শেষ দুই মৌসুম ধরে নাপোলি দলটা বেশ ভালো খেলছে, লিগ শিরোপা না জিতলেও জুভেন্টাসকে বেশ চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো দলটি। সেই সুবাদে নাপোলির খেলা অনেকেই দেখেছেন। এখন আপনাদের একটা প্রশ্ন করা যাক। আচ্ছা বলুন তো, নাপোলির দশ নাম্বার জার্সি কোন খেলোয়াড় পরে থাকেন?
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আইকনিক দশ নাম্বার জার্সি নাপোলির বর্তমান দলের কারো দখলেই নেই!
কারণ খুঁজতে গেলে ৩০ বছর পিছনে চলে যেতে হবে। নাপোলিতে যোগ দিয়ে দিয়েগো ম্যারাডোনা ক্লাবটির ইতিহাসই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। নাপোলি মাত্র দুইবার লিগ শিরোপা জিতেছে, আর দুইটি শিরোপাই এসেছিলো এই ম্যারাডোনার হাত ধরে। ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তার পরিহিত দশ নাম্বার জার্সিটি চিরতরে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নাপোলি।
আচ্ছা নাপোলিই কি প্রথম জার্সি তুলে রাখার প্রথাটা চালু করে?
মোটেই তেমনটা নয়। জার্সি তুলে রাখার ঘটনাটা আসলে ফুটবলের কোনো দলের মাধ্যমে শুরু হয়নি, যুক্তরাষ্ট্রের আইস হকি দল টরেন্টো ম্যাপল লিফসের তারকা খেলোয়াড় এইস বেইলির স্মরনার্থেই প্রথম জার্সি তুলে রাখার প্রথাটা চালু হয়। ১৯৩৩ সালে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বরফে পড়ে গিয়ে মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান এই খেলোয়াড়। জখমটা এতটাই গুরুতর ছিল যে, ডাক্তাররা তার বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। যদিও বেইলি সেই যাত্রায় বেঁচে যান, তবে আইস হকির মাঠে তার আর ফেরা হয়নি। তার সম্মানেই টরেন্টো ম্যাপল লিফস চিরতরে ৬ নাম্বার জার্সিটি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই ঘটনার পর জার্সি তুলে রাখার প্রথাটা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিস নামক এক বেসবল ক্লাব ইতিমধ্যে তাদের দলের ১-১০ এর মধ্যে প্রতিটি জার্সি নাম্বারকেই অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেই তুলনায় ফুটবলে নির্দিষ্ট জার্সি নাম্বার তুলে রাখার প্রথাটা বেশ দেরিতে শুরু হয়। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও অবশ্য আছে, নব্বইয়ের দশকের আগে ফুটবলাররা কোনো নির্দিষ্ট নাম্বারের জার্সি পরতোই না! প্রতি ম্যাচের একাদশ অনুযায়ী তাদের মধ্যে ১-১১ নাম্বার জার্সি বণ্টন করা হতো। সেই সময়ে জার্সির পিছনে খেলোয়াড়দের নামও লেখা থাকতো না। নব্বইয়ের দশকে খেলোয়াড়দের জার্সির পিছনে তাদের নাম লেখা শুরু হয়, আর ক্লাবে প্রত্যেকের জন্য একটা নির্দিষ্ট নাম্বারের জার্সি বরাদ্দ করাটাও শুরু হয়। এর পরপরই ফুটবলেও একজন খেলোয়াড়ের সম্মানার্থে তার পরিহিত জার্সি নাম্বার তুলে রাখার প্রথাটা শুরু হয়।
বিভিন্ন ক্লাবের বিভিন্ন জার্সি নাম্বার তুলে রাখার গল্পগুলোও বেশ বিচিত্র। যেমন ধরা যাক ইংলিশ লিগের দলগুলোর কথা, বেশ কিছু ইংলিশ ক্লাব দর্শকদেরকে ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের ১২ নাম্বার জার্সি চিরতরে তুলে রেখেছে। যদিও বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগে যেসব ক্লাব খেলে তাদের মধ্যে কোনো দলই ১২ নাম্বার জার্সি তুলে রাখেনি, তবে ব্রিস্টল রোভার্স, এক্সাটার সিটি, প্লাইমাউথ, পোর্টসমাউথের মতো প্রিমিয়ার লিগের সাবেক দলগুলো এই প্রথা মেনে চলেছে। ইংল্যান্ডের বাইরেও বায়ার্ন মিউনিখ, ল্যাজি, পিএসভি আইন্দহোভেনের মতো ক্লাবও ১২ নাম্বার জার্সি চিরতরে তুলে রেখেছে।
