উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের নকআউট পর্বের পর্দা নামলো গতকাল। নকআউট পর্বে অঘটনের শিকার হয়েছে বার্সেলোনা। রোমার মত আরেক ইতালীয় দল জুভেন্টাস আরেকটু হলেই লিখে ফেলেছিলো ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের গল্প। কিন্তু ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়ে সেটা আর করা হয়নি জুভদের। অতিরিক্ত সময়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি গোলে একদম শেষ মুহূর্তে পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হয় জুভেন্টাস। রাতের অন্য ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখ ঘরের মাঠে সেভিয়ার সাথে গোলশূন্য ড্র করলেও, প্রথম লেগের জয়ের সুবাদে সেমি ফাইনালের টিকেট পেয়েছে তারা।
একনজরে গতরাতের ফলাফল
রিয়াল মাদ্রিদ ১-৩ জুভেন্টাস
বায়ার্ন মিউনিখ ০-০ সেভিয়া
রিয়াল মাদ্রিদ বনাম জুভেন্টাস
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দানবীয় পারফর্মেন্সে প্রথম লেগে জুভেন্টাস স্টেডিয়ামে বড় ব্যবধানের জয় পেয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। ৩ গোলের লিড নিয়ে ঘরের মাঠে জুভেন্টাসের বিপক্ষে ম্যাচ তেমন দুশ্চিন্তার ছিলো না। এ ম্যাচ জিতে পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য জুভেন্টাসের অবিশ্বাস্য কিছু করে দেখাতো হতো বার্নাব্যুতে। আগের ম্যাচে কার্ড দেখায় সার্খিও রামোস ছিলেন এ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ ছিলেন জুভেন্টাস প্লে-মেকার পাওলো দিবালাও। তাই রামোসের পরিবর্তে জেসুস ভালেহো ও দিবালার পরিবর্তে মারিও মানজুকিচকে নিয়ে খেলা শুরু করেছিলো দু’দল। কিন্তু আগের ম্যাচে জয় নিয়ে ফিরে আসলেও একটা ভয় রিয়াল মাদ্রিদের মনে গেঁথে ছিলো। ফাইনাল বাদে জুভেন্টাসের বিপক্ষে দুই লেগের ম্যাচে কখনোই দুটো ম্যাচ জেতেনি রিয়াল মাদ্রিদ। এবার না আবার তার পুনরাবৃত্তি হয়!
পুনরাবৃত্তি কিন্তু হতে পারতো, শুধু পুনরাবৃত্তি নয়, ঐতিহাসিক কিছু করে ফেলার পরিকল্পনায় ছিলো তুরিনো বুড়োরা। সামি খেদিরার ক্রস থেকে যখন মারিও মানজুকিচ হেডে গোল করেন, ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছে মাত্র ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের বেশি। একদম পরিকল্পনা করে করা আক্রমণ বা সামি খেদিরার পাস অথবা মারিও মানজুকিচের হেড। কোনটাই প্রতিরোধ করার মত অবস্থায় ছিলো না রিয়াল মাদ্রিদ। সবথেকে বড় বিষয়টা হলো, প্রথমেই আকস্মিক গোল খেয়ে যেমন আত্মবিশ্বাস হারায়নি রিয়াল মাদ্রিদ, তেমনি অতিরিক্ত চাপ মাথা থেকে পুরো ঝেড়ে ফেলেছিলো মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির শিষ্যরা।
