২০১৫ সালের ২৯শে মার্চ। উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মের হাওয়া পেরিয়ে শারদীয় আবহ। অস্ট্রেলিয়ায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। সেই উৎসবের কেন্দ্র ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। সেই উৎসবকে আরো রঙিন করেছে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য-দাপটের গল্পগুলো। ক্রাইস্টচার্চ, ওয়েলিংটন, সিডনি, গ্যাবা ঘুরে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় লড়াই, আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চ হিসেবে সেজেছে এমসিজি। লড়বে একই মহাদেশের তারকা ঠাঁসা দুই দল, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। ক্রিকেটের বারোয়ারি মেলাটাও তখন সেখানেই। বিশ্বকাপে ট্রান্স-তাসমান ফাইনাল।
লড়াইয়ের উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিবেশী দেশ ও বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক নিউ জিল্যান্ডেও। কারণ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে তারা। আগে ছয়বার সেমিফাইনাল খেললেও ফাইনালের টিকিট তাদের অধরাই রয়ে গেছে।
সেবার ফাইনালে উঠলেও শিরোপা জেতা হয়নি। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম-ড্যানিয়েল ভেট্টোরিদের দর্শক বানিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে সেদিন অস্ট্রেলিয়া। ঘরের মাঠ এমসিজিতে ৯৩ হাজার দর্শককে সাক্ষী রেখে নিজেদেরকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে অজিরা, নেতৃত্ব দিয়েছেন মাইকেল ক্লার্ক। ১৯৯২ বিশ্বকাপে অ্যালান বোর্ডার যা পারেননি, ২৩ বছর পর ক্লার্ক সেই অসম্পূর্ণ কাজটাই করেছেন৷ ঘরের মাঠে দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। মাঠ ছেড়েছেন বীরের বেশে, বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে ধরে। শেষবারের মতো যখন কিটব্যাগটা গোছাচ্ছিলেন, তখন হয়তো একটা মিশ্র আবেগ কাজ করেছে তার ভেতর।
বিশ্বকাপের ফাইনালটাই ছিল ক্লার্কের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। বলা চলে ‘পিকচার পারফেক্ট ফেয়ারওয়েল’। এর চেয়ে দারুণ বিদায় ক্লার্ককে বোধহয় তার সতীর্থরা দিতেই পারতেন না। বর্ণিল ক্যারিয়ারের শেষ পাতায় লেখে গেছেন সবচেয়ে সুন্দর গল্পটা। দলের হয়ে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপও জিতেছেন; তবে অধিনায়ক হিসেবে নিজের দেশে বিশ্বকাপ জেতার যে তৃপ্তি, যে আনন্দ, তা তো ছাপিয়ে গেছে সবকিছু।
ওদিকে নিউ জিল্যান্ড যেভাবে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল, শেষটায় এর ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। অথচ পরিষ্কার ফেবারিট হিসেবেই খেলেছিল কিউইরা। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ চার নিশ্চিত করেছিল তারা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতাও রায় দিচ্ছিল নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে।
ইডেন পার্কে এই দুই দলের গ্রুপপর্বের ম্যাচের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাট করে ১৫২ রানে অলআউট। ছোট্ট টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ঝড় বইয়ে দেন ম্যাককালাম। পাওয়ারপ্লে’তে যেভাবে ব্যাট চালাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল ২০ ওভারের আগেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাবে।
