১.
টেস্ট ক্রিকেটে বর্তমানে পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক ইংল্যান্ডের জেমস অ্যান্ডারসন। তিনি ৫৭৫ উইকেট শিকার করে টেস্ট ক্রিকেটে পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ডটি নিজের নামে করিয়ে নিয়েছেন। তিনি যখন গ্লেন ম্যাকগ্রার ৫৬৩ উইকেটের রেকর্ড টপকালেন, তখন বলেছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা তার চেয়ে অনেক ভালো পেসার। গ্লেন ম্যাকগ্রার পাশাপাশি আরও একজন পেসারকে তার চেয়ে এগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। পেসারটি আর কেউ নন, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বোলার ডেল স্টেইন। গতির পাশাপাশি সুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।
ডেল স্টেইন অসাধারণ বোলার, এটা অনেকেই অকপটে স্বীকার করবেন। কিন্তু তিনি ঠিক কতটা দুর্দান্ত?
বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ডটি তার নামের পাশে। বিশ্ব ক্রিকেটে তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন মাত্র তিনজন পেসার, তিনজনই স্টেইনের চেয়ে অনেক বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে তাকে সর্বকালের সেরা বোলার হিসাবে আখ্যায়িত না করা হলেও সেরার তালিকায় তিনি উপরের দিকেই থাকবেন।
ডেল স্টেইন টেস্ট ক্রিকেটে এমন সব কীর্তি গড়েছেন, যা অনেক কিংবদন্তি পেসারের নামের পাশেও নেই। তাদের সাথে তুলনা দেওয়ার আগে তার সময়ে অন্যান্য পেসাররা কেমন পারফর্ম করেছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। আধুনিক ক্রিকেটের সেরা পেসার হিসাবে স্টেইনকে অনেকেই সবার উপরে রাখে। তিনি আসলে কতটা সেরা, তা বোঝা যাবে এই শতাব্দীর পেসারদের ক্যারিয়ারের বিশ্লেষণ করলে।
২.
টেস্ট ক্রিকেটে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যেসব পেসার কমপক্ষে ২০০ উইকেট শিকার করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বোলিং গড়ের তালিকায় ডেল স্টেইনের অবস্থান তৃতীয়। তিনি ৯৩টি টেস্টে ২২.৯৫ বোলিং গড়ে ৪৩৯ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার উপরে আছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং তার স্বদেশী ভারনন ফিল্যান্ডার। ম্যাকগ্রা তার ক্যারিয়ারের শেষের দিকে সেরা সময় কাটিয়েছিলেন, তাই তার বোলিং গড় এই সময়ে কম ছিল। পুরো ক্যারিয়ার হিসাব করলে তার বোলিং গড় আরেকটু বেশি। অন্যদিকে, ফিল্যান্ডার ঘরের মাঠেই বেশি সফল। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে সফলতার দিক থেকে স্টেইনের ধারেকাছেও নেই। বিশেষ করে, এশিয়ার মাটিতে স্টেইন দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আসছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বোলিং গড়ের দিক থেকে স্টেইন কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও স্ট্রাইকরেটের দিক থেকে তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করছেন। তিনি ৪২.৩ স্ট্রাইকরেটে ৪৩৯ উইকেট শিকার করেছিলেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারনন ফিল্যান্ডারের স্ট্রাইকরেট ৪৮.৬। এই শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের তালিকায় ডেল স্টেইন দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন। তার চেয়ে ৫৫টি টেস্ট ম্যাচ বেশি খেলা অ্যান্ডারসন ৫৭৫ উইকেট শিকার করেছেন। বোলিং গড় এবং স্ট্রাইকরেট বিবেচনায় স্টেইন থেকে বেশ পিছিয়ে আছেন অ্যান্ডারসন। স্টেইনের বোলিং গড় যেখানে ২২.৯৫, সেখানে অ্যান্ডারসনের বোলিং গড় ২৬.৯৩। এছাড়া স্টেইনের ৪২.৩ স্ট্রাইকরেটের বিপরীতে অ্যান্ডারসনের স্ট্রাইকরেট ৫৬.২। অ্যান্ডারসন বল হাতে যা করতে পারেন, তার সবই স্টেইন করতে পারেন। পার্থক্য হলো, স্টেইন তা ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার দ্রুতগতিতে করতে পারেন।
৩.