কোচ জিনেদিন জিদান করিম বেনজেমাকে এ ম্যাচে একাদশে রাখেননি, ছিলেন গ্যারেথ বেল। তার দুর্দান্ত গতি ও শক্তির ফুটবলের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে রিয়াল মাদ্রিদও পাল্টা আক্রমণ করে গেছে জুভেন্টাসের ডিবক্সে। পাওলো দিবালার অভাবও বুঝতে দেননি মারিও মানজুকিচ। চাপকে পাত্তা না দিলেও চাপে যে রিয়াল মাদ্রিদ ভালোই ছিলো সেটা বোঝা যাচ্ছিলো জুভেন্টাসের আক্রমণের সময়। সার্জিও রামোসের অনুপস্থিতি বেশ ভালোরকম ভুগিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদকে। তবে রক্ষণে বেশি মনোযোগ রাখা মার্সেলোর দিক থেকেই অআক্রমণ হচ্ছিল সর্বোচ্চ। মানজুকিচের জোড়া গোলের ক্রস গেছে মার্সেলোর দিক থেকেই।
জুভেন্টাসের দ্বিতীয় গোলের পেছনে অবদান কোচ মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির। মাত্র ১৭ মিনিটে সুযোগ বুঝে তিনি দি শিলিওকে উঠিয়ে স্টেফেন লিচস্টেইনারকে মাঠে নামান। রাইট উইং দিয়ে টানা আক্রমণে দি শিলিও তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারছিলেন না। লিচস্টেইনারকে নামানোর পরিকল্পনা যে একদম সঠিক ছিলো সেটা ৩৭ মিনিটে অ্যাসিস্ট করে প্রমাণ করেন তিনি। আবারো হেডে গোল, আবারো সেই মানজুকিচ এবং সেই ডান পাশ থেকে। প্রথমার্ধে জুভেন্টাসের সাফল্যের পেছনে অন্যতম অবদান ছিলো মধ্যমাঠ। মিরালেম পিয়ানিচ জুভেন্টাসের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, সেটার প্রমাণ যেন আবারো দিলেন তিনি। দুটি গোল হজম করে কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে প্রথমার্ধ শেষ করে রিয়াল মাদ্রিদ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় জিদান বাহিনী। জিনেদিন জিদানও তার ট্যাকটিসে পরিবর্তন আনেন। ক্যাসেমিরো ও গ্যারেথ বেলকে তুলে তিনি লুকাস ভাসকেজ ও মার্কো আসেনসিওকে মাঠে নামান।
মাঠে আক্রমণাত্মক জুভেন্টাস। রামোসের না থাকাটা ভোগাচ্ছে, সেখানে ক্যাসেমিরোর মত একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে তুলে নেওয়াটা কি যুক্তিসংগত ছিলো? অবশ্যই ছিলো। ইস্কো ও রোনালদোর সাথে ভাসকেজ ও আসেনসিও আক্রমণে ভালোরকম সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু জুভেন্টাসের বুফন নামক দেয়ালের কাছে সব আক্রমণ যেন নিভে যাচ্ছিলো। ৬১ মিনিটে আবারো এগিয়ে যায় জুভেন্টাস। কস্তার শট করা বলটি ধরতে কিছুটা ভুল করেছিলেন কেইলর নাভাস। তার হাত ফসকে বের হয়ে যাওয়া বলে গোল করে জুভেন্টাসকে সমতায় আনেন ব্লেইস মাতুইদি। তিন তিনটি গোল হজম করেও রিয়াল মাদ্রিদ আত্মবিশ্বাস বিন্দুমাত্র হারায়নি। উল্টে পরের ৩০ মিনিট তারা আক্রমণ শানিয়ে গেছে। কিন্তু বরাবরই কিয়েলিনি, বেনাতিয়া আর বুফনের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হয়েছে ইস্কো, রোনালদোরা।
ম্যাচ যখন অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে তখনই দৃশ্যপট হুট করে পরিবর্তন হয়ে যায়। রেফারি ম্যাচের অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন ৭ মিনিট। আত্মবিশ্বাসী, হার না মানা মানসিকতার কাছে শেষপর্যন্ত হার মানতে হয় বুফনের। ৯৩ মিনিটে গোলপোস্টের সামনে বল পান লুকাস ভাসকেজ। তাকে পেছন থেকে ফাউল করে রিয়াল মাদ্রিদকে পেনাল্টি এনে দেন মেধি বেনেতিয়া। পেনাল্টি একদমই মেনে নিতে পারেননি জিয়ানলুইজি বুফন। দৌড়ে গিয়েছিলেন রেফারির উদ্দেশ্যে, ব্যবহার সম্ভবত একটু বেশি তিরিক্ষি করে ফেলেছিলেন বলে নিজের ৫০তম ম্যাচে দেখতে হলো লাল কার্ড। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো খুব ঠাণ্ডা মাথায় সকল চাপ উপেক্ষা করে অবশেষে রিয়াল মাদ্রিদকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত গোল। রিপ্লেতে দেখা গেছে, রেফারির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো। জুভেন্টাস ও বুফন হেরে গেছেন নিজেদের নিয়তি আর রিয়াল মাদ্রিদের আত্মবিশ্বাসের কাছে। বুফনও সম্ভবত দেখে ফেললেন নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষাংশ।
সার্জিও রামোসের অনুপস্থিতি সমস্যায় ফেলেছে রিয়াল মাদ্রিদকে, সেমিফাইনালে রামোসকে ছাড়া খেলার কথাটা স্বপ্নেও যে ভাবতেও পারবে না রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু রামোস যে কান্ডটা করে বসলেন, তাতে মনে হয় আবারো তিনি নিষিদ্ধ হতে পারেন। রামোস ছিলেন দর্শকসাড়িতে, সেখানে উত্তেজনা তার সহ্য হয়নি বলে নেমে এসেছিলেন ডাগ আউটে। ৯৩ মিনিট থেকে বাকি সময় সেখানেই ছিলেন, উদযাপনও করেছেন দলের সাথে। উয়েফার নিয়ম অনুযায়ী, নিষিদ্ধ থাকা খেলোয়াড় ডাগ আউটে থাকতে পারবেন না। তাই সেমি ফাইনাল ম্যাচে রামোস আবার নিষিদ্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বায়ার্ন মিউনিখ বনাম সেভিয়া
বায়ার্ন মিউনিখের মাঠে সেভিয়াকেও জিততে হলে ফিরিয়ে আনতে হতো ওল্ড ট্রাফোর্ডের অবিস্মরণীয় বিজয়ের স্মৃতি। তবে সেবার প্রথম লেগে ড্র করবার সাফল্য থাকলেও এবার তা ছিলো না। স্পেনে গিয়ে সেভিয়ার কাছ থেকে দুই গোল উপহার পেয়ে এসেছিলো ইয়ুপ হেইঙ্কেসের দল। বায়ার্ন মিউনিখের কাছে সহজ সমীকরণ হলেও সেভিয়ার কাছে ছিলো পরের রাউন্ডে যাওয়ার জটিল সমীকরণ। সেভিয়া জটিল সমীকরণ সমাধান করতে পারেনি, অন্তত সে সুযোগটা দেয়নি ব্যাভারিয়ানরা। নিজেরা কোনো গোল না করতে পারলেও গোল করতে দেয়নি সেভিয়াকেও।
গোলশূন্য ড্র হলেও ম্যাচটা একপেশে বা ম্যাড়ম্যাড়ে ছিলো না। পর্যাপ্ত আক্রমণ করেছে উভয় দল। প্রথম লেগে ইনজুরির কারণে ছিলেন না এভার বানেগা। দ্বিতীয় লেগে তার উপস্থিতির কারণে সেভিয়া বায়ার্ন মিউনিখের মত দলের বিপরীতেও ছিলো অনেকটা উজ্জ্বল। তবে দুই দল অ্যাটাকিং ফুটবল খেললেও গোল হয়নি। মিস করেছেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি, আরিয়েন রোবেন ও রবার্ট লেভানডস্কি। সেভিয়ার হয়ে সহজ সুযোগ মিস করেছেন ফ্রাঙ্কো ভাসকেজ। আনহেল কোরেয়া দ্বিতীয় লাল কার্ড দেখার ফলে ১০ জনে পরিণীত হয় স্পেনের দলটি। শেষমুহুর্তে তারাও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালোভাবে করতে পারেনি। এ ড্রর ফলে চ্যাম্পিয়নস লিগে গত ২০ ম্যাচে দ্বিতীয়বার নিজেদের মাঠে কোন গোল করতে ব্যর্থ বায়ার্ন মিউনিখ।
কোয়ার্টার ফাইনাল বাঁধা পার করে সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পেরেছে রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, লিভারপুল ও রোমা। সেমিফাইনালের ড্র হবে ১৩ এপ্রিল। প্রথম লেগের ম্যাচগুলো হবে এ মাসের ২৪ ও ২৫ তারিখে ও সেকেন্ড লেগ আগামী মাসের ১ ও ২ তারিখে।
ফিচার ইমেজ- Getty images