আপনাদের যদি গর্ডন গ্রিনিজের কথা মনে থাকে, তাহলে হয়তো অনেকেই জেনে থাকবেন, সফরের মাঝেই তার হাতে বরখাস্তের পত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের সাবেক এই কোচের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এহেন আচরণ সমালোচিত হয়েছিল সেই সময়েই।
বলে রাখা ভালো, ঠিক সেই সময়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই সংস্থাটি। অন্যদিকে, গ্রিনিজ চেয়েছিলেন বাংলাদেশ টেস্টটা আরও একটু পরে খেলুক, আরও শক্তিশালী হওয়ার পর। এটাই মূলত কাল হয়েছিল, যে কারণে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় সাবেক উইন্ডিজ ক্রিকেটার গ্রিনিজকে। পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেটে বিশেষ অবদান রাখার স্মারক হিসেবে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দেয় সেই বিসিবিই।
কিন্তু বিশ্বকাপের পরপরই ‘নেই’ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসের ভাগ্যটা তেমন হয়নি। হয়নি সেই অর্থে যে, তাকে ইংল্যান্ডে বসিয়েই বিদায় বলে দেওয়া হয়নি। তবে তিনি বাংলাদেশ দলকে ভালোবেসেছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর করতে চেয়েছিলেন অনেক কিছু। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে দায়িত্ব ছাড়ার পর বোর্ড যখন খুঁজে ফিরছিল একজন ‘ভালো মনের কোচ’, তার শতভাগটাই ছিল রোডসের মধ্যে। কিন্তু ইংলিশ হয়েও ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের ব্যর্থতা, দল নির্বাচনে সমস্যা, বোর্ড সভাপতির সাথে বৈঠকে তৈরি একাদশের নির্ধারণ করেও ম্যাচে অন্য একাদশ নামিয়ে দেওয়া, কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে ক্রিকেটারদের ছুটি দেওয়া, সবকিছু মিলে বিসিবির কাছে রোডস হয়ে ওঠেন হতাশা।
সে কারণেই কি না শেষ পর্যন্ত বাদ পড়তে হয়েছে রোডসকে। অন্যদিকে, দলের পেস বোলিং কোচ উইন্ডিজ কিংবদন্তি কোর্টলি ওয়ালশের সাথেও আর চুক্তি নবায়ন করেনি বাংলাদেশ। তার অধীনে বাংলাদেশের পেসাররা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি, এটাই ছিল মূল কারণ। যদিও শোনা যায়, এই দায়টা নাকি অনেকটা বোলারদেরই। তারা নাকি ওয়ালশের কথা বুঝতেই পারতেন না।
এতো ‘ছাটাই’ এর মাঝে উড়ছে নতুনের কেতন। ওয়ালশের বদলি হিসেবে বাংলাদেশ দলের নতুন পেস বোলার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান পেস বোলার চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্টকে। অন্যদিকে, সীমিত সময়ের জন্য স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে আনা হচ্ছে সাবেক ব্ল্যাক ক্যাপ অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে।
ওয়ালশের জায়গায় ল্যাঙ্গেভেল্টকে আনা হলেও ভেট্টোরিকে আনা হচ্ছে মূলত ভারতের সফল এবং আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি সফরকে মাথায় রেখে। নতুন দুই কোচের নাম ঘোষণার দিন, গত ২৭ জুলাই শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন,
‘ল্যাঙ্গেভেল্ট আমাদের সাথে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর আমরা চুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবো। অন্যদিকে, ভেট্টোরি এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তিনি ইমেইলের মাধ্যমে আমাদের সাথে কাজ করার ব্যাপারে ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের সাথে ১০০ দিনের জন্য চুক্তি করছেন। তার কাজ শুরু হবে ভারতের বিপক্ষে সিরিজকে সামনে রেখে।’
ল্যাঙ্গেভেল্ট সাবেক প্রোটিয়া ক্রিকেটার, শেষবার আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২০১০ সালে। এরই মধ্যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আফগানিস্তানের পেস বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই দিকেই সুইং করানোর ব্যাপারে ক্যারিয়ারে তার বিশেষ সুনাম ছিল। শেষ দিকে তিনি রিভার্স সুইং নিয়েও কাজ করেন।
