ক্রিকেটকে বলা হয়ে থাকে ভদ্রলোকের খেলা। খেলাশেষে খেলোয়াড়দের আলিঙ্গন, করমর্দন কিংবা খেলা চলাকালীন প্রতিপক্ষ কোনো খেলোয়াড়ের জুতার ফিতা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারগুলো হর হামেশাই দেখা যায় ক্রিকেটে। ক্রিকেটের ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লিগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়াম লিগ বা আইপিএল। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে টুর্নামেন্টটি সম্প্রতি সম্পন্ন করলো তার ১১তম আসর। আইপিএল হলো বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের মিলন মেলা, ফলশ্রুতিতে বেড়েছে খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ। এই ১১ বছরে আইপিএল দেখেছে অনেক ক্রিকেটিয় সৌন্দর্য। তবে কোনো কিছুই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। মুদ্রার এপিঠে যেমন ক্রিকেটিয় সৌন্দর্য ছিল তেমনি অপর পিঠে ছিল নানা বিতর্কিত সব ঘটনা। প্রত্যেক আসরই জন্ম দিয়েছে নানা সমালোচনার, সাক্ষী হয়েছিল বিতর্কিত সব ঘটনার। আইপিএলের বিতর্কিত যত ঘটনা নিয়ে আমাদের আজকের লেখা।
১. শ্রীশান্তকে হরভজনের চড়
২০০৮ সালের আইপিএল এর শুরুর দিককার কথা। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হরভজন সিং। ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়দের করমর্দনের সময় ঘটে বিপত্তি। হরভজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্রীশান্ত, তবে সেই হাতে হাত না মিলিয়ে হঠাৎ শ্রীশান্তের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেন হরভজন। অথচ তারা ২ জনই ভারতীয় জাতীয় দলের সতীর্থ। এই ঘটনার জের ধরে বাকি ম্যাচগুলোতে নিষিদ্ধ হন হরভজন। সেী ম্যাচের ম্যাচ ফি’র ১০০ শতাংশ জরিমানা করা হয় তাকে। আইপিল এর প্রথম আসরে ভারতীয় জাতীয় দলের একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন কিছু ব্যবহার ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
২. আইপিল থেকে নিষিদ্ধ পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা
২০০৮ সালে আইপিএলের ১ম আসরে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছিলেন শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিক, সোহেল তানভীর, মিসবাহ উল হক সহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি খেলোয়াড়। সেবছর মুম্বাই হামলার ফলে পরের বছর আইপিলে তাদের খেলতে আসার এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয় পাকিস্তান সরকার। আইপিএলে তাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের বাসের উপর হামলা হলে আইপিএলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের ব্যাপারে কঠোর হয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। নিষিদ্ধ করা হয় পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের। ফলে ২০০৮ সালে ১ম ও শেষ বারের মতো আইপিএল খেলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা।
৩. ললিত মোদীর অপসারণ
বিসিসিআই ও ললিত মোদীর একান্ত প্রচেষ্টায় ২০০৮ সাল থেকে মাঠে গড়ায় আইপিএল। ললিত মোদী ছিলেন আইপিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান। যে মানুষটার হাত ধরে আইপিএলের যাত্রা, ২০১০ সালে আইপিএল এর ৩য় আসর চলাকালীন অর্থ সংগতি, বিদেশে অর্থ পাচার, বাজি ধরা, ঘুষ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে আইপিএল থেকে আজীবনের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয় ললিত মোদীকে।
৪. কলকাতা টিমে উপেক্ষিত সৌরভ গাঙ্গুলি
