কানাডার নাগরিক টেরি ফক্স ক্যান্সার গবেষণার সুবিধার্থে ফান্ড জোগাড় করতে চেয়েছিলেন এক পায়ে পুরো কানাডা দৌড়ে। একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি এর চেয়ে অভিনব উপায় আর কী-ইবা বের করতে পারতেন!
টেরি ফক্স এক পায়ে দৌড়াতে চেয়েছিলেন তার ভালোলাগা থেকে, মানসিক প্রশান্তির জন্য। তিনি কাজটি করেছিলেন, কারণ এটা করে তিনি আনন্দ পেতেন। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে কানাডার ম্যাপ নিয়ে ‘ম্যারাথন অফ হোপ’ লেখা একটি সাদা রঙের গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে দৌড়ানো শুরু করতেন। তার কৃত্রিম পা পুরোপুরি দেখা যেতো হাফ প্যান্টের নিচ দিয়ে, কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বরং তিনি এই অক্ষমতাকে তার বিশেষ সত্ত্বা হিসেবে ধারণ করে নিয়েছিলেন। কানাডার মানুষগুলো বুঝতে পেরেছিল ম্যারাথনের প্রতি ফক্সের ভালোবাসা কত বেশি, তাইতো সবসময় তাকে উৎসাহিত করেছে তারা। তিনি যখন জীবনের শেষ মাইলটুকু দৌড়ান, তখনও হাজার হাজার মানুষ তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে দৌড় চালিয়ে যেতে। কিন্তু অসুস্থতার কাছে বন্দী পড়ে যায় তার স্বপ্ন।
১৯৫৮ সালের ২৮ জুলাই, টেরি ফক্স কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের উইনিপেগ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কোঁকড়া চুলের একজন চনমনে, হাস্যোজ্জ্বল ও জেদি ক্রীড়াবিদ। একসময় তিনি হার মেনে নিতে বাধ্য হন অসুখের কাছে। অসুস্থতার কারণে পূরণ করতে পারেন না তাঁর স্বপ্ন। কিন্তু হিরো হিসেবে জায়গা করে নেন প্রতিটি কানাডিয়ানের মনে। কেমন ছিল টেরি ফক্সের সাধারণ একজন ক্রীড়াবিদ থেকে এক পা-বিহীন হিরো হয়ে ওঠার গল্প, আসুন জানি।
টেরি ফক্স স্কুলজীবনে ফুটবল, বাস্কেট বল ও রাগবি খেলতেন। তবে বাস্কেট বলের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। কিন্তু অল্প উচ্চতার (৫ ফুট) কারণে কখনও ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারেননি পছন্দের এই খেলায়। তবে টেরির দৌড়ানোর পারদর্শিতা চোখ এড়ায়নি বাস্কেট বল কোচের। তাই টেরি যখন অষ্টম শ্রেণিতে, তখন তাকে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পরামর্শ দিলেন সেই কোচ। শিক্ষককে সম্মান করতে জানতেন টেরি ফক্স; অনিচ্ছা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করেন দৌড় প্রতিযোগিতায়। তবুও কমাতে পারলেন না বাস্কেট বলের প্রতি তার প্রবল ভালোবাসা। লেগে থাকলেন স্কুলের বাস্কেট বল দলের সাথে। যখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে, তখন সবাইকে অবাক করে বন্ধু ডৌঘ অলওয়ার্ডের সাথে যুগ্মভাবে পুরস্কার অর্জন করলেন বাস্কেট বল খেলায়।
স্কুলজীবন শেষ করে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পালা। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি যে বিশেষ কোনো আগ্রহই নেই টেরির! তার সকল আগ্রহ ঘিরে আছে, প্রিয় খেলা বাস্কেট বল। টেরির মা বললেন, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে। তাই তিনি ভর্তি হলেন সিমন ফ্রাসার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কিনেসিওলোজি (শরীর নড়াচড়া বিষয়ক বিজ্ঞান) বিষয়ে লেখাপড়া করতে শুরু করলেন, লক্ষ্য ছিল পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়া। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেট বল টিমের সাথে প্রিয় খেলাটাও চালিয়ে যেতে লাগলেন।
বেশ ভালোই দিন কাটছিল তার। ১৯৭৭ সালে হঠাৎ টেরি ফক্সের পায়ের হাড়ে ক্যান্সার ধরা পড়ল। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর, পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে। সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ উঁকি দিচ্ছে, এমন সময় মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন প্রাণচঞ্চল মানুষটি। কাটা পড়ল হাঁটুসহ ডান পায়ের ছয় ইঞ্চি অংশ, লাগানো হলো কৃত্রিম পা। পুরোপুরি সুস্থ হতে তাকে কেমোথেরাপি নিতে হলো। তবুও ভেঙে পড়েননি এই ম্যারাথনের রাজা, লড়াই করে গেছেন।
অপারেশনের একদিন আগে টেরি ফক্স জানতে পারেন, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের ডিক ট্রমের কথা, যিনি কিনা এক পা নিয়েই ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবেই টেরির স্কুল বাস্কেট বল কোচ, টেরি ফ্লেমিং তাকে নতুন উদ্যম দেয় জীবনে থেমে না থাকার।
সফল অপারেশনের পরেও টেরিকে এক বছর চারমাস হাসপাতালে থাকতে হয় সুস্থ হয়ে উঠার জন্য। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি মোটেও। চিকিৎসা চলাকালীন অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাকে। ডাক্তারদের মতে, তার বেঁচে না থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি, শতকরা ৮৫ ভাগ। কিন্তু, সকলের জন্য যে প্রাণ নিবেদিত, তা কি এত সহজে ঈশ্বর কেড়ে নিতে পারেন? টেরি অনেকটা সেরে উঠলেন এবং দৌড়ানোর জন্য বিজ্ঞাপনী উদ্যোক্তাদের আবেদন করে একটি চিঠি লিখলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পেলেন না। তবে টেরিকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন বন্ধু, রিক হানসেন। হুইল চেয়ারে বাস্কেট বল খেলার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করলেন তারা।
এভাবেই অপারেশনের দুই বছর পর্যন্ত প্রিয় বাস্কেট বল নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন । কিন্তু তিনি টেরি। তখনও ডিক ট্রমের কথা ভুলতে পারেননি, নতুন করে দৌড়ানোর স্বপ্ন ভুলতে পারেননি। একদিন তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন। রাতের অন্ধকারে দৌড়ালেন আধ মাইল, যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। কিন্তু তার স্কুলের এক শিক্ষক, যিনি কিনা এই মরণব্যাধি সেরে কেবলমাত্র উঠেছেন এবং টেরির মতোই কৃত্রিম পা ব্যবহার করেন; শুনে ফেললেন টেরির দৌড়ানোর শব্দ। যেহেতু কৃত্রিম পায়ের শব্দ তার অতি পরিচিত, তাই তার বুঝতে বাকি রইল না যে কী ঘটছে। তবে টেরির শিক্ষক তখনও জানতেন না, টেরি ফক্স দৌড়াচ্ছেন। এভাবে শুরু হয় টেরি ফক্সের এক পায়ে ম্যারাথন যাত্রা।
ক্যান্সার গবেষণার জন্য ফান্ডের সিদ্ধান্ত যেভাবে নিলেন
১৫ মাস ধরে দৌড়ানোর প্রশিক্ষণ নিলেন টেরি। এবারে বাবা-মাকে জানালেন, তিনি পুরো কানাডা দৌড়াতে চান। বাবা-মা তাকে বাধা দেননি। এরপর তিনি কানাডার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রে তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তারা জানত, টেরি দৌড়াতে পারবেন না কিন্তু তিনি থেমেও থাকবেন না। তাই টেরি ফক্সকে কোনো বিজ্ঞাপন উদ্যোক্তার সাথে এক মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে তারপর দৌড়ানোর পরামর্শ দেয় কানাডার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে টেরি বিজ্ঞাপন উদ্যোক্তাদের কাছে থেকে এক মিলিয়ন ডলারের ফান্ড যোগাড় করে ফেলেন। এবং ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে, ২১ বছর বয়সে কানাডার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের উন্নতির লক্ষ্যে এক মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে ফক্স দৌড়ানো শুরু করেন।
টেরি কানাডার সর্ব পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত নিউফাউন্ডল্যান্ড রাজ্যের সেন্ট জন’স শহর থেকে দৌড়ানো শুরু করেন। ১৪৩ দিনে ৩৩৩৯ মাইল ও ৬টি প্রদেশ দৌড়ান। অসহ্য গরম থেকে হাড় কাঁপানো শীত কিছুই থামাতে পারেনি আশার এই ম্যারাথনটি। কিন্তু হঠাৎ কাশি শুরু হয় টেরির! থান্ডার বে থেকে ১৮ মাইল পার হওয়ার পর যদিও কাশি থেমে যায়, কিন্তু দিয়ে যায় অসহনীয় বুক ব্যথা। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। কানাডার হাজার হাজার মানুষ যারা “তুমি পারবে টেরি” বলে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, তাদের আশা ও বিশ্বাস নষ্ট করেননি। দৌড়াতে থাকেন অসহনীয় বুক ব্যথা নিয়ে। সকল শোরগোল পেছনে ফেলে দৌড়ে যান, যতক্ষণ না আশাবাদী মানুষগুলোর চোখের আড়াল হতে পারছেন। এরপর তিনি বন্ধু অলওয়ার্ডকে বলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। হাসপাতালে নেওয়া হলে জানা যায়, ক্যান্সার তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেছে।
এবারে তিনি এই মরণব্যাধিকে পরাজিত করতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ক্যান্সার গ্রাস করে নেয় এক পায়ের হিরো টেরি ফক্সকে। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে তিনি কানাডার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড তৈরি করে গেছেন। এবং মৃত্যু পরবর্তীকালে অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হন আশার ম্যারাথনের এই জনক এবং ১৯৮৩ সালে তাকে নিয়ে সিনেমাও বানানো হয়। নিচে সিনেমাটির ইউটিউব লিংক দেওয়া হলো।