“সাকিব, চাইলেই কিন্তু আর দশজনের মতো জীবন আর কাটাতে পারবা না। তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে। তুমি দেখবা, তোমার অনেক বন্ধু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে, ফুচকা খাচ্ছে; তুমি এটা চাইলেও আর পারবা না। এটাই তোমার লাইফ।”
কথাটা বলেছিলেন সাকিব আল হাসানের অত্যন্ত শ্রদ্ধার একজন ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের স্বনামধন্য ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম। সাকিবের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে সত্যি কথা বোধহয় আর হয় না।
তর্কসাপেক্ষে বলে দেওয়া চলে, বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে বহুমাত্রিক খেলোয়াড়ের নাম সাকিব আল হাসান। একেক জনের কাছে তাঁর পরিচয়টা একেক রকম। কারও কাছে তিনি অহংকারী, চাপা স্বভাবের; আবার কারও কাছে তিনি দারুণ প্রাণোচ্ছ্বল, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত, শেকড় ভুলে না যাওয়া একজন মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশেষ অন্ত নেই, ভালোবাসার ভাণ্ডারেও সঞ্চয় নেহায়েত কম নয়। কিন্তু সাকিব আল হাসান আসলে কে? কেন তাঁকে নিয়ে এত বিতর্ক, কেনই বা এত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে তাঁর নামে? সেটা খুঁজে বের করতে হলে ফিরে যেতে হবে তাঁর কৈশোরে, তাঁর বিকেএসপি জীবনে। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে এসে উপলব্ধি করতে হবে মানুষ সাকিব আল হাসানকে। কেননা, ব্যক্তি সাকিবকে বুঝতে পারাটা নেহায়েত সহজ কোনো ব্যাপার নয়!
তাঁর রক্তে মিশে ছিলো ফুটবল, নিজের সবচেয়ে বড় প্যাশনের জায়গাটাও বরাবরই ছিলো সেটাই। কিন্তু বরাবরই দারুণ সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী সাকিব যেন পেলে-ম্যারাডোনা হতে চাইলেন না, চাইলেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে বিশ্ব মাতাতে। তাই ফুটবলপাগল বাবা মাশরুর রেজা যখন তাঁকে বললেন ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলে মনোযোগ দিতে, সাকিব পরিষ্কার করে বলে দিলেন, “ক্রিকেট খেললে বিশ্বকাপ খেলা যাবে।” এত কম বয়সে কী দৃপ্ত উচ্চারণ, কী দারুণ আত্মবিশ্বাস!
মামাতো ভাই মেহেদী হাসান উজ্জ্বল ফুটবলার ছিলেন, বাবাও ছিলেন ফুটবলপ্রেমী। ফলে বাড়িতে খেলাধুলার অনুকূল পরিবেশ ছিলো বরাবরই। তবে প্রথমদিকে বাবা সেভাবে তাঁর খেলাধুলায় সেভাবে উৎসাহ দিতে চাননি, ভয় ছিলো পড়াশুনায় বরাবরই দারুণ ফয়সাল শেষমেষ না আবার খেলাধুলা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে! সৌভাগ্যবশত, সাকিব পাশে পেয়েছিলেন মা শিরিন আখতারকে। আর পেয়েছিলেন একজন সাদ্দাম হোসেন গোর্কিকে। তিনিই প্রথম সাকিবকে আবিষ্কার করেন, এরপর তাঁকে ক্রিকেটে নিয়মিত এবং মনোযোগী করে তোলেন। সেখানেই শেষ নয়। শুরুতে সাকিব পেস বোলিং করতেন, গোর্কিই তাঁকে প্রথম স্পিন বোলিং করে দেখতে বলেন। আর এরপর সাকিব নিজ হাতে গড়েছেন ইতিহাস, মাগুরার দস্যি ছেলে ‘ফয়সাল’ থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন সাকিব আল হাসান। আর তাই যতদিন সাকিব আল হাসান থাকবেন, নেপথ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ হিসেবে কোনো একভাবে নিশ্চয়ই নাম আসবে স্থানীয় এক অখ্যাত কোচের, নাম সাদ্দাম হোসেন গোর্কি!
