নশ্বর জীবনের পাঠ চুকিয়ে লিখতে বসেছি নিজের গল্প। তোমাদের পৃথিবীতে (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছো, পৃথিবীটা এখন আর আমার নেই, কেবলই তোমাদের) বেঁচে থাকার মতো আনন্দদায়ক আর কিছু নেই। শত-সহস্র সংগ্রাম, বাধা-বিপত্তি সমস্ত সামলে বেঁচে থাকাটা বড় মধুর। অনেকে মৃত্যুর কাছে পরাজয়টা বড় করে দেখে, অথচ তার আগে এতটা সময় যে বেঁচে থাকা হলো, সেটা?
ওয়ারেল গেল ১৯৬৭ সালে, ওয়ালকট ২০০৬, আর আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ২০২০ পর্যন্ত এলাম। আর তারপর! ভাবো, কী ভাগ্য আমার! তোমরা যে ডনকে ‘নমস্য’ করো, তোমাদের যাবতীয় ক্রিকেট পরিসংখ্যান শুরু হয় দ্বিতীয় থেকে যার কারণে, সেই পরম বরণীয় ব্র্যাডম্যানও কিন্তু আমার কাছে দু’টি জায়গায় পাক্কা ধরা! ব্র্যাডম্যানের চেয়ে বছর তিনেক বেশি সময় কাটিয়েছি এই মর্ত্যে, আর অন্যটি হচ্ছে ওর চেয়ে কম সময়ে (১ ইনিংস কম খেলে) হাজার রানের রেকর্ড আছে আমার। ডনের ১৩ ইনিংস লেগে গিয়েছিল, অবশ্য হারবার্ট সাটক্লিফও আমার মতো ১২ ইনিংসে হাজারে পৌছেছিল।
সে যাকগে, আমার টানা ৫ সেঞ্চুরিও তো কেউ ছুঁতে পারেনি। ব্র্যাডম্যান তো পারেইনি, তারপর ৭০ বছর পেরিয়ে গেল, পারেনি কেউ এখনো। তার আগে-পরে অ্যালান মেলভিল, জ্যাক ফিঙ্গলটন ও রাহুল দ্রাবিড় টানা চারটি সেঞ্চুরি পেয়েছিল কেবল!
শুনবে নাকি আমার টানা পাঁচ সেঞ্চুরির গল্প?
১.
সেটা ছিল বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঝক্কি-ঝামেলা কাটিয়ে সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পৃথিবী। কোথাও কোথাও শোধ ও প্রতিশোধ জট পাকালেও বেশিরভাগ জায়গায়ই অভাব-অনটন ও স্বচ্ছলতার জন্য চলছে লড়াই।
বার্বাডোজের দারিদ্র্য-পীড়িত একটা পরিবারে জন্ম আমার। শৈশবে বহু বছর বাবাকে দেখিনি, জীবিকার জন্য তিনি ত্রিনিদাদে পড়ে থাকতেন। সংসার খরচ পাঠাতেন শুধু, বাড়ি ফিরতেন না। অভাব ও অস্বচ্ছলতা ছিল বটে, তবে অনাদর ছিল না। ফুটবল-ভক্ত বাবা প্রিয় ‘এভারটন’ ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখলো আমার। অথচ আমার ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটের দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। গ্রাউন্ডসম্যানের কাজ করেছি, ঘাস কাটা, পিচ রোল করা, বড় আনন্দের সঙ্গে করতাম এসব। স্কুল ছাড়লাম, পিকউইক ক্লাবেও সুযোগ হলো না গাত্রবর্ণের কারণে। ফুটবল খেলে দিন পার করলেও মনটা ক্রিকেটের জন্যেই রইলো উতলা। বার্বাডোজ আর্মিতে যোগ দিলাম, সুযোগ হলো আবার ক্রিকেট খেলার।
ফ্র্যাংক ওয়ারেল, ক্লাইড ওয়ালকট – একজন মাস কয়েকের বড়, অন্যজন ছোটো। ১৮ মাসের ব্যবধানে বার্বাডোজের সেন্ট মাইকেলের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের তিনজনেরই জন্ম। খুব ভালো বন্ধু হয়ে পড়ি আমরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলার বহু আগে থেকেই চেনাজানা আমাদের। শুনেছো নিশ্চয়ই কথাটা, আমাদের তিনজনের দাই-মা নাকি একজনই!
