এক অভিমানী কিংবদন্তীর প্রস্থানের গল্প

মেসেঞ্জারটি টুং টুং করে দুয়েকবার বেজে  উঠল। শুরুতে পাত্তা দেননি জাহিদ রেজা বাবু। একটু পরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টি খেলতে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। ফোকাসটা সেদিকেই। এবার মেসেঞ্জার থেকে সরাসরি ফোন। লেখা উঠেছে, কৌশিক। মাশরাফি বিন মুর্তজার ডাক নাম। দেখে হাসিমুখে ফোনটা তুললেন বাবু। মিনিট দুয়েকের আলাপে বদলে গেল তার চেহারা। যতটা পারছেন চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু কতটা স্বাভাবিক থাকতে পারেন চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামের এই কিউরেটর! মাশরাফি নাকি তাকে বলেছেন, যে ম্যাচটি একটু পর খেলতে নামছেন সেটিই বাংলাদেশের জার্সিতে তার শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ!

ক্যারিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে জয়ের পর মাশরাফি বিন মুর্তজা। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে সেদিন কী বলেছিলেন জানেনি কেউ; Source: AP

সেদিন কলোম্বোর আকাশ-বাতাসও যেন হাহাকার করছিল। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে হয়ত কিছু গাছের পাতা ঝরে পড়েছিল। হয়তো কয়েক হাজার মাইল দূরে এই বাংলাদেশের মানুষের আকুতিটাও পৌঁছেছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির হৃদয়ে। যান্ত্রিকতার রাজধানীতে যে গৃহিণী ক্রিকেটকে সন্তানের পড়াশোনার ক্ষতি হিসেবে দেখেন, তিনিও হয়তো বুঁদ হয়ে ছিলেন কিছু একটা হারানোর কষ্টে। না, মাশরাফি সেদিন শেষবারের মতো ক্রিকেটকে বিদায় বলেননি। কিন্তু ইঙ্গিতটা দিয়েছেন। ড্রেসিংরুমেও আলোচনা করলেন, সবাইকে জানাতেই শুরু হলো গাইগুই। কান্না আর অনুরোধের আসর কাটিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন তিনি। টসে নেমে জানিয়ে দিলেন এটাই তার শেষ টি-টোয়েন্টি।

কোচের চাওয়া তারুণ্য নির্ভর টি-টোয়েন্টি দল। তাই মাশরাফিকে ইঙ্গিত। নিজেকে যেন অনাহূত মনে করছিলেন বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক, পেসার ও অন্যতম এই কিংবদন্তী। তাই অবসরের কথা টসের আগপর্যন্ত সবাই জানলেও জানতেন না শুধু কোচ।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সদ্য সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের সঙ্গে মাশরাফি; Source: BCB

প্রিয় ‘মাশরাফি ভাই’য়ের শেষ টি-টোয়েন্টি মনে রাখার মতো করতে জান দিয়ে খেলেছিলেন সাকিব আল হাসান-মুস্তাফিজুর রহমানরা। ফলাফল, ৪৫ রানের জয় নিয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়লেন মাশরাফি। ২০ ওভারের ফরম্যাটে জাতীয় দলের ক্যারিয়ার থমকে গেল ৫৪ ম্যাচে ৪২ উইকেট আর ব্যাট হাতে ৩৭৭ রান নিয়ে। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট এই ফরম্যাটের বিচারে হয়তো কাগজে-কলমে পরিসংখ্যানের বিচারটা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু ম্যাচের ঘটনাপ্রবাহ আর অধিনায়ক হিসেবে তার রণপরিকল্পনা প্রমাণ করে তার সামর্থ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও তিনিই সবচেয়ে সফল।

সে কথা যাক। শেষ পর্যন্ত ড্রেসিংরুমের একটি দরজা বন্ধ করেই দেশে ফিরলেন মাশরাফি। নাটকের শুরু বিমানবন্দর থেকে। বোর্ড সভাপতি দাবি করলেন, অধিনায়কত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন মাশরাফি, পুরো ফরম্যাট থেকে নয়। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসেই নাজমুল হাসান পাপন বললেন, “মাশরাফি যতদিন ইচ্ছা ততোদিন খেলবে। তাকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো চিন্তা বোর্ডের নেই। মাশরাফির বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি। যেভাবে অধিনায়কত্ব করে যাচ্ছে, তাতে মাশরাফির বিকল্প খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।”

যদিও এসবে কান না দিয়ে ধৈর্য্য ধরলেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। অবশেষে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হলো সাকিব আল হাসানের হাতে। ইনজুরির কোণঠাসা দুর্ভাগ্যের কারণে আগেই সাদা পোশাককে অলিখিতভাবে বিদায় জানিয়েছেন তিনি। তাই জোর দিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটের দিকেই। ঢাকা ছেড়ে খুলনায় গিয়ে দীর্ঘদিন পর গায়ে জড়ালেন সাদা পোশাক। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেমে পড়লেন জাতীয় লিগের ম্যাচে। ইঙ্গিতটা হয়তো টেস্টে ফেরার।

মাঠে ঢুকে পড়া ভক্তকে নিরাপত্তাকর্মীর হাত থেকে বাঁচাতে মাশরাফির জোর চেষ্টা; Source: Getty image