একজন পেসারের আসল পরীক্ষা হয় উপমহাদেশের মাটিতে। এখানকার উইকেটগুলো তৈরি হয় স্পিনারদের অনুকূলে। বিশেষ করে নন-এশিয়ান দেশগুলোর বিপক্ষে এশিয়ার দেশগুলো স্পিনবান্ধব উইকেট তৈরি করেই প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ডেল স্টেইন এশিয়ার মাটিতেও বেশ সফল, এশিয়ার মাটিতে নন-এশিয়ান পেসার হিসাবে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত এশিয়ার মাটিতে ২২ টেস্টে ২৪.১১ বোলিং গড়ে এবং ৪২.৯ স্ট্রাইকরেটে তিনি ৯২ উইকেট শিকার করেছেন। এই শতাব্দীতে এশিয়ার মাটিতে তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন মাত্র পাঁচজন বোলার, পাঁচজনই এশিয়ার পেসার। এই পাঁচজন তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করলেও শোয়েব আখতার ছাড়া বাকি সবাই বোলিং গড় এবং স্ট্রাইকরেটের দিক থেকে তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা জেমস অ্যান্ডারসনও এশিয়ার মাটিতে ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। তবে তিনি খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। ২২ ম্যাচে ৩১.২৫ বোলিং গড়ে এবং ৭০.২ স্ট্রাইকরেটে ৬০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। স্টেইনের সমান ম্যাচ খেলে তার চেয়ে ৩২ উইকেট কম পেয়েছেন। তিনি ৬০ উইকেট নিয়ে এশিয়ার মাটিতে নন-এশিয়ান পেসার হিসাবে এই শতাব্দীতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন।
৪.
টেস্ট ক্রিকেটের গত ১৫ বছরের সেরা পেসার কে? এমন প্রশ্নের উত্তরে খুব বেশি মতানৈক্য হওয়ার কথা নয়। ডেল স্টেইন তার সমসাময়িক পেসারদের তুলনায় বেশ এগিয়ে আছেন। বিশেষ করে যখন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অকপটে স্বীকার করে নেন যে, তার চেয়ে স্টেইন ঢের ভালো পেসার, তখন আর তর্ক করার প্রশ্নই আসে না।
তিনি তার সমসাময়িক পেসারদের তুলনায় কতটা এগিয়ে আছেন, তা তো দেখানো হলো। এখন নব্বইয়ের দশকের কিংবদন্তী পেসারদের তুলনায় কতটা এগিয়ে আছেন, সেটা জেনে আসা যাক। আটজন কিংবদন্তি পেসারদের বোলিং গড় এবং তাদের সময়কার অন্যান্য পেসারদের বোলিং গড় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তিনি তার সময়কার অন্যান্য পেসারদের তুলনায় কতটা এগিয়ে আছেন।
ডেল স্টেইন ২২.৯৫ বোলিং গড়ে ৪৩৯ উইকেট শিকার করেছেন, যেখানে তার সময়ে অন্যান্য পেসারদের বোলিং গড় ৩৩.৩১। অর্থাৎ, সমসাময়িক অন্যান্য পেসারদের তুলনায় তার বোলিং গড়ের পার্থক্য ছিল ১০.৩৬! এই তালিকায় তাকে টক্কর দিয়েছেন শুধুমাত্র গ্লেন ম্যাকগ্রা, তার বোলিং গড় ২১.৬৪। ম্যাকগ্রা’র সমসাময়িক অন্যান্য পেসারদের বোলিং গড় ছিল ৩২.০০, অর্থাৎ তারও বোলিং গড়ে পার্থক্য ছিল ১০.৩৬!