কয়েক দশকের ব্যবধানে আরো একটি বিশ্বযুদ্ধ আরো একবার কাঁপিয়ে দিল বিশ্ব। মানুষ কেন এত হানাহানি ও ঘৃণা-রেষারেষি করে, বুঝি না আমি। পৃথিবীটা কত সুন্দর, মানুষ কেন যে যুদ্ধের বিষ ছড়ায় কে জানে!
বিশ্বযুদ্ধের পর উইন্ডিজের মাঠে প্রথম সিরিজ। উত্তেজনা তো ছিলই, সঙ্গে যোগ হলো অভিষেক-সম্ভাবনা। বার্বাডোজ ক্রিকেট লিগে প্রতিভার বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে দিলাম ক্যারিবীয় ক্রিকেট মহল। ওরা মুগ্ধ হলো আমার প্রতিভায়। ঘরের মাঠে অভিষেক হলো। ব্রিজটাউন, কেনসিংটন ওভাল। কত চেনা, কত পরিচিত! অথচ কী করলাম জানো? প্রথম ইনিংসে ৩৫, পরের ইনিংসে ২৫! ভাগ্যিস, ম্যাচটা ড্র হয়েছিল। তিন টেস্টে ৫ ইনিংসে ১৫২ করতে পারলাম মাত্র। জ্যামাইকা টেস্টে আমার বাদ পড়া সুনিশ্চিত। ঠিক তখনই ‘মিরাকল’ ঘটে গেল, যদিও এমন মিরাকল চাইনি। নিজের প্রতিভার প্রতি আস্থা ছিলই। আজ হোক বা কাল, ঠিকই সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে পারতাম। জর্জ হ্যাডলি, আমার আশৈশব ‘হিরো’ ইনজুরিতে পড়লেন। তার বদলে ডাক পড়লো আমার।
স্যাবাইনা পার্ক, চতুর্থ টেস্ট। উইন্ডিজ এগিয়ে ১-০তে। জ্যামাইকার ঘরের ছেলে জন হল্ট, তাকে বাদ দিয়ে দলে আমাকে নেয়া হয়েছে। ক্ষেপে ছিল স্বাগতিক দর্শক। ‘ভিনদেশী’ আমাকে দুয়ো দিয়ে গেল সারাক্ষণ। ওদের আদুরে ছেলেটা খেলতে পারছে না আমার কারণে, ‘ছি ছি’ তো করবেই। পণ করলাম, এর শোধ আমি তুলবই। এই লোকেরাই আমায় মাথায় তুলবে। ওদের ঠোঁটের বিশ্রী বাক্যবাণ হতে বাঁচতে হলে ওদের মাথায় উঠতে আমাকে হবেই।
জ্যামাইকার দর্শকদের উল্লাসে ভাসিয়ে উপহার দিলাম আমার প্রথম মাস্টারক্লাস, ১৪১। ১৫টি চার ছিল তাতে। দিলখোলা দর্শকরা বেমালুম ভুলে গেল হল্টের কথা, দুয়োর কথা, আমাকে উইন্ডিজ ক্রিকেটের ‘হিরো’ মেনে মাথায় তুলে নিল অনায়াসে।
জ্যামাইকা থেকে দিল্লী, তারপর মুম্বাই (তখন বোম্বে), তারপর কলকাতা (সে টেস্টে যুগল সেঞ্চুরি) হয়ে চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ) পৌঁছে শেষ হলো আমার রোমাঞ্চকর পাঁচ সেঞ্চুরির অভিযাত্রা। শেষ হতো না, মাদ্রাজে ৯০ রানে যে রানআউট আমাকে দেয়া হয়েছিল, আমার ধারণা আম্পায়ার ছাড়া মাঠের আর কারো কাছে সেটা আউট মনে হয়নি। আমার আক্ষেপ থাকলেও দুঃখ নেই অবশ্য। যা হয়েছে তা-ই বা কম কীসে!