অন্যদিকে ভেট্টোরি এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কোচিং করিয়েছেন। শেষবার বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি লিগের দল ব্রিসবেন হিটসের কোচ হিসেবে চুক্তি করেন। এর আগেও তিনি এই দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি চুক্তি নবায়ন করেছেন। এর বাইরে কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন আইপিএলের দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর এবং টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টের দল মিডলসেক্সের হয়ে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী প্রধান কোচের খোঁজে রয়েছে। যদিও সর্বশেষ কোচ স্টিভ রোডসের বিদায় নিয়ে বিসিবি ‘মিউচুয়াল সেপারেশন’ শব্দ ব্যবহার করতে পছন্দ করে থাকে। তার জায়গায় শ্রীলঙ্কার সিরিজে অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে খালেদ মাহমুদ সুজনকে। দুই বোলিং কোচ নিশ্চিত করতে পারলেও প্রধান কোচ নিয়ে কতদূর এগিয়েছে বিসিবি , তা নিয়ে বোর্ড সভাপতি জানিয়েছেন, তারা অনেকের সাথে কথা বলছেন। সাবেক জিম্বাবুইয়ান অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সাথেও কথা চলছে। তবে এ ব্যাপারে আলোচনার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তারা কিছু জানাতে চান না।
শোনা যাচ্ছিল, সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেকেও আবারও ফিরিয়ে আনা হতে পারে। এই মুহূর্তে তিনি শ্রীলঙ্কার কোচের দায়িত্বে আছেন। তার চুক্তির কেবল ১৬ মাস পার হয়েছে। এ নিয়ে বিসিবি প্রধান জানিয়েছেন, তারা আসলে এমন কাউকেই খুঁজছেন যিনি অতীতে উপমহাদেশের দলের সাথে কাজ করেছে। অর্থাৎ, হাতুরুসিংহের ব্যাপারটাও যে ফেলে দেওয়া যায়, তা-ও নয়।
সভাপতি নাজমুল পাপন বলেন,
‘তিনি (হাতুরুসিংহে) যদি আবেদন জানান, তাহলে ভেবে দেখব। কিন্তু আমরা তাকে আমন্ত্রণ জানাব না, এখন পর্যন্ত তিনিও আবেদন জানাননি।’
তবে পুরনোদের মধ্যে ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জির চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। তার ফলাফল ভালো হওয়ায় বোর্ডসভায় তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর আগে নির্বাচক প্যানেলের পরিবর্তন নিয়েও ভাবা হচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাবিবুল বাশার-মিনহাজুল আবেদীনদের উপরই আস্থা রাখছে বিসিবি।
সভাপতি বলেন,
‘তাদের কাজ ভালো হচ্ছে, তাই তাদেরকে না রাখার কোনো কারণ দেখছি না। এখন পর্যন্ত তারা ভালো কাজ করেছে। তাই আমরা নির্বাচক হিসেবে ওদেরকেই রাখছি। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, তারা ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত কাজ করবে। তবে নির্বাচক প্যানেলে এখনও একটি পদ ফাঁকা আছে। আমরা চেষ্টা করবো সেই জায়গাটা পূরণ করতে।’
বিশ্বকাপে দারুণ শুরুর পর শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলের শেষদিকে জায়গা করে মিশন শেষ করেছে বাংলাদেশ। দেশে ফিরেই শুরু হয়েছে অনুশীলন, শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য। সেই সফরে ছিলেন না সাকিব আল হাসান, লিটন কুমার দাস, মাশরাফি বিন মর্তুজা। এত নেই’র মাঝে শ্রীলঙ্কার ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সবগুলোতেই বাজেভাবে হেরেছে তামিম ইকবালের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। সবকিছুই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের সামনের দিনগুলো। অভাবটা কোচের, নাকি ক্রিকেটারদের অভ্যন্তরীণ, তা নিয়েই এখন মূল প্রশ্ন।
দিনশেষে কতটা নিজেদেরকে পুরনো অবস্থান ফিরিয়ে আনতে পারবে বাংলাদেশ, তার উপর নির্ভর করছে সামনের সিরিজগুলো। এরই মধ্যে শুরু হচ্ছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, সেখানে সাদা পোশাকে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ভর করছে অনেকখানি। রয়েছে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করার প্রশ্ন, রয়েছে ওয়ানডেতে নিজেদেরকে পুরনো অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার লড়াই। সেই লড়াই যে সহজ হবে না, তা মনেপ্রাণে ক্রিকেটাররাও টের পাচ্ছেন হয়তো।