ছয় সপ্তাহে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে পর্দা নেমেছে এবারের বিশ্বকাপের। ব্যাটে-বলের দুরন্ত লড়াইয়ে এবার নজর কেড়েছেন অনেকেই, রেকর্ড ভাঙা-গড়ার নানা ঘটনাও ঘটেছে এবারের আসরেই। সাকিব, উইলিয়ামসন, রোহিত, স্টার্করা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে গড়েছেন নানা মাইলফলক। তবে সবার জন্য এই আসর সুখকর ছিল না, বেশ কিছু খেলোয়াড়ের জন্য এবারের বিশ্বকাপ ছিল প্রচণ্ড হতাশাজনক। এমন খেলোয়াড়দের নিয়েই রোর বাংলার পক্ষ থেকে একটি ফ্লপ একাদশ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। চলুন দেখা যাক, কোন এগারোজন দুর্ভাগা সেই একাদশে জায়গা পেলেন।
১. তামিম ইকবাল
৮ ইনিংসে ২৯.৩৮ গড়ে ২৩৫ রান। তামিম ইকবালের কাছে খুব খারাপ রেকর্ড না হলেও আমরা যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই তুলনায় এই পারফরম্যান্স এককথায় হতাশাব্যঞ্জক। কত রান করেছেন, তার চেয়ে বড় কথা, রানবন্যার এই বিশ্বকাপে এই রান তিনি করেছেন মাত্র ৭১.৬৫ স্ট্রাইক রেটে। যেখানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ম্যাচে রানের বন্যা হয়েছে, সেখানে তামিমের এই ধীরগতির খেলা দলের অন্যদের উপর চাপ বাড়িয়েছে।
ধীরগতির সূচনা করে পরে বড় ইনিংস খেলে পুষিয়ে দিলে অবশ্য সেটা নিয়ে কারো আপত্তি থাকতো না। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, তামিম এবার সেই অর্থে বড় ইনিংসও খেলতে পারেননি। পুরো আসরে তার ফিফটি মোটে একটি! যখনই বেশ কিছু ডট বল দিয়ে আস্তে আস্তে উইকেটে থিতু হয়েছেন, তখনই অদ্ভুতুড়ে সব শট খেলে নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। শেষ তিন বছরে তামিমের যে ঈর্ষণীয় রেকর্ড ছিল, তার পাশে এবারের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স একেবারেই বেমানান। তাই পরিসংখ্যানের বিচারে সৌম্যর রেকর্ড তামিমের চেয়ে খারাপ হলেও আমাদের এই ফ্লপ একাদশে আমরা তামিমকেই বেছে নিলাম।
২. ফখর জামান
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৭ সালে পাকিস্তান যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল, তাতে বড় অবদান ছিল ফখর জামানের। বিশেষ করে ফাইনালে অনবদ্য এক সেঞ্চুরি করে বলতে গেলে একাই ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিলেন এই মারকুটে ওপেনার। দুই বছর বাদে, সেই একই দেশে বিশ্বকাপ, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদটাও বেশ উঁচুতে ছিল।
কিন্তু পুরো আসরে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে সেই প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও পূরণ করতে পারেননি এই তিনি। আট ম্যাচে করেছেন মাত্র ১৮৬ রান, গড় ২৩.২৫! পুরো আসরে ফিফটি করেছেন মোটে একটি, সর্বোচ্চ ৬২ রান। এই জঘন্য পারফরম্যান্সের পর ফখরকে ছাড়া কোনো ফ্লপ একাদশ হলে সেটাই হতো অবাক করার মতো ব্যাপার।
৩. মার্টিন গাপটিল
গত আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন মার্টিন গাপটিল। বিশ্বকাপের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও গত আসরে গড়েছিলেন এই ওপেনার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এবার দশ ইনিংস খেলে তিনি যে রান করেছেন, সেটা গত আসরে উইন্ডিজের বিপক্ষে করা ২৩৭ রানের চেয়েও কম!
পুরো আসরে ২০.৬৭ গড়ে করেছেন মাত্র ১৮৬ রান। ভাগ্যিস, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৭৩ রানে অপরাজিত ছিলেন, নইলে এই রেকর্ডটা আরো ভয়াবহ দেখাত! পুরো আসরের ব্যর্থতা ভুলে নায়ক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সুপার ওভারের শেষ বলে, কিন্তু সেখানেও প্রয়োজনীয় ২ রান নিতে ব্যর্থ তিনি। গাপটিল যদি জ্বলে উঠতেন, তবে উইলিয়ামসন আর টেইলরের উপর চাপটা অনেকখানি কমে যেত। তাই দুর্দান্ত ফিল্ডিং করা সত্ত্বেও তাকে এই একাদশে রাখতেই হচ্ছে।
৪. কুশল মেন্ডিস
তাকে দলে রাখার জন্য অভিজ্ঞ দিনেশ চান্দিমালকে বাদ দিয়েছিলেন নির্বাচকরা। অথচ নির্বাচকদের সেই আস্থার বিন্দুমাত্র প্রতিদান দিতে পারেননি কুশল মেন্ডিস, ৭ ইনিংস খেলে ২০.৭৩ গড়ে করেছেন মাত্র ১৪৩ রান, স্ট্রাইক রেট ৬৭.১৪! পুরো আসরে একবারও ফিফটির দেখা পাননি এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। সব মিলিয়ে যা অবস্থা, তাতে তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারটাই বিশাল এক প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল।
৫. মার্কাস স্টয়নিস
স্টয়নিস যখন প্রথম দলে এলেন তখন তাকে অনেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসের সাথে তুলনা করেছিলো! দুর্দান্ত ব্যাটিং স্কিল সাথে পুরোদস্তুর গতিতে বল করার ক্ষমতা– সবমিলিয়ে তাকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখাটাও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এই কারণে পারফরম্যান্স আহামরি কিছু না হওয়া সত্ত্বেও তাকে টানা সুযোগ দিয়ে বিশ্বকাপে নিয়ে এসেছিলো নির্বাচকরা।
কিন্তু নির্বাচকদের সেই আশার মূল্য কি দিতে পেরেছেন স্টয়নিস? বল হাতে ৭ উইকেট তার পক্ষে রায় দিলেও ব্যাট হাতে তার পরিসংখ্যান রীতিমত ভয়াবহ। ৭ ইনিংস খেলে ১৪.৫ গড়ে করেছেন মাত্র ৭৬ রান, সর্বোচ্চ মাত্র ২২ রান! তাকে যেখানে একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেখানে তার স্ট্রাইক রেট মাত্র ৭৭! সেমিফাইনালে যেভাবে শূন্য রানে আউট হয়ে দলকে খাদের কিনারায় পাঠিয়েছেন তারপর তাকে এই একাদশে না রাখার কোনো কারণই নেই।
৬. সরফরাজ আহমেদ (উইকেটরক্ষক)
একাদশ যখন বানানো হচ্ছে তখন তাতে তো একজন উইকেটরক্ষকও আবশ্যক। এই পজিশনে দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যে লড়াই হয়েছে– টম লাথাম আর সরফরাজ আহমেদ। পরিসংখ্যানের বিচারে লাথামের পারফরম্যান্সই বেশি হতাশাজনক, কিন্তু ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৪৭ রান করায় তাকে রেহাই দিয়ে এই একাদশে সরফরাজকেই জায়গা দেওয়া হলো।
পাকিস্তানের অধিনায়ক ব্যাট হাতে ২৮.৬ গড়ে করেছেন ১৪৩ রান। উইকেটের পেছনে তার পারফরম্যান্সও ছিল হতাশাজনক, বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং মিস করেছেন তিনি। আর অধিনায়ক হিসেবে নেতিবাচক কিছু ভূমিকার কারণে তো পুরো ক্রিকেটবিশ্বের কাছেই হয়েছেন হাসির পাত্র। তাই সবমিলিয়ে এই একাদশে সরফরাজের একটি জায়গা প্রাপ্য।
৭. থিসারা পেরেরা
৯ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন থিসারা পেরেরা, স্বাভাবিকভাবেই এই বিশ্বকাপে তাকে নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রত্যাশাও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সবমিলিয়ে জঘন্য একটা আসর পার করেছেন এই অলরাউন্ডার। ৬ ম্যাচে ১০.১৭ গড়ে রান করেছেন মাত্র ৬১! বোলিংয়েও হতাশ করেছেন এই পেসার, পুরো আসরে নিয়েছেন মোটে একটি উইকেট। সাত নম্বরে এই আসরে যতজন খেলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিসংখ্যান থিসারার, তাই এই একাদশে তার থাকাটাই স্বাভাবিক।
৮. জীবন মেন্ডিস
আকিলা ধনঞ্জয়কে বাদ দিয়ে ঠিক কোন যুক্তিতে জীবন মেন্ডিসকে দলে নেওয়া হলো তা নিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বেশ শোরগোল উঠেছিলো, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার উপর ভালো কিছু করার জন্য আলাদা একটা চাপ ছিল। কিন্তু সেই চাপেই কি না স্মরণকালের অন্যতম জঘন্য পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন এই লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার! তিন ম্যাচে ৬.৩৩ গড়ে করেছেন মাত্র ১৯ রান আর বল হাতে উইকেট নিতে পারেননি একটিও! সবমিলিয়ে এই বিশ্বকাপটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে জীবন মেন্ডিসের জন্য।