এক জনপ্রিয় পত্রিকা শিরোনাম দিয়েছিল,
‘Everton Weekes finally fails – run out for 90.’
৫ টেস্টের মধ্যেই তিনটিতেই মোটে একবার ব্যাট করতে হলো, উইন্ডিজ সিরিজ জিতল ১-০ তে। সেই সিরিজে ১১১.২৯ গড়ে ৭৭৯ রান করলাম। ইনিংসগুলোয় চোখ বুলোবে নাকি একবার? ১২৮, ১৯৪, ১৬২, ১০১, ৯০, ৫৬, ৪৮!
২.
ইংল্যান্ডে গেলাম তারপর। আহা, সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! লর্ডসে প্রথমবারের মতো জয় পেল উইন্ডিজ। লেখা হলো বিখ্যাত সেই গান—‘দৌজ টু লিটল প্যালস অব মাইন, রামাধিন অ্যান্ড ভ্যালেন্টাইন।’ রামাধিন তো পৃথিবীতে আছে এখনো; আহা, পৃথিবী! খুব মিস করছি!
কালো মানুষের দল উন্মত্ত হয়ে উল্লাস করছে লর্ডসের সবুজ ঘাসে, সাদা মানুষগুলো অবাক চোখে দেখছে, সে এক সময় ছিল বটে! আমি সেই টেস্টে দুই ইনিংসেই সমান ৬৩ করেছিলাম। পুরো সিরিজে ৫৬.৩৩ গড়ে ৩৩৮ রান। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও নাম কামিয়েছিলাম খুব। সেবারই প্রথম ইংলিশ মিডিয়া ওয়ারেল, ওয়ালকট ও উইকস – মানে আমাদেরকে ‘থ্রি ডব্লিউজ’ নামে অভিহিত করে।
বিলেত সফরটা দারুণ উপভোগ্য ছিল, রানের পর রান করে যাচ্ছিলাম। সেবারই আমার ক্যারিয়ারসেরা অপরাজিত ৩০৪ করেছিলাম ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে। নটিংহ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে ২৭৯, লিস্টারশায়ারের বিপক্ষে অপরাজিত ২০০, হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে অপরাজিত ২৪৬… মানে বুঝছো তো, রান করা তখন আমার কাছে তখন জলবৎ তরলং ব্যাপার। মাঠে নামি আর রান করি। সে সফরে ২,৩১০ রান করেছিলাম সব মিলিয়ে।
উইজডেন লিখেছিল, ব্র্যাডম্যানের পর নাকি আর কেউ প্রথম ইংলিশ সফরে এরকম দাপট দেখাতে পারেনি। বড় স্কোরকে এমন ‘হাতের মোয়া’ বানাতে পারেনি।
একবার কী হলো, বলি। খুব মারছিলাম এক ম্যাচে। আমার ওপ্রান্তের সঙ্গী ছিল ওয়ারেল। সে আমার কাছে এসে বলল, আরে ব্যাটা, পেটাচ্ছিস কেন ওভাবে! যেভাবে মারছিস, ফিল্ডার তো নড়ারই সময় পাচ্ছে না। শোন, অত জোরে না মেরে আরেকটু আস্তে পেটা। যাতে ফিল্ডাররা বলের পেছন দৌঁড়ে, ছোটে। তাহলে দেখবি, কত দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে ওরা!
আমার খুব মজা লাগে ঘটনাটা বলতে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, ওয়ারেলের পরামর্শটা শুনিনি আমি। পিটিয়েছিলাম মনের সুখে।
তখনো ক্লাইভ লয়েডের ঐ দানবীয় পেস-আক্রমণ বহু দূর কি বাত, ওয়ারেলের হাত ধরে দলীয় সংহতি ও ক্যারিবিয়ান ঐক্যও গড়ে ওঠেনি সেভাবে। এক হ্যাডলি ছাড়া বলার মতো তারকা ছিল না উইন্ডিজের। সেই প্রথম ‘থ্রি ডব্লিউজ’, মানে আমি-ওরেল-ওয়ালকট উইন্ডিজ ক্রিকেটের ব্যাটিং গভীরতার চূড়ান্ত প্রমাণ রাখলাম। এই সময়টায় (১৯৪৮-১৯৫৮) আমাদের মতো মিডল অর্ডার ছিল না আর কারও। ওদিকে স্পিন-জুটি তো ছিলই, রামাধিন-ভ্যালেন্টাইন!