ক্যারিয়ারের বোলিং গড় এবং ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তিকালে অন্যান্য পেসারদের বোলিং গড়ের পার্থক্যের তালিকায় স্টেইন এবং ম্যাকগ্রার পরই অবস্থান করছেন শন পোলক। তার বোলিং গড়ে পার্থক্য ছিল ৯.২৫। এছাড়া কার্টলি অ্যামব্রোসের ৯.০১, অ্যালান ডোনাল্ডের ৮.২৫, ওয়াকার ইউনিসের ৬.৯৯, ওয়াসিম আকরামের ৬.৭৫ এবং কোর্টনি ওয়ালশের ৬.৭৫ পার্থক্য ছিল।
স্ট্রাইকরেটের ব্যবধানের দিক থেকেও তিনি উপরের দিকে আছেন। তালিকায় তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ওয়াকার ইউনিস। এই তালিকায় স্টেইন খুব বেশি ব্যবধানে এগিয়ে নেই। ওয়াকার ইউনিসের সময়কার অন্যান্য পেসারদের স্ট্রাইকরেট ছিল ৬৩.৮, এবং স্টেইনের সময়কার অন্যান্য পেসারদের স্ট্রাইকরেট ৬৩.৪। স্টেইনের সময়কার অন্যান্য পেসারদের স্ট্রাইকরেট কম থাকা সত্ত্বেও তিনি এগিয়ে আছেন শুধুমাত্র নিজের অসাধারণ নৈপুণ্যে। ওয়াকার ইউনিসের ৪৩.৫ স্ট্রাইকরেটের তুলনায় স্টেইনের ৪২.৩ স্ট্রাইকরেটও কম।
৫.
টেস্ট ক্রিকেটে স্ট্রাইক রেইট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন বোলার কত দ্রুত প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নিতে পারেন, সেটাই প্রথম দেখার বিষয়। আর এদিক থেকে তিনি অন্যান্য পেসারদের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছেন। আর টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কমপক্ষে ২০০ উইকেট শিকার করেছেন, এমন পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে কম স্ট্রাইকরেট ডেল স্টেইনের (৪২.৩)। এরপরের স্থানে থাকা ওয়াকার ইউনিসের স্ট্রাইকরেট ৪৩.৪।
এই শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকার সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন ডেল স্টেইন। তার মতো আর কোনো পেসার দলের জয়ে এত বেশি অবদান রাখেনি। টেস্ট ক্রিকেটে জয় পাওয়া ম্যাচে কমপক্ষে ১০০ উইকেট শিকার করেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে তার চেয়ে কম বোলিং গড় আছে শুধুমাত্র রিচার্ড হ্যাডলি এবং ইমরান খানের। উইকেটসংখ্যা যদি ২০০ ধরা হয়, তাহলে স্টেইন সেখানে সবার সেরা। ডেল স্টেইন খেলেছেন, এমন টেস্টের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা জয় পেয়েছে ৪৮ ম্যাচে। এই ৪৮ ম্যাচের ৯৪ ইনিংসে বল করে তিনি ২২ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং পাঁচবার ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করে মাত্র ১৬.৬০ বোলিং গড়ে ৩০৫ উইকেট শিকার করেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক কিংবদন্তি পেসারের আগমন ঘটেছে। সর্বকালের সেরাদের তালিকা করতে গেলে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করবেন, নানা মুনির নানা মতও তাতে পাওয়া যাবে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সেই আড্ডায় বারবার উঠে আসবে স্টেইনের নামটিও। টেস্ট ক্রিকেটে ওয়ান্ডারার্সে গতির ঝড় তোলার পাশাপাশি গলের স্পিনসহায়ক উইকেটেও ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করা পেসার বলতেই সবার মনে পড়বে ডেল স্টেইনের নামটাই। ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে ইনজুরির কারণে বেশিরভাগ সময় মাঠের বাইরে না থাকলে এতদিনে নিজেকে নিয়ে যেতে পারতেন আরও উঁচুতে। ডেল স্টেইন সর্বকালের সেরা পেসারদের কততম স্থানে আছেন, সেটা জানা না গেলেও এই শতাব্দীর সেরা পেসার হিসাবে ডেল স্টেইন যে একমেবাদ্বিতীয়ম, সেটা কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে বলে দেওয়া যেতেই পারে।