৯. মাশরাফি বিন মর্তুজা (অধিনায়ক)
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে বড় কিছু করার যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছিলো তা মূল কারণ ছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার অসাধারণ নেতৃত্ব। ২০১৫ সালের পর থেকে তার নেতৃত্বেই দারুণ সময় পার করেছে টাইগাররা, অধিনায়কত্ব ছাড়া বল হাতেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
কিন্তু বিশ্বকাপে সবকিছুই যেন ওলটপালট হয়ে গেলো, পুরো আসরে ভয়াবহ খারাপ বোলিং করে মাত্র একটি উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি! বিশ্বকাপ ইতিহাসে ন্যূনতম এক উইকেট নিয়েছে এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে এক আসরে সবচেয়ে খারাপ বোলিং গড়ের রেকর্ডটাও এখন নড়াইল এক্সপ্রেসের, এই আসরে তার বোলিং গড় ৩৬১! অতীতে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সব ক্যামিও খেলা মাশরাফি এই আসরে ব্যাট হাতেও ছিলেন বিবর্ণ। আর যে অধিনায়ত্ব নিয়ে এত প্রশংসা সেখানেও বেশ কিছু ভুল করেছেন এই বর্ষীয়ান খেলোয়াড়। তাই সবমিলিয়ে বিশ্বকাপের ফ্লপ একাদশে তাকেই অধিনায়ক হিসেবে রাখা হলো।
১০. হাসান আলি
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছিলেন হাসান আলি, পুরো আসরে তার অনবদ্য বোলিং দেখে মনে হয়েছিলো পাকিস্তান বুঝি দারুণ এক পেসার পেতে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বকাপে সেই ফর্মের ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি, ৪ ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র ২ উইকেট আর উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ১২৮ রান! এই পারফরম্যান্সের কারণে পরে আর মূলে একাদশেই সুযোগ পাননি হাসান আলি, তবে পাকিস্তানের একাদশে সুযোগ না পেলেও আমাদের এই ফ্লপ একাদশে সুযোগটা ঠিকই পাচ্ছেন তিনি।
১১. শ্যানন গ্যাব্রিয়েল
টেস্টে অসাধারণ সময় পার করার পুরস্কার হিসেবে এবারের বিশ্বকাপ দলে গ্যাব্রিয়েলকে জায়গা করে দেয় ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। তবে টেস্টের মতো ওয়ানডেতে সাফল্যের দেখা পাননি তিনি, তিন ম্যাচে সুযোগ পেয়ে উইকেট নিয়েছেন মাত্র দুটি! উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ৮৬.৫ রান আর ইকোনমি রেট ৮.৪৪। টেস্ট আর ওয়ানডেতে যে বিস্তর তফাৎ আছে সেটা গ্যাব্রিয়েলের পারফরম্যান্স দেখেই হয়তো হাড়ে হাড়ে টের পেলো উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড।
এছাড়াও বেশ কিছু খেলোড়াড়ের জন্য এই বিশ্বকাপ কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো, যেমন ধরা যাক ক্রিস গেইলের কথা। নিজের শেষ বিশ্বকাপটা স্মরণীয় কিছু করে রাঙিয়ে দেবেন এমটাই প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আট ইনিংসে ব্যাট করে ৩০.২৫ গড়ে করেছেন ২৪২ রান, যা তার নামের পাশে বেশ বেমানান। তিনি জ্বলে উঠতে পারলে উইন্ডিজদের আর নয় নাম্বারে থেকে গ্রুপ পর্ব শেষ করা লাগতো না। আরেকজন লিজেন্ডারি ব্যাটসম্যানের শেষ বিশ্বকাপটাও সুখকর ছিল না, তিনি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা। ৪০ গড়ে রান তুললেও ৬০.৪ স্ট্রাইক রেট এই যুগের সাথে কোনোভাবেই যায় না। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপে এমন ভরাডুবির অন্যতম কারণ আমলার জ্বলে উঠতে না পারা।
সতীর্থ মার্কাস স্টয়নিসের অভাবনীয় ব্যর্থতার কারণে এই একাদশে আসতে পারেননি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, নইলে তার যে ধরনের পারফরম্যান্স ছিল তাতে খুব সহজে তাকেও এই ফ্লপ একাদশে রাখা যেতো। ১০ ইনিংস খেলে করেছেন ১৭৬ রান, গড় মাত্র ২২! বেশ কিছু ম্যাচে তাকে উপরের দিকে ব্যাট করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে পারেননি। আরেকজন অজির জন্যও এই বিশ্বকাপ ছিল হতাশাজনক, তিনি লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করায় তাকে ঘিরে এই বিশ্বকাপে অনেক আশা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। তবে সেই আশা পূরণে ব্যর্থ তিনি, ৪ ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র ৫টি উইকেট আর ইকোনমি রেট ৭.১৫! এমন পারফরম্যান্সের কারণে তাকে আর পরবর্তী কোনো ম্যাচে সুযোগই দেয়নি অস্ট্রেলিয়া।