কিন্তু সাকিবের কি মনে আছে তাঁর কথা? গোর্কি কিন্তু শুনিয়েছেন ইতিবাচক কিছুই, “সাকিবের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। বাড়ি আসলে আমার সঙ্গে কথা বলে দেখা করে, এবং যখন যা দরকার আমাকে বলে।” ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “রাখে না? সমস্ত খেলার সরঞ্জাম দেয়, নিজে খোঁজখবর নেয়। আমার দল এখন যে কিটস নিয়ে খেলে, বেশিরভাগই সাকিবের দেওয়া। সাকিব যে এসব বিষয়ে কেমন, তা আপনারা বাইরে থেকে ঠিক বুঝতে পারবেন না।”
খুব একটা ভুল কিছু বলেননি তিনি, আজ অবধি আমরা হয়তো সত্যিই ঠিক সাকিবকে চিনে উঠতে পারিনি। ফলে সাকিব শেকড় ভুলে গেছেন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো। উত্তর- না!
বিকেএসপিতে চলে আসার পর সাকিব যেন হঠাৎ করেই কিছুটা একা হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, এখন থেকে পথ চলতে হবে একাই, মায়ের কোলে মাথা রেখে এখন আর ঘুমোতে পারবেন না। তখনও ফোনের তেমন প্রচলন নেই, ফলে মা-বাবা’র সাথে দেখা হওয়ার সুযোগও নেহায়েত কম। মাসে মাত্র একটিবার দেখা করার সুযোগ মিলতো, সেটাও স্বল্পসময়ের জন্য। কিন্তু ততদিনে কান্না সামলাতে শিখে গেছেন সাকিব, মানসিকভাবে শক্তি অর্জন করে ফেলেছেন অনেকটা। বরাবরই সৌম্য-শান্ত ‘ফয়সাল’ যেন বিকেএসপিতে এসে হয়ে গেলেন আরও চুপচাপ, আরও কিছুটা অন্তর্মুখী। বড় হয়ে উঠেছেন একদম নিজের মতো করে, নিজের মতো করে চারপাশের জগতটা সাজিয়ে নিয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে, এমনকি বিকেএসপির পাঠ চুকানোর আগেই জাতীয় দলে জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন। ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন ছোট্ট একটা গণ্ডিতে আটকে থাকতে, হাতেগোনা কিছু বন্ধুবান্ধব আর নিজের মতো করে বাঁচা। এই ছিলো সাকিবের জীবন, অন্তত আমরা খালি চোখে সেটাই দেখতে পাই।
কিন্তু সাকিব মানে কি শুধুই নিজের মতো করে থাকতে চাওয়া অন্তর্মুখী স্বভাবের একজন মানুষ? কাছের মানুষদের কাছে খোঁজ নিলে জানা যায়, দূর থেকে তাঁকে যতই আত্মকেন্দ্রিক, উগ্রমেজাজী কিংবা অসচেতন বলে মনে হোক না কেন, নিজের দুনিয়াতে তিনি বরাবরই দারুণ মনখোলা, আত্মবিশ্বাসী, স্বপ্নবাজ এবং আড্ডাবাজ একজন ছেলে। সাকিবের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এই তথ্যটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি শুধু অন্তর্মুখীই নন, নিজের চারপাশে পরিচিত জগতটা পেয়ে গেলে মন খুলে আড্ডাও মারতে পারেন তিনি!
