একবার কথা বললেই মনে রাখতে পারেন তিনি। ফোনে কথা বললে, নিজে থেকে নামটা আরেকবার জিজ্ঞেস করে ফোনে সেভ করতেও ভুল হয় না। নতুন কেউ যদি দ্বিতীয়বার তার সাথে কথা বলতে ফোন দেয়, তার মুখ থেকে নাম শুনে উল্টো অবাক হতে পারে। ব্যবহার, জ্ঞান আর ক্রিকেটের ব্যাপারে তার আগ্রহ যে কাউকে তার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে বাধ্য। সে কারণেই কি না, নিজের কাজের ব্যাপারেও বেশ খুঁতখুঁতে তিনি। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘চুজি’।
এই লোকটি নাজমুল আবেদীন ফাহিম, ক্রিকেট পাড়ায় সকলের প্রিয় ফাহিম স্যার। কদিন আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) লোভনীয় চাকরিটা অভিমান থেকেই ছেড়েছেন। সেই অভিমানটা ক্রিকেট নিয়ে কাজ না করতে পারার অভিমান, নিজেকে কাজে লাগাতে না পারার অভিমান। আর বিসিবি? হাস্যকর হলেও সত্য যে, দিনশেষে দারুণ একজন ক্রিকেটীয় মেধাকে কাজে লাগাতে না লাগিয়ে এবং অবহেলা করার মধ্যে দিয়ে দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ চিত্রটাকে আরও যেন বেশিই যেন স্পষ্ট করে তুলল।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ছিলেন টানা ১৭ বছর। সেখান থেকেই বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিসিবির সাথে তার কাজ শুরু ১৯৮৮ সালে। সেই থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজারের পর এলেন হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) কোচ হয়ে। শেষ পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো নারী দলের। সেখানেও সাফল্য এনে দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু ক্রমশ যেন তার কাজের ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে যাচ্ছিল। বন্দী হয়ে পড়ছিলেন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ছোট অফিস ঘরে। কিন্তু নাজমুল আবেদীন ফাহিম থাকতে চেয়েছিলেন মাঠে। কাজ করতে চেয়েছিলেন নতুন, পুরনো সব ক্রিকেটারকে নিয়ে। ঢেলে দিতে চেয়েছিলেন নিজের ক্রিকেট জ্ঞানকে। বিসিবি সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। সবকিছু মিলিয়েই চাকরিটা ছেড়েছেন অভিজ্ঞ এই কোচ।
জাতীয় দলের হাই-প্রোফাইল কোচরা যখন দলের ক্রিকেটারদের টানা অফ ফর্ম থেকে টেনে বের করতে ব্যর্থ হয়, তখনই ত্রাতা হয়ে দাঁড়ান এই ‘ফাহিম স্যার’। কোচ সারোয়ার ইমরান কিংবা মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের মতো এই ফাহিম স্যারের পরামর্শেই নিজেদের সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেন মুশফিকুর রহিম-সাকিব আল হাসানরা। তার মেধায় বারবার সমৃদ্ধ হয়েছে ক্রিকেটারদের পাইপলাইন। অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন নতুন ক্রিকেটার তৈরিতে। সেটিই করতে চেয়েছিলেন সামনের দিনগুলোতেও, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
৩০ সেপ্টেম্বর, নিজের শেষ কার্যদিবসের বিদায়বেলায় বিসিবিতে নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেছিলেন,
‘আমার মূল কাজ কোচিং করানো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জায়গা থেকে সরে গেছি। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচিং না করালেও পরামর্শ বা খেলোয়াড়দের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করার সুযোগ ছিল। আমি খেলোয়াড়দের কাছেই থাকতে চেয়েছি, সেটি ছেলেদের ক্রিকেট হোক কিংবা মেয়েদের । খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমরা যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটি কমাতেই এ সিদ্ধান্ত।’
কাজের ক্ষেত্র ছোট হওয়ার কারণেই এমন সিদ্ধান্ত, সেটাও উল্লেখ করতে ভুলে যাননি। বলেছেন,
‘কাজের ক্ষেত্রটা যদি মনের মতো না হয়, সেটি উপভোগ করা যায় না। কাজ উপভোগ করা জরুরী। আমি ঠিক উপভোগ করতে পারছিলাম না। এ কাজ চালিয়ে যাওয়ার তাই যৌক্তিকতা নেই।’
