টেস্ট ক্রিকেটকে সমসময় গুরুত্বের সাথে নেওয়া ইংল্যান্ড বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করছে। তারা বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারদের বড় মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ দিচ্ছে।
গত কয়েকবছরে হাসিম হামেদ, ম্যাসন ক্রেন, ডম বেস, স্যাম কুরান এবং ওলি পোপের মতো তরুণ ক্রিকেটারদের টেস্ট দলে ডাক দিচ্ছে ইংল্যান্ড।
চলতি ইংল্যান্ড বনাম ভারত টেস্ট সিরিজে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু তরুণ দুই ক্রিকেটার স্যাম কুরান এবং ওলি পোপ। স্যাম কুরান ইতিমধ্যে প্রথম টেস্টে সুযোগ পেয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন। এবং ওলি পোপ লর্ডস টেস্টে ডাক পেয়ে ভালো করার জন্য মুখিয়ে আছেন।
সারির হয়ে স্যাম কুরান এবং ওলি পোপ সর্বশেষ মৌসুমে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন। যার ফলে দুইজনেই খুব দ্রুত ইংল্যান্ড টেস্টে জায়গা করে নিলেন। তাদের দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চারদিকে নানানরকমের প্রশ্ন উঠেছিলো। তাদের ক্রিকেটীয় প্রতিভার চেয়ে বয়স নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছিলো। এইরকম এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার বলেন, ” বয়স কখনও দল নির্বাচনের নির্ধারক হতে পারেনা।”
এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। এরপর প্রায় দুই যুগ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন তিনি। তাই ২০ বছর বয়সী দুই তরুণ স্যাম কুরান এবং ওলি পোপের শুধুমাত্র বয়সই মূল আলোচনা হতে পারে না যে সেটা তিনিই ভালো অনুভব করবেন।
১
লর্ডসে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক ঘটে ওলি পোপের। ২০ বছর ২১৯ দিন বয়সে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটা পোপ তৃতীয় কনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান। তার চেয়ে কম বয়সে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ডেনিস কম্পটন এবং হাসিম হামেদ।
ওলি পোপ কাউন্টি ক্রিকেটে চার নাম্বারে ব্যাট না করলেও নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে চার নাম্বারে ব্যাট করেছেন। নিজের প্রথম ম্যাচেই টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করার দায়িত্ব পড়েছে এই তরুণ ক্রিকেটারের উপর। বিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি চার নাম্বারে ব্যাট করেন। যিনি গত ম্যাচেও দুইশ রান করেন। টেস্ট ক্রিকেটে চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে অনেক কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানরা ব্যাট করে গিয়েছেন।
গত মৌসুমে কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটা ওলি পোপ নিজের প্রথম মৌসুমে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন। যার ফলে প্রতিযোগিতা ক্রিকেট মাত্র এক বছর খেলার পরেই ইংল্যান্ড টেস্ট দলে জায়গা করে নেন পোপ।
তিনি এখন পর্যন্ত ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে চারটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৩.২৫ ব্যাটিং গড়ে ১,০১২ রান করেছেন। লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটেও তিনি দলের চাহিদামতো ব্যাটিং করেছেন।
২রা জানুয়ারি, ১৯৯৮ সালে মিডলসেক্সের চেলসিতে জন্মগ্রহণ করেন ওলি পোপ। এরপর তিনি সারির হয়ে বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটের সব ধাপ পেরিয়ে বর্তমানে লর্ডস টেস্টের ভারতের বিপক্ষে খেলছেন। নিজের অভিষেক ইনিংসে হার্দিক পান্ডিয়ার বলে সাজঘরে ফেরার আগে ৩৮ বলে ২৮ রানের ইনিংস খেলেন পোপ। এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান ক্রিকেটের বড় মঞ্চে নিজের প্রতিভার কতটা সদ্ব্যবহার করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। এর আগে অনেক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানও বড় মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
২
ওলি পোপের সারির সতীর্থ স্যাম কুরান এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি বল হাতে পাঁচ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে দলের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ৬৩ রান এবং প্রথম ইনিংসে ২৪ রান করেন। এর আগে মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচ খেলা স্যাম কুরানের কাছেই ধরাশায়ী হয় বিশ্বের এক নাম্বার টেস্ট দল ভারত।
মাত্র ১৯ বছর ৩৬৩ দিন বয়সে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে স্যাম কুরানের। তাকে প্রথম দেখে যেকেউ ১৫-১৬ বছর বয়সী বাচ্চা ভেবে ভুল করে বসবে। এখনও যদি অনুর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করতে চায়, সেটাও পারবেন তিনি।
এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কোনো বাঁহাতি পেসার টেস্ট ক্রিকেটে একশো উইকেট শিকার করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালে সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচ খেলা বিল ভোচে সর্বোচ্চ ৯৮ উইকেট শিকার করেছেন। তাই স্যাম কুরানকে নিয়ে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। এই বাঁহাতি পেসার এরই মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে এক ইনিংসে চার উইকেট শিকারের কীর্তি গড়ে ফেলেছেন।
স্যাম কুরান ক্রিকেটীয় পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তার বড় ভাই টম কুরানের গত বছর ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক ঘটে। তিনি ইতোমধ্যে দুটি টেস্ট, আটটি ওয়ানডে এবং ছয়টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। তার মেজো ভাই বেন কুরান গত সপ্তাহে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছেন। তিনিও বেশ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। তাকেও হয়তো খুব শীঘ্র ইংল্যান্ডের জার্সিতে দেখা যাবে। এই তিন সুপুত্রের বাবা কেভিন ম্যালকম কুরানও বেশ প্রভাবশালী ক্রিকেটার ছিলেন। তিনি জিম্বাবুয়ের হয়ে ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২৮৭ রান করার পাশাপাশি নয় উইকেট শিকার। ম্যালকম কুরান কাউন্টি ক্রিকেটে ৩২৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ৪০৭টি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলেছেন।
ইংল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার ইয়ান ক্রেইগ কেপটাউনের একটি ক্লাবে টম কুরানকে প্রথম দেখেন। দেখেই তিনি মুগ্ধ হয়ে সারিকে পরামর্শ দেন তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য। এরপর স্যাম কুরানও তাদের চোখে পড়ে। স্যাম কুরান ২০১৫ সালে মাত্র ১৭বছর ৪০দিন বয়সে কেন্টের বিপক্ষে সারির হয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন। অভিষেক ম্যাচে আট উইকেট শিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তার ব্যক্তিগত চতুর্থ বলে দুর্দান্ত এক ইনসুইংয়ে জো ডেনলির মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেন স্যাম কুরান।
স্যাম কুরান বাঁহাতি পেস বল এমনভাবে করেন, যেন মনে হয় কোনো অফ স্পিনার বল করছেন। সেইসাথে ব্যাটসম্যান হিসাবেও বেশ কার্যকর তিনি। স্যাম কুরান কাউন্টিতে তিন বছরে ৪৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ১২টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। তিনি ২৭.৮৯ ব্যাটিং গড়ে ১,৫৩৪ রান করেছেন। বল হাতে তার প্রধান অস্ত্র ইনসুইংয়ের সাহায্যে নামিদামি ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করে ১২৪ উইকেট শিকার করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে ৫০টি লিস্ট-এ ম্যাচ এবং ৪৭টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন।
বর্তমানে দ্য ওভালের বোলিং কোচ এবং সাবেক ইংলিশ বাঁহাতি পেসার রায়ান সাইডবোটমও স্যাম কুরানের ভালো করার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন,
“আমি তাকে গ্রিপ পরিবর্তন করার কিছু কৌশল দেখিয়েছি। যার বল সুইং করানোর ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করবে। সে একদিনের মধ্যেই সেইসব আয়ত্ত করে ফেলেছে। প্রধান কথা হলো, তাকে আরও ধৈর্যবান হতে হবে। তার স্বভাব হলো, সে প্রতি বলেই উইকেট নিতে চায়। এটা খুবই ভালো। কিন্তু একসময় ঠিকই বুঝতে হবে যে, এটা কখনওই সম্ভব না। তখন ঠাণ্ডা মাথায় অফ স্ট্যাম্পের উপর নিয়মিত বল করতে হবে। সে এটা বর্তমানে ভালো করছে।”
ইংল্যান্ড তরুণদের উপর ভরসা রেখে তাদেরকে সুযোগ দিচ্ছে। তাদেরকেই ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের হাল ধরতে হবে। অ্যালিস্টার কুক, স্টুয়ার্ট ব্রড এবং জেমস অ্যান্ডারসন ক্রিকেটকে বিদায় জানালে যাতে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের শূন্যতা অনুভব না করতে হয়, সেজন্যই হয়তো এখনি তাদেরকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সুযোগ করে দিচ্ছে ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড।
ফিচার ইমেজ- Getty Images