ্রুপ পর্বে বিজয়ী তো হয়ই, উপরন্তু ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ট্রফি কেবিনেটে পুরে নেয় প্রথম মহাদেশীয় কাপ। ৭ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন রোমারিও আর সেরা প্লেয়ার হিসেবে ঘোষিত হন ড্যানিয়েলসন।
১৯৯৯ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সে জায়গা দখল করে রানার্স আপ ব্রাজিল; অন্যদিকে ১৯৯৭ কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের জায়গায় ঢুকে পড়ে রানার্স আপ ব্রাজিল। আবার, মেক্সিকো আয়োজক হওয়ার সুবাদে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের স্লটে সুযোগ পায় যুক্তরাষ্ট্র।
গ্রুপ-এ থেকে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে স্বাগতিক মেক্সিকো এবং সৌদি আরব, অন্যদিকে ব্রাজিল আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে নিজেদের প্রথম কনফেডারেশন কাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে জার্মানি। অবশেষে ফাইনালে মেক্সিকোর কাছে ৪-৩ গোলে হেরে যায় ব্রাজিল। সেমিফাইনালে সৌদি আরবের বিপক্ষে রোনালদিনহোর হ্যাটট্রিক তাকে এনে দেয় গোল্ডেন বুটের সোনালী ট্রফি।
২০০১ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
কোনো বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে প্রথমবারের মতো কনফেডারেশনস কাপ আয়োজনেরও সুযোগ পায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ফ্রান্স একইসাথে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যও কনফেডারেশন কাপ খেলা সহজ হয়ে যায়। অন্যদিকে মেক্সিকো সুযোগ পায় গতবারের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে।
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে ব্রাজিল; হেরে যায় তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও। অপরদিকে জাপানকে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ এবং কনফেডারেশন কাপ জয় করে লেস ব্লুজরা। সোনালী-রুপালী রঙের বুট আর বল জোড়াও দখলে নেয় ফ্রান্স ইতিহাসের সেরা দলটি।
২০০৩ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
২০০৩ সালের কনফেডারেশন কাপের ঢোকার সুযোগ পেলেও দ্বিতীয়বারের মতো তা প্রত্যাখ্যান করে জার্মানি। ২০০০ ইউরোর রানার্স আপ হিসেবে পরবর্তী সুযোগটি পায় ইতালি। কিন্তু তারাও সেটি বাতিল করে দেয়। শেষমেশ বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান দখলকারী দল হিসেবে প্রথমবার খেলার সুযোগ পায় তুরস্ক।
ক্যামেরুনের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ব্রাজিল, অন্যদিকে থিয়েরি অঁনরির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ফ্রান্স পেয়ে যায় তাদের দ্বিতীয় কনফেডারেশনস কাপ শিরোপা। একই সাথে গোল্ডেন বুট এবং গোল্ডেন বল পাওয়া অঁনরি ফাইনালের ৯৭ মিনিটে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন।
২০০৫ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে কনফেডারেশনস কাপে দ্বিতীয়বারের মতো অংশগ্রহণ করে জার্মানি। এদিকে ব্রাজিল একই সাথে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আর্জেন্টিনা সুযোগ পায় টুর্নামেন্টটি খেলার।
মেক্সিকোর কাছে হেরে গিয়ে গ্রুপ পর্বে রানার্স আপ হিসেবে সেমিফাইনালে উঠলেও আদ্রিয়ানোর শেষ মুহূর্তের গোলে জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল। ফাইনালে আবারও আদ্রিয়ানোর জোড়া গোল; ব্রাজিলের কাছে ৪-১ গোলে ধরাশায়ী আর্জেন্টিনা ফাইনালে হারের স্বাদ গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার। ব্রাজিলের ২য় কনফেডারেশন কাপের সাথে আদ্রিয়ানো বাড়ি ফেরেন গোল্ডেন বুট আর গোল্ডেন বল নিয়ে।
২০০৯ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
২০০৯ কনফেডারেশনস কাপের অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো ব্রাজিল, স্পেন, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, ইরাক, মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র।
গোল ব্যবধান একই হলেও গোল করায় পিছিয়ে থাকার ফলে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ইতালি। এদিকে সেমিফাইনালে স্পেন হেরে যায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ব্রাজিলের শেষ প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র লুটিয়ে পড়ে লুইজ আদ্রিয়ানোর জোড়া গোলের সামনে। টানা ২য় বার এবং সর্বমোট ৩ বার কনফেডারেশনস কাপ সেরার মুকুট নিয়ে বাড়ি ফেরে সেলেসাওরা, সাথে লুইজ ফ্যাবিয়ানোর গোল্ডেন বুট আর কাকার গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ড।
২০১৩ ফিফা কনফেডারেশনস কাপ
বর্তমান কনফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলও নিজের মাটিতে কনফেডারেশন কাপ জয়ের সুযোগ হাতছাড়া করেনি। গ্রুপ পর্বে জাপান, মেক্সিকো এবং ইতালিকে পরাস্ত করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই সেমিফাইনালে উঠেছিল হলুদ জার্সিধারীরা। নকআউট পর্বে উরুগুয়ে আর স্পেনও খুব একটা বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কম মিনিট খেলার কারণে গোল্ডেন বুট জয়ের দৌড়ে তোরেসের কাছে ফ্রেড হেরে গেলেও নেইমারের অসাধারণ পারফরম্যান্স তাকে এনে দেয় গোল্ডেন বল। কনফেডারেশন কাপের সবচেয়ে সফল দল নিজেদের সাফল্য ধরে রাখে অন্যদের চেয়ে কিছুটা উঁচুতেই। ৯টি কনফেডারেশনস কাপের ৪টি শিরোপাই ব্রাজিলের দখলে!
২০১৭ সালের আসরে কাপে হয়তো নতুন কোনো দলের হাতে উঠতে যাচ্ছে কনফেডারেশন কাপের সোনালী শিরোপা। অনভিজ্ঞ দল পাঠিয়ে জার্মানি হয়তো অন্যদের তুলনায় সামান্য পিছিয়েই থাকবে। পর্তুগালের সবচেয়ে ভালো সুযোগ রয়েছে এবারের কনফেডারেশন কাপ জয়ের। তবে টানা দু’বারের কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন চিলিও ছেড়ে কথা বলবে না। সুযোগ রয়েছে স্বাগতিক রাশিয়ারও; চমক দেখাতে পারে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা ক্যামেরুনও। কে বাড়ি নিয়ে যাবে এবারের কনফেডারেশন কাপের সোনালী শিরোপা? উত্তরটা তোলা থাকল ২ জুলাই পর্যন্ত।
ফিচার ইমেজঃ Sports Illustrated