সিরিজটা আমরা জিতলাম ৩-১ ব্যবধানে। উইজডেন আমাকে ঘোষণা করলো ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’, তখন ১৯৫১ সাল।
৩.
স্কয়ার কাট খেলতে বড় ভালো লাগত আমার। ফেভারিট শট বলতে পারো। তবে কাট-পুল-ড্রাইভ ছিল সহজাত। প্রখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে এফ এল বেনসন উইজডেনে আমার সম্পর্কে কী লিখেছে, পড়েছো নিশ্চয়ই!
Weekes possessed in full measure those gifts which are the hallmark of all really great batsmen – exceptional quickness of eye and foot – so that he always had more than average time to make his strokes. Correct and sound in defence, he was extremely punishing in attack, and showed special strength in strokes off the back foot. Despite his short stature, strong forearms and wrists enabled Weekes to cut, pull and drive tremendously hard, and seldom did he lift the ball.
অনেকেই অনেক কিছু লিখছে। মনে পড়ছে, বহু আগে রিচি বেনো বলেছিল—
He set out to hammer bowlers.
তাতেও মন ভরেনি। বেনো আরো যোগ করেছেন,
He was a fierce hooker, puller and square-cutter, but at the same time, a terrific driver.
নিজের সম্পর্কে শুনতে কার না ভালো লাগে, বলো? স্তুতি হলে তো কথাই নেই। অনেকে আমাকে ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তুলনা করতো, আমি নাকি ব্যাটিংয়ে অনেকটা স্যার ডনের মতোই। দাপুটে, আগ্রাসী, আত্মবিশ্বাসী, খুনে ও মেজাজী।
৪.
ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে তেমনই রানের ফোয়ারা ছিল ব্যাটে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও রানে ছিলাম, পিটিয়েছি ইংল্যান্ডকেও। রানের দুরন্ত গতি আমাকে এনে দেয় উইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ রানের মুকুট-মালিকানা। আমার হিরো হ্যাডলিকে পেছনে ফেলেছিলাম এই ক্ষেত্রে। ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ২০৭ ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরো একটি ডাবল সেঞ্চুরি (২০৬) তুলে নিয়েছিলাম।
রান করার মতো মজা আর কিছুতেই নেই। একবার যখন এটা অভ্যাস হয়ে যায়, তখন তোমার শুধু রান করেই যেতে ইচ্ছে হবে। রান করাটা অভ্যাস কি না, এই ব্যাপারে টনি কোজিয়ারকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম একবার,
‘Why not enjoy it when you get into that habit, for there’ll come a time, once you play long enough, that you’ll lose that habit. I repeatedly told the young players I coached to learn to temper the ability to do well with the expectancy of failure as well.’
নিউ জিল্যান্ডে গেলাম। সেখানে তিন টেস্টে টানা তিন সেঞ্চুরি। আমার তো মনে হয় ছয় ইনিংস পেলে সেবার নতুন করে ছয় সেঞ্চুরির রেকর্ড লিখতাম। একটি করে ইনিংস পেয়েছিলাম প্রতি টেস্টে। ১২৩, ১০৩, ১৫৬। যদিও শেষ টেস্টে দুই ইনিংসেই ব্যর্থ ছিলাম, এবং আমরা হেরে গিয়েছিলাম। তারপরও বলা যায়, ব্যাট হাতে তখন রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য আমি।
অবিশ্বাস্য ফর্মটাকে আরো টেনে নেয়ার সুবর্ণকালে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। পরের ইংল্যান্ড সফরটা খুব বাজে গেল। অত বাজে সফর ও সময় আমি কখনো কাটাইনি। স্বদেশের ক্রিকেট-পরিবেশটাও ভালো লাগছিল না। পাকিস্তান সফরেও মানসিক অবসাদ কাটলো না, বা ব্যাটের উড়ন্ত অবস্থা ফিরল না সেভাবে। ঘরের মাঠে দ্বিশতক পেতে পেতেও (১৯৭) হারিয়ে ফেললাম। তারপর পুরো সিরিজ খুব একটা ভালো যায়নি। মনও টানছিল না। তাই বলে দিলাম বিদায়। বেদনাগ্রস্থ মন নিয়ে আর যাই হোক, ক্রিকেট খেলা যায় না।
পরে তো জনদাবির মুখে ওয়ারেল অধিনায়ক হলো, ওর অধীনে খেলার সৌভাগ্য আমার হলো না!