২০০৮-১০ এই তিন আসরে কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক ছিলেন কলকাতার ঘরের ছেলে ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ খ্যাত সৌরভ গাঙ্গুলি। টুর্নামেন্টের ১ম তিন আসরে দলটি ছিল চরম ব্যর্থ। ফলে ২০১১ সালের আইপিএল এর নিলামে তার প্রতি কোনো আগ্রহই দেখায়নি কলকাতার টিম ম্যানেজমেন্ট। এই নিয়ে হয় প্রতিবাদ। ‘নো দাদা, নো কেকেআর’ প্ল্যাকার্ড হাতে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় বিক্ষোভ করে প্রতিবাদকারীরা। ইডেন গার্ডেনে ভাটা পড়ে দর্শকের। পরে আশিস নেহরার ইঞ্জুরির সুবাদে তার পরিবর্তে পুনে ওয়ারিয়র্স ইন্ডিয়া দলে সুযোগ পান সৌরভ গাঙ্গুলি।
৫. চিয়ারলিডারের বিস্ফোরক মন্তব্য
২০১১ সালে আইপিএল নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে দক্ষিণ আফ্রিকার ২২ বছর বয়সী চিয়ারলিডার গ্যাব্রিয়েলা পাসকুয়ালোটো। তিনি জানান, ম্যাচ পরবর্তী উদযাপনে তাদের প্রতি ক্রিকেটারদের অসংগতিপূর্ণ আচরণ, অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন কিংবা যৌন হয়রানির চেষ্টা করা হয়। এমন মন্তব্যের পর আইপিএলের পরবর্তী ম্যাচগুলো থেকে সেই চিয়ারলিডারকে অব্যাহতি দেওয়া দেয়।
৬. লুক পোমার্সবাকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মারপিটের অভিযোগ
২০১২ সালে যৌন হয়রানি ও মারপিটের অভিযোগে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড় লুক পোমার্সবাককে গ্রেফতার করে মুম্বাই পুলিশ। হয়রানির শিকার সেই নারী জানান, লুক তাকে প্রথমে মদ্যপানের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় লুক তার পিছু নেন। এক পর্যায়ে তার কক্ষে প্রবেশ করে তার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেন।
সেই নারীর বাগদত্ত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে লুক তাকে মারধর করেন। পরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের মালিক বিজয় মালিয়া এক বিবৃতিতে জানান, তিনি আর আমাদের দলের কেউ নন। ফলে ঐ আসরে কোনো ম্যাচ না খেলেই নিজের দেশে ফিরে যেতে হয় লুককে।
৭. ওয়াংখেড় স্টেডিয়াম থেকে নিষিদ্ধ শাহরুখ খান
আইন যে সবার জন্যে সমান এর থেকে ভাল উদাহরণ হয়তো আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। ২০১২ সালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা কর্মীদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ান বলিউড বাদশা ও কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের অন্যতম স্বত্তাধিকার শাহরুখ খান। নিয়ম বহির্ভূতভাবে মাঠে প্রবেশ করতে যান তিনি।
বাধা দেন নিরাপত্তা কর্মীরা। শাহরুখের বিরুদ্ধে ম্যাচ অফিসিয়াল এবং নিরাপত্তা কর্মীদের গালিগালাজ করার অভিযোগ ওঠে। তাদের অভিযোগ সেই সময় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন শাহরুখ খান। যদিও পরবর্তিতে নেশাগ্রস্ত থাকার কথা অস্বীকার করে শাহরুখ। পরবর্তী ৫ বছরের জন্যে ওয়াংখেড়ে শাহরুখের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে মুম্বাই ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন।
৮. স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারী
২০১৩ সালে দিল্লী পুলিশ ম্যাচ ফিক্সিং এর দায়ে এক বুকিকে আটক করে। বিশদ তদন্তে বের হয়ে আসে বলিউড অভিনেতা বিন্দু দারা সিং, আইপিএলের অন্যতম ফ্রাঞ্চাইজি রাজস্থান রয়্যালসের তিন খেলোয়াড় শ্রীশান্ত, অংকিত চাবান ও অজিত চান্দিলার নাম। পুলিশ ম্যাচ ফিক্সিং এবং বাজিতে সম্পৃক্ততা পায় রাজস্থান রয়্যালসের সহ-স্বত্তাধিকারী বলিউড অভিনেত্রী শিল্পা শেঠির স্বামী রাজ কুন্দ্র এবং চেন্নাই সুপার কিংসের স্বত্তাধিকার গুরুনাথ মায়াপ্পানের।
গুরুনাথ মায়াপ্পান ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি এন শ্রীনিবাসন এর জামাতা। জামাতার এমন কর্মকান্ডে তোপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এন শ্রীনিবাসন। বাজিতে দুই দলের মালিকের সম্পৃক্ততার বিষয়টা দীর্ঘদিন তদন্তাধীন ছিল। ২০১৫ সালে আইপিএলের আসর শেষে পরবর্তী ২ বছরের জন্যে রাজস্থান রয়্যালস এবং চেন্নাই সুপার কিংসকে বহিষ্কার করা হয়। বাজিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ২ দলের ২ মালিক যথাক্রমে রাজ কুন্দ্র এবং গুরুনাথ মায়াপ্পানকে আজীবনের জন্যে বহিষ্কার করা হয় আইপিএল থেকে।
৯. বিরাট-গম্ভীর দ্বৈরথ
তারা ২ জনই জাতীয় দলের সতীর্থ। আইপিএলেও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নিজ নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের হয়ে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে ব্যাট করছিলেন বিরাট। লক্ষ্মিপতি বালাজির করা এক বলে আউট হয়ে সাজঘর ফিরছিলেন বিরাট। উদযাপনে ব্যস্ত ছিল কলকাতার খেলোয়াড়রা। কিছু একটা বলতে শুনেছিলেন বিরাট। তেড়ে যান গম্ভীরের দিকে। গম্ভীরও ধেয়ে আসে বিরাটের দিকে। ২ দলের দুই অধিনায়কের কাছ থেকে এমন আচরণ ছিল সেই আসরের অন্যতম এক বিতর্কিত ঘটনা।
১০. নেস ওয়াদিয়ার বিরদ্ধে প্রীতি জিনতার অভিযোগ
সাবেক প্রেমিককে সাথে নিয়ে ২০০৮ সালে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব দলের সহ মালিকানা কিনেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা। কিন্তু ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক সম্পর্কে ভাটা পড়ে। ২০১৪ সালের আইপিএলে পাঞ্জাবের এক ম্যাচ চলাকালীন নেস ওয়াদিয়ার বিরুদ্ধে প্রীতিকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার অভিযোগ ওঠে। নেস ওয়াদিয়ার বিরুদ্ধে প্রীতিকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয় এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেন প্রীতি। কিছুদিন পরেই নেস ওয়াদিয়ার সাথে সম্পর্কের ইতি টানেন প্রীতি।
১১. ম্যাচ চলাকালীন গ্যালারিতে আনুশকার পাশে বিরাট
২০১৫ সালের আইপিএলের ৯ম আসরের ঘটনা। ব্যাঙ্গালোরের এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের মুখোমুখি হয়েছিল বিরাটের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। মাঠে বৃষ্টির কারণে খেলা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ ছিল। খেলোয়াড়দের সাজঘর সংলগ্ন পাশের ভিআইপি গ্যালারিতে ছিলেন আনুশকা শর্মা। হঠাৎ করেই সেখানে বিরাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ম্যাচ চলাকালীন কোনো খেলোয়াড়ের স্ত্রী বা বান্ধবীর সাথে দেখা করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বিরাট এসবের তোয়াক্কা না করেই দেখা করে আনুশকার সাথে। যা ছিল নিয়ম বহির্ভূত। যদিও পরবর্তীতে বৃষ্টির কারণে ঐ ম্যাচ পরিত্যক্ত করা হয়।
১২. চেন্নাই থেকে ম্যাচ স্থানান্তর
২ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে এ মৌসুমে আবারও আইপিএলে ফেরে চেন্নাই সুপার কিংস। চেন্নাই এর ঘরোয়া ভেন্যু ছিল চিপকের এম চিদম্বরম স্টেডিয়াম। তবে কাবেরি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে তামিল নাড়ু এবং কর্নাটক এই দুই রাজ্যের মানুষের মধ্যে দেখা দেয় সংঘর্ষ। স্টেডিয়ামের বাইরে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করতে থাকে। এমতাবস্থায় সেখানে চেন্নাইয়ের পরবর্তী ম্যাচগুলো বেশ হুমকির মুখে পড়ে। পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। বাকি ম্যাচগুলো সরিয়ে নেওয়া হয় পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে।
ফিচার ইমেজ : Hindustan times