খেলোয়াড়ি জীবনে যেসব খেলোয়াড় মারা যান, তাদের স্মরণার্থে অনেক ক্লাবই তাদের জার্সি নাম্বার তুলে রাখেন। তাদের অকাল প্রস্থানে সৃষ্ট হওয়া শূন্যস্থান কখনোই পূরণ হবে না – এমন বার্তাই এই প্রথার মাধ্যমে দেওয়া হয়। এছাড়া যখন একজন খেলোয়াড় দীর্ঘদিন একটি নির্দির্ষ্ট ক্লাবে নির্দিষ্ট জার্সি নাম্বার পরে খেলেন, তখন তার অবসরের পর সেই জার্সি নাম্বারকেও অবসরে পাঠানো হয়।
যেমন ধরা যাক এসি মিলানের পাওলো মালদিনির কথা। সেই ১৯৭৮ সালে দশ বছর বয়সের এক বালক হিসেবে মিলানে পা রেখেছিলেন, এরপর এই একটা ক্লাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন সুদীর্ঘ ৩১ বছর! তার পুরো ক্যারিয়ার যেন সমগ্র মিলানের ইতিহাসকেই বহন করে। এমন একজন খেলোয়াড়কে সম্মান জানাতে তার পরিহিত ৩ নাম্বার জার্সিটি অবসরে পাঠানোর ব্যাপারটা তাই খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। একই কারণে ইন্টার মিলানে হ্যাভিয়ের জানেত্তির পরিহিত ৪ নাম্বার জার্সি, ও ওয়েস্টহ্যামে পিটার মুরের পরিহিত ৬ নাম্বার জার্সিও তুলে রাখা হয়েছে।
কিন্তু সবক্ষেত্রে কি এমনটা করা হয়েছে? ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু দেখা যায়, বেশ কিছু ক্লাবের কালজয়ী খেলোয়াড়ের পরিহিত জার্সি নাম্বার অবসরে পাঠানো হয়নি। উদাহরণ হিসেবে সবার আগে চলে আসবে জুভেন্টাসের রবার্তো ব্যাজিওর নাম। এই অসাধারণ খেলোয়াড় তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন জুভেন্টাস ও মিলানে, কিন্তু এই দু’টো ক্লাবের একটাও তার পরিহিত দশ নাম্বার জার্সি নাম্বার অবসরে পাঠায় নি। ক্যারিয়ারের একদম গোধূলিলগ্নে তিনি ব্রেসিয়া নামক কিছুটা অখ্যাত ক্লাবের হয়ে চার মৌসুম খেলেছিলেন, সেখানে তার অর্জনের ঝুলিও আহামরি কিছু নয়। অথচ এই ক্লাবটিই তার সম্মানার্থে দশ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছে।
ব্যাজিওর এই ঘটনা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, কোন ক্লাব ঠিক কোন কারণে একটা জার্সি নাম্বারকে অবসরে পাঠাবে, সেটার নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। যদি তাই থাকতো, তাহলে ব্রেসিয়া নয়, বরং জুভেন্টাস অথবা মিলানই ব্যাজিওর সম্মানার্থে দশ নাম্বার জার্সি তুলে রাখতো।
জার্সি তুলে রাখার ব্যাপারটা নিয়ে যদি আমরা আরেকটু গভীরভাবে ভাবি, তাহলে বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও চলে আসবে।
আমরা নাপোলির কথাতেই ফিরে যাই। তারা তো সেই কবেই ম্যারাডোনার সম্মানার্থে দশ নাম্বার জার্সিটাকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ নাপোলি ধরেই নিয়েছে, ম্যারাডোনার চেয়ে শ্রেয়তর কেউ ক্লাবে আর আসবেই না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নাপোলির ফরোয়ার্ড লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে কিন্তু সেই ধারণায় বেশ বড়সড় একটা ফাটল ধরিয়েছেন। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে নেপলসের এই ক্লাবে আছেন তিনি, গত এক দশক ধরে নাপোলির আক্রমণভাগকে বলতে গেলে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন তার হাত ধরেই যদি নাপোলি আবারও লিগ শিরোপার স্বাদ পায়, তবে তিনি কি সেই দশ নাম্বার জার্সির যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচিত হবেন না?
