ব্রুস গ্রোবেলার খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। কৈশোরে বেসবল খেলার জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু সব ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিলো যুদ্ধে।
যুদ্ধ!
রোডেশিয়ার বুশ যুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন বন্ধুদের, হারিয়েছেন সহযোদ্ধাদের। সবচেয়ে বড় কথা, নিজ হাতে হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষের গেরিলাকে। আর যুদ্ধের বিভৎস স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে তার পাশে ক্রিকেট বা বেসবল নয়; সহায় হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো ফুটবল। হ্যাঁ, গ্রোবেলার বলেন, ফুটবলের জন্যই একটা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
সাবেক লিভারপুলের গোলরক্ষক, দলটির দীর্ঘদিনের সৈনিক ব্রুস গ্রোবেলার বলছিলেন, ফুটবল তাকে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাকে মেরে ফেলার যে ভয়ানক স্মৃতি সেটা থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে রেখেছে।
এখন ৬০ বছর বয়স গ্রোবেলারের।
জন্ম হয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে। কিন্তু বড় হয়ে উঠেছেন তৎকালীন রোডেশিয়ায়। আর এই রোডেশিয়াতেই করেছিলেন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের স্মৃতি এখনো মাঝরাতে শীতল ঘাম হয়ে তার শরীরে উপস্থিতি জানান দেয়।
জিম্বাবুয়ের ফুটবলার গ্রোবেলার যাত্রা শুরু করেছিলেন বুলাওয়ের এক ফুটবল ক্লাব থেকে। সেখান থেকে ডারবান সিটি দল হয়ে ভ্যাঙ্কুবার হোয়াইট ক্যাপস। আর এখান থেকেই এসে লিভারপুলের কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন। লিভারপুলে ৪৪০টি ম্যাচ খেলেছেন ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে। এই সময়ে ক্লাবটির হয়ে ১৩টি বড় শিরোপা জিতেছেন তিনি।
কিন্তু এখনও তার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় হয়ে আছে ওই যুদ্ধ। যুদ্ধের স্মৃতি যে মুছে যায় না, সেটা বলতে গিয়ে গ্রোবেলার বলছিলেন,
“একটা আপনি যখন যুদ্ধ করে আসবেন, আপনি আর কখনোই আগের মানুষটি থাকবেন না। আপনাকে বাকিটা জীবন ওই যুদ্ধের পরিণতি নিয়েই কাটাতে হবে।”
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে গ্রোবেলার কথা বলেছেন সেই যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে, কথা বলেছেন লিভারপুলে তার ক্যারিয়ার নিয়ে এবং তার বিপক্ষে ওঠা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ নিয়ে।
“ফুটবল আমাকে রক্ষা করেছিলো”
১৯৭০ সালের ঘটনা সেটা। কৈশোরে পা রাখার আগেই গ্রোবেলার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হন। শুরুতে ১১ মাসের একটি প্রাথমিক পর্বের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিলো। এরপর তাকে বুশ যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেটা ছিলো রোডেশিয়ায় সাদাদের শাসনের বিপক্ষে এক বিপ্লব দমনের কাজ। এই যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৮০ সালে এসে। রোডেশিয়া জিম্বাবুয়ে হয়ে যায়। আর সেখানে কালো সংখ্যাগুরুদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
এর মধ্যেই অবশ্য গ্রোবেলার যুদ্ধপর্ব শেষ করেন।
যুদ্ধে তার কাজ ছিলো শত্রুদের অনুসরণ করা এবং গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই করা। এই যুদ্ধে গ্রোবেলার তিন বন্ধুকে হারান। আর নিজে কমপক্ষে একজনকে হত্যা করেন।
গ্রোবেলার বলছিলেন, তিনি এই স্মৃতি নিয়ে আলাপ করতে পছন্দ করেন না,
“এই স্মৃতিগুলো এখন একটু পাশে পড়ে গেছে। আমি মনে করতে চাই না। তবে কখনো কখনো আফ্রিকাতে গেলে বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারা এই বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে। আমি করি না।”