৬.
পুরো ক্যারিয়ারে মোটে একটা ছয় মেরেছিলাম আমি। স্পষ্ট মনে করতে পারি ছয়টার কথা। তোমার জীবনে তুমি মোটে একটা ছয় মেরেছো, সেটার কথা নিশ্চয় তোমার আগাগোড়া মনে থাকবে। পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে, আমরা খেলছিলাম অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৯৫৫ সালের সিরিজ ছিল এটা। ম্যাড়ম্যাড়ে ড্রয়ের পথে ছিল টেস্ট। বিল জনস্টনকে দিলাম উড়িয়ে লং-অন দিয়ে। ৮৭ রানে অপরাজিত ছিলাম সেবার।
আসলে আমাদের পাড়ার ক্রিকেটে উড়িয়ে মারার চল ছিল না। ধরো উড়িয়ে মারলে তুমি, তারপর বলটা গিয়ে পড়লো কারো বাড়িতে বা ভেঙে দিল কারো কাঁচ। বল তো যাবেই, ক্রিকেট খেলাও ঘুচে যাবে তোমার। সেই ভয়ে চেষ্টা ছিল বল যথাসম্ভব মাটিতে রাখা। উড়িয়ে মারবো না। অভ্যাসটা এমনই রপ্ত হয়ে গেল যে, একটা ছয় দিয়েই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল আমার।
এই যে বললাম না, একটা ছয়, তুমি আমার পরিসংখ্যানের পাতা উল্টালে দেখবে, সেখানে দুটো ছয় দেখাচ্ছে। তাহলে কি আমি ভুল বকছি? নাকি পরিসংখ্যানে ভুল?
আসলে কোনোটাই নয়। আমার প্রথম ভারত সফর ছিল তা। কলকাতা টেস্ট। স্পষ্ট মনে আছে এই ঘটনাও। আমি দুই রানের জন্য ছুটলাম, নিলামও। কিন্তু ফিল্ডার করে বসল ওভার-থ্রো। তা সীমানাদড়ি পেরিয়ে গেল। সেটাও যুক্ত হলো ‘ছয়’ হয়ে। আদতে মেরেছি কিন্তু একটি ছয়-ই!
৭.
১৫টি সেঞ্চুরি, ৪,৪৫৫ রান, ৫৮.৬১ গড়। ডান হাতে ব্যাটিংটা খুব একটা মন্দ করতাম না, কি বলো?