যে কোচের কারণে বিসিবির চাপে পড়ে ২০ ওভারের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন মাশরাফি, সেই চন্দিকা হাতুরুসিংহেও পদত্যাগ করলেন পরের সিরিজ শেষে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে না এসে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে ছুটি কাটাতে গেলেন, সেখান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ তখন ব্যস্ত পঞ্চম আসরের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নিয়ে। তিনবারের টুর্নামেন্ট জয়ী অধিনায়ক মাশরাফি যেন এবার টি-টোয়েন্টির অলিগলি সব চিনিয়ে দিলেন রংপুর রাইডার্সের হয়ে। যেন বুঝিয়ে দিলেন, যাকে ‘বুড়ো’ বলে অবহেলা করেছ, সে মাথা নোয়াবার নয়। চিত্রা পাড়ের সেই দামাল ছেলেটি ঝড়ের গতির ফাস্ট বোলার থেকে মিডিয়াম পেসকে পরিণতি মেনেছে বটে, কিন্তু হার মানেনি। দুই পায়ে সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়েও যাকে থামানো যায়নি, তার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও সহজ কথা নয় তা বুঝিয়ে দিলেন পয়েন্ট টেবিল থেকে ছিটকে যাওয়া রংপুরকে শেষ চারে উঠিয়ে এনে।

প্রথম পর্বের ১২ ম্যাচের ১১ ম্যাচেই মাঠে নেমেছেন মাশরাফি। বল হাতে নিয়েছেন ১৩ উইকেট। বিপিএলের পঞ্চম আসরে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রহের তালিকায় তার অবস্থান ছয় নম্বরে। অন্যদিকে, ব্যাট হাতে তার মোট সংগ্রহ ২১.৮৩ গড়ে ১৩১ রান! সর্বোচ্চ ৪২ রানের একটি ইনিংস রয়েছে তার।

বিপিএলে রংপুরের হয়ে ম্যাচ জেতানোর পর কোচ টম মুডির সঙ্গে মাশরাফি; Source: BCB

এর মধ্যেই শুরু হলো তাকে ফেরানোর চেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিসিবির মধ্যেও গুঞ্জন, মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টিতে ফেরানো চাই। এমনকি বর্তমান অধিনায়ক সাকিবও মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি দলে চান বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম। রংপুরের হয়ে ৪২ রানের ঝড়ো ইনিংসের পর মাশরাফিকে গেইল বলেছিলেন, ‘আমি আজ মুর্তজা হয়ে গেলাম, মুর্তজা আজ গেইল হয়ে গেল’। কিন্তু মাশরাফি নিজে কী ভাবছেন? নাহ্‌! চিত্রা নদীর স্রোত যাকে টলাতে পারেনি, তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন এমনটা ভাবা সহজ নয়। কিন্তু তাকে হারিয়ে কতটা অথৈ সাগরে পড়ল বাংলাদেশ, সেটা হয়তো ড্রেসিংরুমের হাহাকারই বলে দেবে। যদিও সেটা সমর্থকদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের জার্সিতে মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের আদ্যোপান্ত

২০০৬ সালে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় মাশরাফি বিন মুর্তজার। ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত খেলেছেন ৫৪টি ম্যাচ। ব্যাট হাতে করেছেন ৩৭৭ রান, আছে সর্বোচ্চ ৩৬ রানের ইনিংস। উইকেট নিয়েছেন ৪২টি। সেরা বোলিং ফিগার ১৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট। ওয়ানডের মতো এই ফরম্যাটেও দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল তিনি। তার অধীনে বাংলাদেশ খেলেছে সর্বোচ্চ ২৮ ম্যাচ। জয় ১০ ম্যাচে, হার ১৭ ম্যাচে। ফলাফল আসেনি একটি ম্যাচে। সফলতার হার ৩৭.০৩%।

অবসরের প্রশ্নে খানিকটা হলেও বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন মাশরাফি। তবে হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন, অবসর নিলে হুট করেই বিদায় নেবেন। টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার সময়ও কথা রাখলেন তিনি। নাটকীয়ভাবে তার অবসরের ঘোষণা যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল সবাইকে। অতীতে এ প্রসঙ্গে মাশরাফি বলেছিলেন, “প্রায় প্রত্যেক সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ পর আমার দল ছেড়ে দেওয়ার বার্তা আসে। এভাবে খেলা কঠিন। আমি জানি একটি সিরিজের দুই ম্যাচ পর আমার বিদায় নিয়ে কথা শুনতে হবে। এই চ্যালেঞ্জটা আমাকে নিতে হচ্ছে।”

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এক অনুষ্ঠানে অন্যান্য দলের অধিনায়কদের সঙ্গে মাশরাফি; Source: ICC

শেষ করা যাক একটি ঘটনা দিয়ে। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে যাবে বাংলাদেশ। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দল ঘোষণা করা হল। যথারীতি অধিনায়ক মাশরাফি। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বের পালা। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উড়ে এল, কবে বাংলাদেশ একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার পাবে?

উত্তরে নান্নু বললেন, “আমাদের অধিনায়ক মাশরাফিই তো আমাদের পেস বোলিং অলরাউন্ডার!”

হ্যাঁ, মাশরাফি সত্যিকারের অলরাউন্ডার। যেমন ক্রিকেটের যেকোনো ফরম্যাটে, তেমন জীবনের ফরম্যাটেও। রঙিন পোশাকে এখনও তিনি সত্যিকারের নেতা, ভরসার প্রতীক। ক্রিকেটের বাইরেও তিনি অনুপ্রেরণা।

ফিচার ইমেজ- AP

Related Articles

Exit mobile version