চমক রেখেছিলেন মিচেল স্টার্ক। গতির ঝড়ে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন ব্ল্যাকক্যাপসদের ব্যাটিং লাইনআপ। একের পর এক হাওয়ায় ভাসানো, এয়ার সুইং করা দারুণ একেকটা ইয়র্কারে নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলেন কিউই ব্যাটসম্যানদের। এক উইকেট হাতে রেখে কেন উইলিয়ামসনের ছক্কায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় নিউ জিল্যান্ড। স্টার্ক একাই নেন ছয় উইকেট, মাত্র ২৮ রানের খরচায়। এই ম্যাচের কথা মাথায় রেখে হলেও এমসিজির দর্শক আর বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা টানটান উত্তেজনার একটা ফাইনাল আশা করেছিলেন টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট দুই দল থেকে।
কিন্তু ফাইনাল হয়েছে একপেশে। টস জিতে আগে ব্যাট করতে নামা নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে গ্র্যান্ট এলিয়ট ছাড়া বলার মতো রান করতে পারেননি কেউই; ফলতঃ ১৮৩ রানে গুটিয়ে যায় ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার বারুদে ব্যাটিং অর্ডারের কাছে তা টিকলই না। স্টিভেন স্মিথ, মাইকেল ক্লার্কের হাফ সেঞ্চুরিতে সাত উইকেটের জয় নিশ্চিত হয় অজিদের। তবে আলাদা করে বলতে হবে অধিনায়ক ম্যাককালামের কথা। টুর্নামেন্টজুড়ে ইনিংসের শুরুর দিকে পাওয়ারপ্লে কাজে লাগিয়ে যেভাবে ব্যাট করছিলেন তিনি, তাতে করেই আলাদা সুর-তাল-লয়-ছন্দ পেয়ে যেত নিউ জিল্যান্ড।
ফাইনালে তার জন্যই বোলারদের নিয়ে আলাদা ছক কষে রেখেছিলেন ক্লার্ক। ম্যাককালাম যেভাবে ব্যাট করেন, এতে করে তাকে আটকানোর একটাই মোক্ষম অস্ত্র — ইয়র্কার। যেই ভাবা, সেই কাজ। পরিকল্পনামতো স্টার্কের দারুণ এক ইয়র্কারে বোল্ড হন ম্যাককালাম। তাও ম্যাচের প্রথম ওভারে, ব্যক্তিগত রানের খাতা খোলার আগেই।
সেই একটা ইয়র্কারে ম্যাককালামের বোল্ড হওয়াটাই বিশ্বকাপ ফাইনালের সবচেয়ে দারুণ হাইলাইটস হিসেবে ক্রিকেটের আর্কাইভে জমা হয়ে আছে। একটা ডেলিভারিতেই অনেকটা ঠিক হয়ে গেছিল, কার ট্রফি ক্যাবিনেটে উঠবে বিশ্বকাপ। এক সাক্ষাৎকারে ক্লার্ক জানান, ঠিক তখনই তার মনে হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত। শুধু ক্লার্ক নয়, অস্ট্রেলিয়ার অন্য ক্রিকেটাররাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ছুটে গিয়েছিলেন স্টার্কের কাছে সবার আগে।
এর আগে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে স্টিভেন স্মিথ মনে মনে প্রহর গুনছিলেন, কখন স্টার্কের হাত থেকে ছুটে আসবে ইয়র্কাররুপী আগুনের গোলা। ডেভিড ওয়ার্নারকে ডেকে বলেছিলেন, ‘উইকেট পড়তে যাচ্ছে, দেখো তুমি।’
স্মিথের কথাকে প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই সত্য প্রমাণ করে দেন স্টার্ক। বিশ্বকাপজুড়ে দারুণ ছন্দে থাকা স্টার্কের ইয়র্কারে ম্যাককালামের অফ স্টাম্প উপড়ে পড়ার সাথে সাথেই গর্জে ওঠে পুরো এমসিজি। বলা চলে, শব্দের বিস্ফোরণ ঘটেছিল তখন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আইকনিক দৃশ্যগুলোর একটি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এটি।
পুরো টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ হেরেছে মাত্র একটি, সেটা নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। বাকি পাঁচ ম্যাচের চারটি জিতলেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয় বৃষ্টির তোড়ে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউ জিল্যান্ডের সাথে সমানতালে পাল্লা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যদিও প্রতি আসরেই তাদের আলাদা করে খুঁজে নেয় স্পটলাইট। এখন পর্যন্ত পর্দা উঠেছে ১২টি বিশ্বকাপের। যেখানে অন্যান্য দলকে যেখানে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়, সেখানে পাঁচবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। স্পটলাইটের ফোকাসটা তো তাদের ওপর যাবেই!