আরো একটা তথ্য যোগ করি, কমপক্ষে ২৫টি টেস্ট খেলেছে এমন ব্যাটসম্যানের মধ্যে আমার গড় পঞ্চম সর্বোচ্চ। ফিল্ডার হিসেবে ৪৯টা ক্যাচও নিয়েছি আমি। দারুণ একটা ক্যারিয়ার কাটিয়েছি আসলে। ওয়ালকট আরো বছর দুয়েক খেলেছিল, ওয়ারেল খেলেছিল আরো বেশ কয়েক বছর, চাইলে আমিও খেলতে পারতাম। কিন্তু মন টানেনি। মাত্র ৩২ বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়লেও বার্বাডোজের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটটা চালিয়ে গিয়েছিলাম অবশ্য। সেখানে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হয়েছিলাম, ঠিক যেমন আমার বন্ধু ওয়ারেল হয়েছিল উইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণকায় দলপতি।
তারপর কত কী করলাম জীবনে! ব্রিজ খেললাম, কমেন্ট্রি দিলাম, কোচিং করালাম। কানাডাকে নিয়ে ১৯৭৯ বিশ্বকাপেও তো গিয়েছিলাম। আইসিসির ম্যাচ রেফারিও ছিলাম। কত কত কাজ করার সুযোগ ও সম্মান পেয়েছি জীবনে! আর ক্রিকেট দেখা তো ছিলই। এই যে অনেকে আজকালকার ক্রিকেট নিয়ে ভ্রু কুঁচকায়, নিন্দে করে, সব গেল সব গেল রব তোলে। আমার কিন্তু অত বাছবিচার ছিল না। ক্রিকেটটা সকল রূপে, সকল কালে আমার কাছে আনন্দদায়ক। আমাকে যখন একজন প্রিয় ব্যাটসম্যানের নাম বলতে বলা হয়, আমি বলতে পারি না। এত এত ব্যাটসম্যানের খেলা ভালো লাগে, কাকে ছেড়ে কাকে বলি!
ক্রিকেটটা বড় সুন্দর, বড় আনন্দদায়ক খেলা। আমি হয়তো পৃথিবী ছেড়েছি, কিন্তু তোমরা তো রইলে, সংশয়-উগ্রতা বা ঘৃণা-তিক্ততা এক পাশে রেখে ক্রিকেট যদি দেখো, দুনিয়ার আর কোনো খেলাতেই তৃপ্তি পাবে না, এক ক্রিকেট ছাড়া! আমার জীবনের দুরন্ত শৈশব গেছে ক্রিকেটে, উত্তাল তারুণ্য গেছে ক্রিকেটে, রোমাঞ্চকর মধ্যবয়স গেছে ক্রিকেটে, আর বার্ধক্য কখনোই ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হয়নি। কারণ, আমি ক্রিকেট ভালোবেসেছি। ক্রিকেট দেখেছি।
*****
এই দেখো কী কাণ্ড! জীবনের সমস্ত লেনাদেনা চুকানোর পর বাংলায় লিখছি জীবনের গল্প। তোমরা আবার তা পড়ছোও। আসলে তোমাদের ঐ বঙ্গ-ছোকরাটা ছাড়ল না যে! আমাকে দিয়ে লিখিয়েই ছাড়ল! নাকি সে-ই লিখল? বয়স হয়েছে, ইদানিং কোনটা সত্যি কোনটা ভ্রম ঠাহর করতে পারি না!
রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেই যে লিখেছিলেন না –
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
– চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
ফ্র্যাংক ওয়ারেল গিয়েছিল ৪২ বছর ২২৪ দিন বয়সে। ৮০ বছর ২২১ দিন বয়সে গিয়েছিল ক্লাইড ওয়ালকট। আর আমার যেতে হলো ৯৫ বছর ১২৬ দিন বয়সে। জানা কথা, আমরা সবাই নাইটহুডপ্রাপ্ত। ওরা আগেই পেয়েছিল, আমি সবার শেষে, ১৯৯৫ সালে।
আমি বা আমরা (থ্রি ডব্লিউজ), আমরা ক্রিকেটের অমরপুত্র। আমাদের দেহখানা হয়তো থ্রি ডব্লিউজ ওভাল মাঠে সমাধিস্থ হয়েছে, কিন্তু ঠিক জানি, পৃথিবীর বুকে আমরা অবিনশ্বর। তোমরা আমাদের মনে রাখবে, আমাকে মনে রাখবে, আমাদের কীর্তি ও উচ্ছ্বলতা মনে রাখবে। এই যে এত এত লেখা পড়ছো আমাকে নিয়ে, ক্রিকেট পাড়ার শোকতপ্ততা, হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসা, অবিচুয়ারী, স্মরণ – সমস্ত দেখে নিশ্চিত হতে পারো, সব চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়! কোনো কোনো চলে যাওয়া ইতিহাসে অমরও হয়।
ভালো থেকো তোমরা। ভালো থাকুক পৃথিবী।