বিসিবির বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে বারবার সাহসী বক্তব্য দিয়ে গেছেন নাজমুল। বিভিন্ন অসঙ্গতি, ভুল সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। হয়তো সে কারণেই হয়েছেন পথের কাঁটা। তাই যখন পদত্যাগপত্র জমা দিলেন, গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা।
দারুণ কিছু মেধা থাকার পরও কেন জাতীয় দলের প্রধান কোচ তো দূরে থাক, কোচিং স্টাফের সদস্য হওয়ারও সুযোগ হয় না, সেই প্রশ্নের উত্তরে একবার ‘দেশি কোচে আস্থা নেই কেন বিসিবির?’ প্রসঙ্গে ‘ফাহিম স্যার’ বলেছিলেন,
‘দুটো ব্যাপার আছে। কোচের কোয়ালিটি, আমাদের সংস্কৃতি। আরেকটা হচ্ছে, আমাদের মানসিকতা। এখনো আমরা বিশ্বাস করি না যে, আমাদের দেশী কোচ দিয়ে জাতীয় দল বা এলিট লেভেলের টিম পরিচালনা সম্ভব। এর একটা কারণও আছে। সেটা হচ্ছে, ওই পর্যায়ে কাজ করার সুযোগটা আমাদের কোচরা এখনো পায়নি। সুযোগ যেহেতু পায়নি, সেহেতু প্রমাণ করার সুযোগও আসেনি।’
বাংলাদেশের ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে আসা ক্রিকেটাররা কোচ হওয়ার ক্ষেত্রে ততটা আগ্রহী নয় বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন। কারণ, এখানে জীবনযাত্রার মানের প্রভাব যেমন আছে, তেমনই ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা শঙ্কাও আছে। সব মিলিয়ে যারা কোচিং পেশায় ভালো করতে পারতেন, তারা এগিয়ে আসছে না বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে নাজমুল আবেদীন বলেছিলেন,
‘কোচ তো সবাই হবে না। কোচ হতে গেলে একটা নতুন জায়গা থেকে শুরু করতে হয়। অনেকের ধারণা, আমি অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছি। অতএব, আমি কালকে থেকেই ভালো একজন কোচ হয়ে যাব। ব্যাপারটা তা না। আমার মনে হয়, এখানে বেস্ট পসিবল যারা, তারা কোচিংয়ে এখনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। হতে পারে যারা মেধাবী, তারা অনেকেই হয়তো টপ র্যাংক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেনি।’
নাজমুল আবেদীন দেশের অভিজ্ঞতম ক্রিকেট কোচ। বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বর্তমান প্রধান কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন সরাসরি নাজমুল আবেদীন ফাহিমের ছাত্র। ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নাজমুল আবেদীন ফাহিম কেবল ক্রিকেট নিয়েই কাজ করেন না, বরং ক্রিকেটারদের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়েও কাজ করেন, যা ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সে পরোক্ষভাবে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
লেভেল-থ্রি ডিগ্রি অর্জন করা কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম দেশের প্রথম কয়েকজনদের একজন। কোচিং নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে ভারতে কোচিং কোর্সে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে অর্জন ‘উত্তম জ্যোতি’ খেতাব। ভারতের মোট তিনটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে কাজের প্রস্তাব পেয়েছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম, দেশের জন্য কাজ করবেন বলে তিনটি প্রস্তাবই ফিরিয়ে দেন।
বিসিবির চাকরি ছাড়ার পর নাজমুল আবেদীন ফাহিম আবারও ফিরে যাচ্ছেন নিজের পুরনো ঠিকানায়, বিকেএসপি’তে। আবারও সেই ক্রিকেট নিয়েই থাকতে চান, ক্রিকেটারদের সাথে। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে না পারার আক্ষেপ তার ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি।
যেমনটা উপলব্ধি করতে পারছেন তার ছাত্র কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। প্রিয় শিক্ষকের চাকরি ছাড়ার উদ্যোগকে বিসিবির ক্ষতি হিসেবেই দেখছেন তিনি। বলেছেন,
‘বিসিবির অবহেলার কারণেই স্যার চাকরি ছেড়েছেন।’
নাজমুল আবেদীন ফাহিম এমন একজন কোচ, যিনি মানুষ বদলে দিতে পারেন। দিয়েছেনও তাই। পেশাদার ক্রিকেটারের জন্য একজন কোচের যা করার দরকার, ‘ফাহিম স্যার’ শুধু তাই করেননি, থেকেছেন মাঠের বাইরেও, ছায়া হয়ে।