১৯৮৭ সালে কলকাতায় ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। স্টিভ ওয়াহ, ক্রেইগ ম্যাকডারমট, ডেভিড বুনদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটা অসাধারণ যাত্রা শুরু করেন অ্যালান বোর্ডার। পরদিন সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের ফ্রন্ট পেজে মাইক কাওয়ার্ড লেখেন,
‘ওহ ক্যালকাটা! ভিক্টরি ফর অস্ট্রেলিয়া বাই জাস্ট সেভেন রানস’
দ্বিতীয় শিরোপার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১২ বছর। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানকে হারিয়ে স্টিভ ওয়াহ এনে দেন অজিদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। সেখান থেকেই শুরু অজিদের দাপট। লর্ডসের বারান্দায় ট্রফি নিয়ে শেন ওয়ার্ন-ওয়াহ ব্রাদার্সের উল্লাস হয়তো সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছিল।
২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে, দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে দর্শনীয় এক সেঞ্চুরি করেন অধিনায়ক রিকি পন্টিং। ১৯৮৩’র চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে দেশকে জেতান তৃতীয় বিশ্বকাপ।
২০০৭ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বিশ্বকাপ জেতার হ্যাটট্রিক করে অস্ট্রেলিয়া। সেই আসরে শ্রীলংকাকে হারিয়ে টানা তৃতীয় এবং সব মিলিয়ে চতুর্থ বিশ্বকাপ জিতে দলটি। অধিনায়কের আর্মব্যান্ড তখনো রিকি পন্টিংয়ের বাহুতে। অস্ট্রেলিয়ার সেই দলটাতে ছিলেন ম্যাথু হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মাইকেল ক্লার্ক, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, মাইকেল হাসির মতো দারুণ সব ক্রিকেটার। তাদের দক্ষ হাতে সামলেছেন পন্টিং, সব তারকাকে মিলিয়েছেন এক সূত্রে। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।
২০১১তে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। টানটান উত্তেজনার কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হেরে বাদ পড়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দলটি। তবে ২০১৫ সালের সেমিফাইনালে ভারতকে হারিয়েই ফাইনালে উঠে অস্ট্রেলিয়া।
২০১৯ বিশ্বকাপটাও ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল অজিদের। রাউন্ড রবিন ফরম্যাটের এই বিশ্বকাপে নয় ম্যাচের সাতটাতে জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয় তাদের। তবে সেই হার্ডলটা পার হতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডের পেসারদের তোপে শুরুতেই ধ্বসে পড়ে তাদের ব্যাটিং অর্ডার। ২২৩ রানে আটকে যায় ইনিংস। জেসন রয়, জো রুট, ইয়োন মরগ্যানদের ব্যাটিংয়ে ১৮ ওভার হাতে রেখে আট উইকেটে জিতে স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
কে জানে, ফাইনালে উঠলে ইংল্যান্ডের পরিবর্তে হয়তো বিশ্বকাপ জিততো অস্ট্রেলিয়া, ক্যাবিনেটে উঠতো ষষ্ঠ বিশ্বকাপ!
অবশ্য ইংল্যান্ড-নিউ জিল্যান্ড যে অবিশ্বাস্য ফাইনাল উপহার দিয়েছে, তাতে করে অস্ট্রেলিয়া ভক্তদের আফসোস আছে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন থেকে যায়, অস্ট্রেলিয়া এমন ফাইনাল উপহার দিতে পারতো কি?
সে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজি। বিশ্বকাপের বিশাল সমুদ্রে ডুব দিলে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখ ধাঁধিয়ে দিবে অস্ট্রেলিয়া নামের সবচেয়ে দামী মুক্তোটাই।
সব দলের জন্যই বিশ্বকাপ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার জন্য তা চ্যালেঞ্জ ছাপিয়ে লেগ্যাসি বা উত্তরাধিকারের পরম্পরা বজায় রাখার একটা ব্যাপারও বটে। রেকর্ড, পরিসংখ্যান, ইতিহাসেও তা লেখা আছে। ১৯৮৭ সালে যে লেগ্যাসিটা শুরু করে গেছেন অ্যালান বোর্ডার। হাতবদল হয়ে সেটার মশালবাহক হয়েছেন স্টিভ ওয়াহ-রিকি পন্টিং-মাইকেল ক্লার্করা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসকে তারা করেছেন আরো সমৃদ্ধ। কয়েকটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে অজিদের দাপট দেখে। ক্রিকেট মাঠে তাদের পতাকাটা সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে দেখে, তাদের সাফল্যের সুবাতাস গায়ে মেখে।
অগ্রজদের রেখে যাওয়া লেগ্যাসিকে বুকে ধারণ করে এভাবেই ছুটে চলেছে ‘মাইটি অস্ট্রেলিয়া’। কখনো ঝড়ো হাওয়ার বেগে, কখনো টর্নেডো হয়ে। প্রতিপক্ষ হিসেবে যে-ই এসেছে, দুমড়েমুচড়ে গেছে। সেই ছুটে চলার শেষ সাক্ষী হয়ে আছে এমসিজি, নিউ জিল্যান্ড আর এমসিজির ৯৩ হাজার দর্শক।