তবে তাঁর যে একেবারেই কোনো খারাপ দিক নেই কিংবা ছিলো না, সেটাও নয়। বিতর্ক কখনও পিছু ছাড়েনি তাঁর, বারবার বিভিন্নভাবে বিদ্ধ হয়েছেন সমালোচনায়। আর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক কিছুটা অম্লমধুর, অভিযোগ আছে বিশেষ কিছু সংবাদপত্রের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতেরও। বলা হয়ে থাকে, কোনো একটি পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো, তো অন্য একটি পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব খারাপ।
তাঁর অধিনায়কত্বের সময়টা খুবই ইন্টারেস্টিং। যখন সহ-অধিনায়কত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন, সেভাবে অন্য কোনো দলকে বৃহৎ পরিসরে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা ছিলো না তাঁর। ফলে কিছুটা প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিলো, সাকিব কি সত্যিই প্রস্তুত? তিনি আরও বড় পরীক্ষায় পড়লেন, যখন তৎকালীন টেস্ট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা প্রথম টেস্টেই হঠাৎ ইনজুরি-আক্রান্ত হয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেলেন। হঠাৎ করেই যেন অধিনায়কত্বের ব্যাটনটা উঠে এলো অপ্রস্তুত তরুণ সাকিবের হাতে। চারিদিকে তখন হা-হুতাশ শুরু হয়ে গিয়েছে, সাকিব কি পারবেন?
সাকিব পেরেছিলেন, বাংলাদেশকে দোর্দন্ড দাপটে বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জিতিয়ে এনেছিলেন। শুধু সেটাই নয়, তাঁর অধিনায়কত্বও হয়েছিলো দারুণ প্রশংসিত। পরবর্তীতে তামিম, মুশফিক, মাশরাফিসহ আরও অনেকেই বলেছেন, অন-দ্য-ফিল্ড অধিনায়কত্বে ‘তর্কসাপেক্ষে’ সাকিবই দেশসেরা। কিন্তু প্রশ্ন উঠলো সাকিবের অফ-দ্য-ফিল্ড ভূমিকা নিয়ে।
প্রথমত, তাঁর ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনগুলো হয় অত্যন্ত একঘেয়ে। তাঁর উত্তরগুলো হয় কাটা কাটা, নীরস বদনে স্রেফ প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে চলে যান। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, বরাবরই সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে দেন। ফলে সাংবাদিকদের লেখার তেমন একটা উপাদান তাতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। মিডিয়াতে সাকিবের এমন বিরূপ একটা ইমেজ তৈরি হওয়ার পিছনে এটা বেশ বড় একটা কারণ।
দু’একটা উদাহরণ মনে করা যাক। এই যেমন, বাংলাদেশ ম্যাচ হেরে যাওয়াতে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন এসেছে, “ম্যাচ হারার কারণ কী?” একাদশ পছন্দ না হওয়ার ব্যাপারে কোনোরকম অসন্তোষ মনে লুকিয়ে না রেখে তিনি বলে দিয়েছেন, “যেই টিমটা আজকে খেলেছে, সেই টিমটা আমার না।” আবার বলেছেন, “দলের সেরা দুইজন ফিল্ডার মাঠের বাইরে বসে ছিলেন বলে ফিল্ডিংয়েই পিছনে পড়ে গেছি আমরা।” কিংবা ব্যাটিং বিপর্যয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করলে মজা করে উত্তর দিয়েছেন, “লাঞ্চটা বেশ ভালো ছিলো, তাই বোধহয়!” এছাড়াও একবার তিনি বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পেশীশক্তি কম হওয়ার প্রসঙ্গে বলেছিলেন অরেঞ্জ জুস খাওয়ার কথা। আমি আজ অবধি বিশ্বাস করতে পারি না, সেটা নিয়ে দেশের মিডিয়াতে বিতর্কও হয়েছে!
বরাবরই তিনি এগুলো নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন; কখনও কূটনৈতিক উত্তর না দিয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছেন বলে, আবার কখনও কূটনৈতিক উত্তর না দিয়ে মজা করে উত্তর দিয়েছেন বলে। তাতে সবসময় সাকিবের দোষ ছিলো বলেও দাবি করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, মাঠের বাইরে প্রশ্নবিদ্ধ নেতৃত্ব। অধিনায়কদের মাঠে যেমন সপ্রতিভ হতে হয়, তেমনি মাঠের বাইরেও হতে হয় দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী। অধিনায়কদের ক্ষেত্রে এটা গৎবাঁধা কোনো নিয়ম না হলেও সচরাচর এই ব্যাপারটা অধিনায়কদের থেকে প্রায়শই প্রত্যাশা থাকে। সেদিক থেকে সাকিব কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন বলেই গুজব রয়েছে ; যদিও আজ অবধি এমন কোনো অভিযোগ ড্রেসিংরুমের কোনো খেলোয়াড় থেকে আসেনি।
তৃতীয়ত, গ্রুপিং গুজব। আকাশে-বাতাসে এমন গুজবও শোনা যাচ্ছিলো তখন, ড্রেসিংরুমে নাকি দুটো গ্রুপ হয়ে গেছে। কিছু মাধ্যম মারফত আবার শোনা গেলো দুটো গ্রুপের নামও, বিকেএসপি এবং নন-বিকেএসপি। শোনা গেলো, সাকিব-তামিমই নাকি এই গ্রুপিংয়ের মূলে!
কিন্তু সেটা তো নেহায়েত ধোপে টেকার কথা নয়! কারণ সাকিব এবং তামিম দুজন খুব ভালো বন্ধু, আর তামিম ইকবাল নিজেই বিকেএসপি’র নন। অন্যদিকে মুশফিকুর রহিমের সবচেয়ে ভালো বন্ধু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। মুশফিক বিকেএসপি ব্যাকগ্রাউন্ডের হলেও মাহমুদউল্লাহ তো তা নন! তাই ‘কল্পিত’ এই দ্বন্দ্বটা আদতে যে বাস্তবতার ধারেকাছেও ছিলো না, সেটা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই।
তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, সাকিবকে তাহলে কেন ছাঁটাই করা হয়েছিলো জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর? উত্তরটা সহজ, তাঁকে সেই সময়ে ‘বলির পাঠা’ করা হয়েছিলো। হ্যাঁ, সাকিব হয়তো অফ-দ্য-ফিল্ডে সেভাবে দায়িত্বের ছাপ রাখতে পারেননি, হয়তো তিনি দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী কেউ ছিলেন না। তবে তাঁর বয়সটাও তো খেয়াল রাখতে হবে! সেই সময়ে দলে সর্বকনিষ্ঠদের একজন ছিলেন সাকিব, আর সেই বয়সেই বাংলাদেশের মতো একটি দলের অধিনায়কত্বের চাপ নিতে পারাটাই তো ছিলো আলাদা একটা কৃতিত্বের ব্যাপার! বাংলাদেশের তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স বলেছিলেন, “সে যখনই অধিনায়কত্বটা উপভোগ করতে শুরু করেছিলো, তখনই কেড়ে নেয়া হলো সেটা!” বাস্তবতা তাই, তাঁকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি।
ইদানিং তাঁকে নিয়ে নতুন কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। তিনি নাকি টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না; এমনকি এমন অভিযোগও মাঝেমধ্যে উঠতে দেখা যায়, তিনি নাকি ভারতের বিপক্ষে খেলা হলে ইচ্ছে করেই খেলা ছেড়ে দেন! এত ভয়াবহ অভিযোগ করতে হলে ন্যূনতম কিছু প্রমাণ থাকা চাই, কিন্তু আমরা অত্যন্ত অনায়াসেই তাঁর নামে এই অমূলক প্রোপাগান্ডা ছড়াতে কখনও ভুল করি না। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতম বিতর্কটা অন্যখানে, তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে!
নিশ্চিতভাবেই তারকাদের মাঠের বাইরের জীবন নিয়ে চর্চা হয় এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। ফলে তারকাদের পক্ষে একান্তই ব্যক্তিগতভাবে জীবনযাপন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে কঠিন, কখনও কখনও অসম্ভব। সাকিব আল হাসান তাঁর সহধর্মিনী উম্মে আহমেদ শিশিরকে ভালোবাসেন প্রচন্ড, আর তাই তাঁকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে কিংবা রেস্টুরেন্টে একসাথে খেতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়াতে চেক-ইন দেওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং সাম্প্রতিক সময়ের বাস্তবতায় তিনি যদি সেটা না করেন, তাহলেই বরং সেটাকে অস্বাভাবিক বলা যায়। অথচ সাকিব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কোনও ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করলে তাঁর রেহাই নেই, পেইজ কিংবা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বাজে সব মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। এমনকি শিশিরের সম্পর্কে অশালীন এবং ইঙ্গিতপূর্ণ সব কথাবার্তাও দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক কী পরিমাণ নিচু মানসিকতা হলে এ ধরণের বাজে ব্যবহার করা যায়, ভাবতে পারেন?
সাকিব তবু রাগ করেন না, হাসেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “আপনার প্রতিটি ঘটনায়, সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, আপনার স্ত্রীর নাম উঠে আসে। এতে কি অসহায় লাগে?” সাকিবের উত্তরটাও তাহলে জেনে নিন, “নাহ, অসহায় না; হাসি লাগে। আমি সত্যি বলি, হাসি লাগে। আমার কী মনে হয় জানেন? মানুষ এত ভেবে, গালি দেবে বলে দেয় না। এগুলো আসলে কী-বোর্ডের সামনে বসে তাৎক্ষণিক যা মনে আসে, বলে ফেলে। সে নিজে যদি এইগুলো নিয়ে ভাবতো, এর প্রতিক্রিয়া কী, বা এটা বললে সেটা শোভন হলো কিনা; তাহলে এসব বলতো না। আমি নিশ্চিত, লোকজন যেগুলো বলে, সেটা তাঁদের মনের কথা নয়।”
কী অসম্ভব ধৈর্য্য, কী বিশাল একটা হৃদয় থাকলে এমন একটা কথা বলে দেওয়া যায়! ভাবুন একবার, আপনার-আমার স্ত্রীকে নিয়ে যদি কেউ এমন বাজে কোনো মন্তব্য করতেন, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়াটা কেমন হতো?
হ্যাঁ, সবসময় তিনি সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। একজন দর্শক তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছেন বলে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সেই দর্শককে প্রহারের অভিযোগ উঠেছে তাঁর নামে; সেটার জন্য তাঁর শাস্তিও হয়েছে। নিঃসন্দেহে সেটা আদর্শ কোনো কাজ ছিলো না তাঁর মতো একজন রোল মডেলের জন্য। কিন্তু একবার তাঁর অবস্থান থেকে ভেবে দেখুন, তিনি ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার নন, তিনি একজন স্বামী। আর তাঁর স্ত্রীর অসম্মান সহ্য না করতে পেরেই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর জায়গায় আপনি-আমি কিংবা অন্য যে কেউ থাকলেও মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই এই রাস্তাটাই বেছে নিতে চাইতাম; শাস্তির তোয়াক্কা তখন আদৌ কতটুকু করতাম আমরা, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তেতো কথা হলেও এটাই রূঢ় বাস্তবতা, এমন পরিস্থিতিতে তিনি যতটা না ক্রিকেটার সাকিব, তার চেয়েও বেশি তিনি একজন রক্তমাংসের মানুষ।
এবার আসা যাক হেলিকপ্টার-বিতর্কে। আমি আজ অবধি বিশ্বাস করতে পারি না, সাকিব আল হাসান হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় গেছেন বলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিলো। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছল এবং প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। তিনি নিজের বাড়িতে হেলিকপ্টারে চড়ে যাবেন, নাকি ভ্যানে চড়ে, সেটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা নিয়ে ‘টাকা বেশি বলে সাপের পাঁচ পা দেখছে’, ‘টাকার গরম দেখায়’ টাইপের নিচু মানসিকতার কথাবার্তা বলাটা একদমই ভালো দেখায় না। আর তাছাড়া ঢাকা থেকে তাঁর বাড়ি মাগুরাতে যেতে যে পরিমাণ কষ্ট হয়, সেই কষ্ট না করে হেলিকপ্টারে সহজেই যদি চলে যেতে পারেন, তবে সেখানে আমাদের বিতর্কের অবকাশ কোথায়? সে অধিকারটাই বা আমরা পাই কোথায়?
এবার আসি তাঁর ভক্তদের সঙ্গে ব্যবহার নিয়ে কিছু দিক নিয়ে কথা বলতে। আমাদের মতো সাধারণ ভক্তদের জন্য বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের দেখা পাওয়াটা অনেকটা ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই ব্যাপার। যদিও তাঁরা আদতে একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো মানুষ নন, আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার যে ক্রিকেট দলের কোনো তারকাই এতটা নাক-উঁচু স্বভাবের নন যে তাঁকে একনজর দেখাটা আকাশের চাঁদের সাথে তুলনা করতে হবে। তবু তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, তাঁদের দেখা পাওয়া নিতান্ত সহজ নয়।
কোনো একভাবে সাকিবের দেখা পেয়ে গেলাম আমরা। তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের প্রথম অ্যাপ্রোচটা অধিকাংশ সময়ই হয় অনেকটা এরকম, “সাকিব, একটা সেলফি তুলেন আমার সাথে!” প্রথমত, অপরিচিতের সাথে দেখা হওয়ার পর শুরুতেই ‘সাকিব’ বলে সম্বোধনটা কতটুকু ভদ্রোচিত, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবু সেটাতেও আমি যাচ্ছি না। কিন্তু এই সেলফি তোলার বিড়ম্বনাও ঢের কম কিছু নয়। সবার সঙ্গে একসাথে গ্রুপ সেলফি তুললে হবে না, তুলতে হবে সবার সঙ্গে আলাদা করে। শুধু কোনোমতে তুললেও হবে না, ফেসবুকে আপলোড দেওয়ার মতো করে তুলতে হবে। শুধু ফেসবুকে আপলোড দেয়ার মতো করে তুললেই হবে না, হাসি হাসি মুখ করে কাঁধে হাত দিয়ে তুলতে হবে। তাতে সাকিব বিমানবন্দরের রিসেপশনে আছেন, নাকি রাস্তায়, নাকি হাসপাতালে, তাতে কারও কিছু যায় আসে না। সেলফি দরকার শুধু, তাতেই আমাদের চলে যায়। তিনি নিজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের মধ্যে আছেন কিনা, কোনো কারণে নিজে কিছুটা বিষণ্ন বা হতাশ হয়ে আছেন কিনা, সেটা দেখার প্রয়োজন আমাদের নেই। কারণ আমরা তাঁর ভক্ত, তাই আমাদের আবদার মেটানোই সাকিবের দায়িত্ব!
আর এসবের ভিড়ে আমরা হঠাৎ করে ভুলে যেতে বসি, সাকিব আল হাসান তারকা হলেও একজন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁরও ভালোবাসা আছে, রাগ আছে, অভিমান আছে; সবচেয়ে বড় কথা, বিরক্তিও আছে। স্রেফ তারকাখ্যাতির ব্যাপারটা মাথায় রেখে বাকি ব্যাপারগুলো ভুলে গিয়ে সাকিবকে ‘অহংকারী’ ট্যাগ দিয়ে দেয়াটা ঠিক কতটুকু গ্রহণযোগ্য, ভেবে দেখবেন কি? দল হিসেবে বড় হয়ে উঠছি, সমর্থক হিসেবেও বড় হয়ে ওঠা যে এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে!
ফিচার ইমেজ: Matthew Lewis/ Getty Images
তথ্যসূত্র
সাকিব আল হাসান – আপন চোখে, ভিন্ন চোখে। লেখকঃ দেবব্রত মুখোপাধ্যায়