কথা আরো বাকি আছে। নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনার যতটুকু অবদান, তার চেয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তার অবদান বেশি বৈ কম হবে না। কিন্তু সেই আর্জেন্টিনা কি তার সম্মানার্থে দশ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছে? না, তুলে রাখে নি। আসলে জার্সি তুলে রাখার ক্ষমতাটাই কোনো জাতীয় দলের নেই। কোনো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে সাধারণত ২৩ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়। আর নিয়ম অনুযায়ী, সেই ২৩ জন খেলোয়াড়ের মাঝেই ১-২৩ নাম্বার জার্সি বণ্টন করে দিতে হবে।
আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার সম্মানার্থে জার্সি তুলে রাখতে পারেনি। তার মানে কি আর্জেন্টিনা তাকে কম সম্মান প্রদর্শন করছে? মোটেও তা নয়; বরং বলা যায় হুয়ান রিকেলমে, লিওনেল মেসি’র মতো খেলোয়াড় ম্যারাডোনার পরিহিত সেই দশ নাম্বার জার্সি পরে খেলেছে, এটা যেমন ম্যারাডোনার জন্য আনন্দের ব্যাপার, তেমনি রিকেলমে, মেসিরাও এই বিশেষ নাম্বারের জার্সি পরে বাড়তি আত্মবিশ্বাসও পেয়েছিলেন।
আইকনিক জার্সির কথা আসলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাত নাম্বার জার্সির কথা তো অবশ্যই আসবে। এই সাত নাম্বার জার্সিটি কিন্তু জর্জ বেস্ট কিংবা এরিক ক্যান্টোনার পরই রেড ডেভিলরা তুলে রাখতে পারতো, কিন্তু সেটা তারা করেনি। আর করেনি বলেই ডেভিড বেকহ্যাম, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো মহারথীরা এই সাত নাম্বার জার্সি পরে খেলতে পেরেছেন। তাদের স্পর্শে এই জার্সির মাহাত্ম্য আরো অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
সবশেষে আসি এই শতাব্দীর সেরা দুই খেলোয়াড় লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথায়। লিওনেল মেসি তো সেই কৈশোর থেকেই বার্সেলোনার হয়ে খেলছেন। অন্যদিকে রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে রিয়াল মাদ্রিদ এবং এখন জুভেন্টাসের হয়ে খেলছেন। আচ্ছা, এই মহারথীরা অবসরে চলে যাওয়ার পর কি তাদের ক্লাব তাদের পরিহিত জার্সি নাম্বারকে অবসরে পাঠাবে?
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাবেক দুই ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদ সেই জার্সি অবসরে পাঠায়নি, আর তার বর্তমান ক্লাব জুভেন্টাস ব্যাজিও, দেল পিয়েরো কিংবা জিদানের মতো তারকাদের জার্সিও অবসরে পাঠায়নি। সুতরাং জুভেন্টাসেও রোনালদোর পরিহিত সাত নাম্বার জার্সি যে অবসরে পাঠানো হবে না, এটা মোটামুটি পরিষ্কারই। আর লিওনেল মেসির বার্সেলোনাও সেই প্রথা অনুসরণ করতে পারবে না, কারণ বর্তমান লা লিগার নিয়ম অনুসারে প্রতিটি ক্লাবকে প্রথম দিকের সব জার্সি নাম্বার পূরণ করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই কারণেই জাভি কিংবা ইনিয়েস্তার বিদায়ের সাথে সাথে তাদের পরিহিত ৬ ও ৮ নাম্বার জার্সি অন্য খেলোয়াড়দের দিয়ে দিয়েছে ক্লাবটি।
তাহলে কি এখন এটাই বলতে হবে যে মেসি কিংবা রোনালদোর এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন তাদের ক্লাব করছে না? মোটেও তেমন নয়; বরং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনা যে কাজটা করেছে, সেটাই সবার অনুকরণীয় হওয়া উচিত। একটা কথা কিন্তু আমাদের সবাইকে মানতে হবে, পেশাদার ফুটবলে আবেগের জায়গাটা খুব সামান্য।
এখানে সাফল্য পাওয়ার পর সেটা নিয়ে বুঁদ হয়ে না থেকে ভবিষ্যতে সেই সাফল্য ধরে রাখতে আবারও মাঠে নেমে যেতে হয়। একজন খেলোয়াড়ের বিদায়ে যদি একটি ক্লাব সেই পুরনো আবেগ নিয়ে পরে থাকে, তবে সেই খেলোয়াড়ের বিকল্প তারা কীভাবে খুঁজে পাবে? তাই একজন খেলোয়াড়ের বিদায়ে নির্দিষ্ট কোনো জার্সি নাম্বার তুলে না রেখে সেই খেলোয়াড়ের বিকল্প হিসেবে ওই জার্সি নাম্বারের যোগ্য উত্তরসূরী খুঁজে বের করাটাই হয়তো যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে।