‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়’- হাজার বছরের পরিচিত লোকগাথা এটি। কিন্তু কিছুটা উল্টো পথেই যেন হাঁটছে ক্রিকেট বিশ্বের এক দানবীয় নাম ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। খুব অদ্ভুতভাবে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে এক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এই দলটি। পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে পাঁচশটির উপর টেস্ট খেলুড়ে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামক ক্রিকেট দলের নাম। এখন থেকে আর এই পরিচিত নামে শোনা যাবে না বা দেখা যাবে না টিভি পর্দায়। দলটির নতুন পরিবর্তিত নাম হলো শুধু ‘উইন্ডিজ’।
চলতি মাসের প্রথম তারিখে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বর্ষপূর্তি। সেই অনুষ্ঠানেই অবসান করা হয় সকল জল্পনা-কল্পনার। এই দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্রিকেটের চীফ এক্সিকিউটিভ জনি গ্রোভ জানান, ৩১ মে হতে সরকারিভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নাম পরিবর্তন করে শুধুমাত্র উইন্ডিজ রাখা হয়েছে। শুধু দলের নামই নয়, বদলানো হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের নামও। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড’ নাম বদল করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ’।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড তাদের নাম বদলের বিষয়টি একটি বিবৃতি আকারে পেশ করেছে। জনি গ্রেভস লিখিত বিবৃতিতে জানান,
“আমরা বহুদিন ধরেই অনেকগুলো পার্টনারের সঙ্গে একত্রে কাজ করে আসছি। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের উন্নতির লক্ষ্যেই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা ঠিক করেছি নিজেদের মধ্যকার বন্ধনকে আরও দৃঢ় করব, আর সেই মতোই ‘২০১৮-২০২৩’ সালের জন্য একটি পরিকল্পনাও তৈরি করেছি আমরা।“
দলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ‘ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ জানিয়েছে, চলতিভাবে ‘উইন্ডিজ’ নামের মধ্য দিয়েই আরও প্রগাঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের ক্রিকেট ঐতিহ্য। নতুন ওয়েবসাইটের ফলে স্পনসরদের সঙ্গে এবং শেয়ার হোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করতে যে আরও সুবিধা হবে সে কথাও এ দিন মনে করিয়ে দেন ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রেসিডেন্ট ডেভ ক্যামেরন।
প্রকৃত অর্থে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো দেশ নয়, কয়েকটি দেশের সমষ্টিগত নামকরণ করা হয় ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। মধ্য আমেরিকার পাশে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত ১৫টি ইংরেজিভাষী ক্যারিবীয় দেশ, ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবিহীন দ্বীপরাষ্ট্রসমূহের ক্রিকেট দলের অংশগ্রহণ ঘটেছে এতে। জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ, বার্বাডোজসহ একাধিক দেশের খেলোয়াড় এই দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন। ক্রিকেট কর্তাদের আশা নতুন নামে হয়তো পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে দলটি। কিন্তু প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক, শুধুমাত্র নামের পরিবর্তনের মাধ্যমেই কি সমাধান হয়ে যাবে সকল সমস্যার?
ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গোড়াপত্তনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৮৯০ সালের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তখন তারা সফরকারী ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের বিপক্ষে প্রথম মাঠে খেলতে নামে। ১৯২৬ সালে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড বা ডব্লিউআইসিবি যোগদান করে। এরপরই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণ করে। এর দু’বছর পরই ১৯২৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল চতুর্থ টেস্ট খেলুড়ে দলের মর্যাদা লাভ করে।
চিরচেনা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সবচাইতে গৌরবময় সময় ধরা হয়ে থাকে গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত। এই সময়টিতে দলটি টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিরাজ করে গিয়েছে। পরবর্তী সময়েও বেশ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ ক্রিকেট দল ক্রিকেট বিশ্বে একটি শক্তিশালী নাম হিসেবেই সুপরিচিত হয়ে এসেছে। আর দলটির নামের সাথে কোনো প্রকার অবমূল্যায়ন না করে ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিয়ে গিয়েছে অসংখ্য শক্তিশালী খেলোয়ার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটির সাথে যুক্ত হয়ে আছে অসংখ্য পরিচিত মুখ। স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, ল্যান্স গিবস, গর্ডন গ্রীনিজ, জর্জ হ্যাডলি, ক্লাইভ লয়েড, ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস, আলভিন কালীচরণ, রোহন কানহাই, ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভারটন উইকস, কার্টলি এমব্রোস, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, স্যার ভিভ রিচার্ডসসহ আরও অনেকে। টেস্ট ক্রিকেটের এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের বর্তমান বিশ্বরেকর্ডধারী ব্রায়ান লারার নাম তো এখনও অনেক আন্তর্জাতিক বোলারদের স্বপ্নের মাঝে হানা দেয়।
তবুও একদিনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে যেন আগের ছন্দে ফিরতে পারছিল না দলটি। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে পরপর দুবার ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ের পর অনেক বছর যেন অধরাই রয়ে গেল কাপটি। ২০০৪ সালে আই সি সি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এসে দেখা মিলল নতুন করে কোনো বড় টুর্নামেন্ট জয়ের স্বাদ। সেবার ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বীপূর্ণ ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ওভালের মাটিতে দুই উইকেটে পরাজিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমবারের মতো ঘরে তুলে নেয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সব চাইতে চমকপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত হলো একদিনের ক্রিকেট খেলার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘টি ২০’। ২০ ওভারের এই সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরিয়ে আনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদেরকে। ‘পাওয়ার ক্রিকেট’ নামক শব্দের অবতারণ করে বেশ দাপটের সাথেই ক্রিকেট বিশ্বে পদার্পণ করে দলটি। চমৎকার ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে ২০১২ এবং ২০১৬ সালে দুবার আই সি সি টি ২০ ওয়ার্ল্ড কাপ জয় করে দলটি। শুধু কাপ জয়ই নয়, তা কীভাবে উদযাপন করতে হয় তারও এক সাক্ষর রেখে যায় কলকাতার মাটিতে। বিশ্ব অবাক হয়ে দেখে আর নাচতে থাকে গেইলের ‘গ্যাংনাম’ আর ব্রাভোর ‘চ্যাম্পিয়ন’ স্টাইলের সাথে।
একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রথম তিনটিতেই ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলা দলটি সবসময় অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং যথাযথ নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবের শিকার হচ্ছিল। এসব কারণে ছিটকে যেতে হয়েছিল অনেক উদীয়মান ক্রিকেটারকেও। বোর্ডের সাথে দলের খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্ব তো লেগেই রয়েছে সবসময়। উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা খেলোয়াড়দের একান্ত আবশ্যক। প্রতিনিয়ত খেলোয়াড় পরিবর্তন, খেলোয়াড়দের শাস্তি এবং ঠিকভাবে বেতন না দেওয়ার অভিযোগে মূল দল পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন দল নিয়ে খেলানোর অভিজ্ঞতা বারবারই হচ্ছিল এই দলটির। আর ফলাফল যে খুব একটা সুখকর হচ্ছিল তা কিন্তু নয়।
হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার আকুতি বারংবার। কিছুই যেন ঠিকভাবে যাচ্ছে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মাঝে। কফিনের শেষ পেরেকটা ঠোকা হলো চলমান আই সি সি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে ছিটকে পড়ার ঘটনায়। তাই সার্বিক পরিবর্তন যেন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু শুধু দলের বা বোর্ডের নামের পরিবর্তন কতটা সুবাতাস বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এই দলটির পুনরুত্থানের জন্য। শুধু টি টোয়েন্টিতেই নয়, অন্য ফরম্যাটগুলোতেও এই দলটিকে সমান তালে দেখতে চায় ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকেরা।