বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সপ্তম আসরের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবি। গত ১০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) মিটিংয়ের পর বিসিবি পরিচালক মাহবুব আনামের ঘোষণা করা উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে:
১. ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বোলিং করতে পারেন, এমন বিদেশি ফাস্ট বোলার থাকতে হবে।
২. প্রতিটি দলে নিয়োগ দেয়া হবে বিদেশি হেড কোচ। দলগুলোর ফিজিও, ট্রেনাররাও হবেন বিদেশি।
৩. দেশীয় কোচরা হতে পারবেন সহকারী কোচ।
৪. প্রতি দলে একজন করে লেগ স্পিনার খেলাতেই হবে। তাকে বাধ্যতামূলকভাবে একাদশে রাখতে হবে, এবং ৪ ওভার বোলিং করাতে হবে।
৫. প্রতিটি দলের টিম ডিরেক্টর হবেন বিসিবির বোর্ড পরিচালকরা।
শুধু এসবই নয়, বিপিএলের সপ্তম আসর, তথা বঙ্গবন্ধু বিপিএলে দলগুলোর জন্য বেশ কিছু নিয়ম বেঁধে দিচ্ছে বিসিবি। বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে অনেক নিয়ম। লেগ স্পিনার রাখা, গতিময় বিদেশি ফাস্ট বোলার আনার সঙ্গে বিপিএলে দেশীয় কোচদের অসম্মান করার মতো ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে বিসিবি।
অতীতে বিপিএলের প্রতিটি আসরেই দেশীয় কোচরা কয়েকটি দলের হেড কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের হাত ধরে সাফল্যও পেয়েছে বিসিবি। কিন্তু সপ্তম আসরে ‘বিশেষ’ করার পরিকল্পনায় দেশীয় কোচদের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন বিসিবি পরিচালকরা, যেখানে সাত দলের কোনোটিতেই দেশীয়রা হেড কোচ হতে পারবেন না। সব দলেই থাকবেন বিদেশি কোচ, এবং তাদের সহকারী হিসেবে কাজ করবেন স্থানীয়রা। দলগুলোর ফিজিও, ট্রেনাররাও হবেন বিদেশি।
দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থার এমন সিদ্ধান্তে হতাশ দেশীয় কোচরা। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় কোচদের জন্য রীতিমতো অসম্মানজনক। এবং দেশীয় কোচদের উন্নতির পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ালো। এর মাধ্যমে খোদ বিসিবিই ঘোষণা করল, দেশে ভালো মানের কোচ নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ কেউ বলছেন, ভবিষ্যতে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও বিদেশি কোচ বাধ্যতামূলক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অথচ পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই দেশীয়রা
বিপিএলের ছয় আসরে এখনো পর্যন্ত টম মুডি, ওয়াকার ইউনুস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, ডেভ হোয়াটমোর, ডিন জোন্স, ল্যান্স ক্লুজনার, মিকি আর্থারের মতো অনেক নামীদামি কোচ কাজ করে গেছেন। বিপিএলের পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশিদের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই দেশীয় কোচরা। বরং ট্রফি জয়ের সমীকরণে দেশি-বিদেশিদের অবস্থান এখনও সমান (৩-৩)।
টুর্নামেন্টের আগের ছয় আসরের তিনটিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দেশীয় কোচদের পরিচালিত দল। মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের অধীনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দুইবার (২০১৫, ২০১৯), খালেদ মাহমুদ সুজনের অধীনে ঢাকা ডায়নামাইটস (২০১৬) একবার ট্রফি জিতেছিল। সারোয়ার ইমরানের কোচিংয়ে দু’টি দল বিপিএলের ফাইনাল খেলেছিল। ২০১২ সালে বরিশাল বার্নাস ও ২০১৬ সালে রাজশাহী কিংস ফাইনালে উঠেছিল সারোয়ার ইমরানের কোচিংয়ে। এছাড়া মিজানুর রহমান বাবুল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সে, সিলেট সিক্সার্সে কোচিং করিয়েছেন জাফরুল এহসান।
বিদেশি হাই প্রোফাইল কোচরা দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে পেরেছেন তিনবার। ইংলিশ কোচ ইয়ান পন্ট ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে দুইবার (২০১২, ২০১৩), অস্ট্রেলিয়ান টম মুডি রংপুর রাইডার্সকে (২০১৭) একবার শিরোপা এনে দিয়েছেন।
দেশীয় কোচদের জন্য অসম্মানজনক: নাজমুল আবেদীন ফাহিম
বাংলাদেশের ক্রিকেটে নাজমুল আবেদীন ফাহিমের নামটি সর্বজনবিদিত। মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। নিজেদের দুঃসময়ে, উন্নতির প্রচেষ্টায় সবসময় নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে ডেকে থাকেন তামিম-মুশফিকরা। বিসিবি হাজার হাজার ডলার খরচ করে বিদেশি কোচ রাখলেও প্রায়ই তারকা ক্রিকেটারদের নেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বর্ষীয়ান এই কোচকে। সম্প্রতি বিসিবির চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিকেএসপিতে যোগ দিয়েছেন প্রখ্যাত এই কোচ।
বিপিএলে দেশীয়দের হেড কোচ হওয়ার পথ করে দেয়া সম্পর্কে প্রথিতযশা এই কোচ বলেছেন,
‘এটা দেশীয় কোচদের জন্য অসম্মানজনকও বটে। এর মাধ্যমে আমরা ঘোষণা করলাম যে, আমাদের এখানে ভালো মানের কোচ নেই। এখানে প্রতি আসরে কয়েকজন দেশীয় কোচ কাজ করত। ইমরান (সারোয়ার ইমরান), সুজন (খালেদ মাহমুদ সুজন), সালাউদ্দিনরা (মোহাম্মদ সালাউদ্দিন), বাবুল (মিজানুর রহমান বাবুল), এহসানরা (জাফরুল এহসানরা) কাজ করেছে। এর মাধ্যমে দেশীয়দের কাজ করার সুযোগটা বন্ধ করা হলো। কোচদের উন্নতির পথও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এটা খুবই হতাশাজনক, অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত।’
দেশীয় কোচদের তৈরি করাও বিসিবির দায়িত্ব, স্মরণ করিয়ে দিয়ে নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেছেন,
‘দেশীয় কোচদের তৈরি করা কিন্তু বিসিবিরই দায়িত্ব। শুধু কোচ নয়, ফিজিও-ট্রেনার এদের তৈরি করাও বোর্ডের দায়িত্ব। কোচিং স্টাফদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রয়েছে বোর্ডের। এজন্য ভালো জায়গায় কাজের সুযোগ দিতে হবে। একটা টুর্নামেন্ট হয়তো আপনি বিদেশি কোচ দিয়ে করলেন। ঘরোয়া সব টুর্নামেন্ট পারবেন না।’
এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব: সরোয়ার ইমরান
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্রান্তিকালের ত্রাতা সরোয়ার ইমরান। দেশের ক্রিকেট যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই কোচ সারোয়ার ইমরানের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার হাত ধরে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে বহু পেস বোলার। মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ শরীফ, কামরুল ইসলাম রাব্বি, রুবেল হোসেন, তালহা জুবায়ের, তাপস বৈশ্য, শফিউল ইসলামদের মতো অগুণতি পেসারের গুরু তিনি। গত কয়েক দশকে দেশের পেস বোলার তৈরির কাজটা নিরলসভাবে করে গেছেন সারোয়ার ইমরান।
বিপিএলে দেশীয় কোচদের হেড কোচ না করার আলোচিত সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের কোচ সারোয়ার ইমরান বলেছেন, প্রিমিয়ার লিগেও বিদেশি কোচ দেখার অপেক্ষায় তিনি। নিজের প্রতিক্রিয়ায় দেশের কিংবদন্তিতুল্য এই কোচ বলেছেন,
‘আমাদের কিছু বলার নাই। এখন কোনদিন শুনব যে, ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগেও বিদেশি কোচ আনবে। সামনে প্রিমিয়ার লিগ, সেখানেও বিদেশি কোচ আনবে, এখন এটা শোনার অপেক্ষায় আছি।’
দেশীয়দের অবজ্ঞা করার এই চেষ্টা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব বলে জানালেন সরোয়ার ইমরান। বাংলাদেশের বহু পেস বোলারের গুরু অভিজ্ঞ এই কোচ বলেছেন,
‘এগুলো নিয়ে মন্তব্য করার ইচ্ছা নাই। আপনারা বুঝতেই পারেন যে, কোনো দেশে আছে কি এমন নিয়ম যে, লোকাল কোচরা হেড কোচ হতে পারবে না? পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।’
ক্ষুদ্ধ সালাউদ্দিন বলছেন, বিদেশি পরিচালকও আনা হোক
বিপিএল-ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তার সাফল্য প্রমাণিত। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের গুরু হিসেবে ক্রিকেটবিশ্বে পরিচিত মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সাকিবের ছেলেবেলার কোচ পরিচয়টাই সালাহউদ্দিনের জন্য যথেষ্ট। কারণ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জন্ম নেয়া সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সাকিব। এবং সবসময়ই এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের আস্থার আশ্রয় সালাহউদ্দিন।
বিপিএলে দু’টি ট্রফি জয়ের গৌরব রয়েছে তার ভাণ্ডারে। এখনও তামিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের ব্যাটিং পরিচর্যায় নেটে ডাক পড়ে সালাউদ্দিনের। বিপিএলের সাত দলে বিদেশি কোচ বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন জাতীয় দলের সাবেক এই সহকারী কোচ।
ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে বিসিবিতে বিদেশি পরিচালক আনার প্রস্তাবও করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক স্ট্যাটাসে সালাহউদ্দিন লিখেছেন,
‘সব বিদেশি আসবে, ভাল কথা, কিন্তু কেন কোনো বিদেশি পরিচালক আনবেন না? কোচ, ট্রেনার, ফিজিও, খেলোয়াড় কেউই আন্তর্জাতিক মানের না, তাইলে আপনারা নিজেদের আন্তর্জাতিক মানের ভাবেন কেমনে, আপনারাও আমাদের মতোই। আপনাদেরও উচিত বিদেশি পরিচালক নিয়া আসা।’
টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের পর প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে। এতদিনেও একজন আন্তর্জাতিক মানের কোচিং স্টাফ তৈরি করতে পারেনি বিসিবি। এই বিষয়টিকে অনেক বড় লজ্জার বলে মনে করেন সালাহউদ্দিন। বোর্ড পরিচালকদের তীব্র সমালোচনা করে সাকিব-তামিমদের গুরু লিখেছেন,
‘আজ নিজ দেশে যেন আমরা পরবাসী! অনেক বোর্ড পরিচালক ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বোর্ডে আছেন, এরা এখন পর্যন্ত একটাও আন্তর্জাতিক মানের কোচিং স্টাফ বের করতে পারেন না। এটাই তো তাদের জন্য অনেক বড় লজ্জার ব্যাপার! বোর্ডে দেশি যারা আমরা কোচিং করাই, ট্রেনার-ফিজিও, এমনকি গ্রাউন্ডসম্যানদের জন্যও আমার দুঃখ হয়, সারাজীবন এরা সাপোর্টিং রোলই করে যাবে, হিরোর রোল আর পাবে না!’
বঙ্গবন্ধু বিপিএলে বিশেষ আয়োজনের চিন্তায় বিসিবি যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার অনেকগুলোই বড় প্রভাব ফেলবে দেশের ক্রিকেটে। দেশীয় কোচদের হেড কোচ হওয়ার সুযোগ বন্ধ করাটা সন্দেহাতীতভাবে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে। হাতে গোনা কয়েকজন কোচই বিপিএলে প্রতি বছর কোচিং করান। অভিভাবক হয়েও দেশীয় কোচদের উন্নতির পথে খোদ বিসিবিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালেদ মাহমুদ সুজন-সালাউদ্দিনদের মতো পরীক্ষিতরা বিপিএলে সুযোগ না পেলে বৃহত্তর দিক থেকে ক্ষতিটা বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই। কারণ, আন্তর্জাতিক সিরিজের বাইরে সারা বছর দেশের ক্রিকেটারদের পরিচর্যা করেন তারাই।