“সেই ঘটনার (যুদ্ধের) পর দুই-তিন সপ্তাহ ধরে আমার ঠান্ডা ঘাম হতো। আমি সেই অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠতাম। এখনও মনে করলে আমার সেই ভয় লাগে।”
গ্রোবেলার বলেন, ফুটবল আসলে তাকে এখান থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তাকে যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে হয়নি। এরপর তিনি ফুটবলে এত ব্যস্ত সময় কাটাতে পেরেছেন যে, যুদ্ধ অনেকটাই পাশে চলে গেছে।
আফ্রিকা ছেড়ে গ্রোবেলার চলে আসেন কানাডাতে। সেখানে হোয়াইট ক্যাপসে যোগ দেন। এরপর ১৯৭৯ সালে চলে আসেন লিভারপুলে।
গ্রোবেলার বলছিলেন, তাকে যুদ্ধ নিয়ে হতাশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি এই ফুটবলের জীবনের কারণে,
“বছরের পর বছর আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করেছি। আমাকে হতাশা বা অবসাদের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। কারণ, ফুটবল আমার জীবন রক্ষা করেছিলো।”
“আমি যখন একবার মিলিটারি থেকে বের হয়ে আসলাম, আমার সামনে তখন ফুটবল ছিলো। আমি ফুটবলে মন দিয়ে ওসব ঘটনা ভুলতে পেরেছি।”
ছাতা নিয়ে অনুশীলন
গ্রোবেলার তখনকার লিভারপুল কোচ বব পেইসলিকে মুগ্ধ করেছিলেন ক্রু দলে খেলার সময়। এই দলটিতে তিনি এসেছিলেন হোয়াইট ক্যাপস থেকে ধারে খেলতে। আর এখানে খেলার সময়ই ঘটে মজার এক ঘটনা।
গ্রোবেলার সেই ঘটনা মনে করছিলেন,
“আমি ইয়র্ক সিটির বিপক্ষে ক্রুর হয়ে খেলছিলাম। বব পেইসলি ও টম সান্ডার্স সেই ম্যাচ দেখত এসেছিলেন।”
“আমি যখন শরীর গরমের জন্য দৌড়াচ্ছিলাম, তখন আমাদের কোচ মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’”
“কোচ বললেন, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ দুজন লোক এসেছেন আজ তোমার খেলা দেখতে।’ তারা এরপর আমাদের খেলা না দেখে স্টোক সিটির খেলা দেখতে চলে গেলো। কারণ সম্ভবত আমি মাথায় একটা ছাতা নিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। কারণ, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো।”
এই ছাতা মাথায় করে দৌড়াতে থাকা লোকটাকে দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো পেইসলির। লিভারপুল পরের বছর চুক্তি করে ফেললো গ্রোবেলারের সাথে। এরপর গ্রোবেলার এই দলটির হয়ে ছয়টি লিগ শিরোপা জিতেছেন, তিনটি এফএ কাপ ও একটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছেন।
হেইসেল স্টেডিয়ামের ধ্বংসযজ্ঞ
হেইসেল ও হিলসবরো স্টেডিয়ামের ধ্বংসযজ্ঞের দুই সময়েই গ্রোবেলার লিভারপুলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন।
১৯৮৫ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে হেইসেল স্টেডিয়ামে যে ভয়াবহ গোলোযোগ হয়েছিলো তাতে ৩৯ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। লিভারপুলের সমর্থকরা জুভেন্টাস সমর্থকদের ওপর গিয়ে পড়েছিলেন। তারা যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা ধসে পড়ার পর এই দুর্ঘটনা বাজে রূপ পায়।
এই দুর্ঘটনার পরও এখানে খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় উয়েফা। স্থানীয় প্রশাসন মনে করছিলো, খেলা বন্ধ করলে শহরজুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু উয়েফার এই সিদ্ধান্ত মেনে কোনো খেলোয়াড় মাঠে বের হতে সাহস পাচ্ছিলেন না। সেই সময়ের কথা মনে করে গ্রোবেলার বলছিলেন,
“কোনো খেলোয়াড় বের হতে সাহস পাচ্ছিলো না। আমাদের উয়েফা থেকে বলা হলো, বেরিয়ে খেলতে। কারণ, না খেলা হলে দাঙ্গা আরও বেড়ে যেতে পারে।”
“আমি মনে করতে পারি, লোকজন এগিয়ে এসে তোয়ালে ও পানি চাচ্ছিলো। আমরা সেগুলো দিয়েছি। কারণ তারা এ দিয়ে মানুষ বাঁচাচ্ছিলো।”
“আমার মনে পড়ে, মাঠে নেমে আমি মাঠ থেকে পুতে থাকা দুটো ছুরি খুঁজে পেয়েছিলাম। এটা জুভেন্টাসের সমর্থকরা মাঠে ছুড়ে মেরেছিলো। এটা ছিলো একেবারে ছয় গজ বক্সের ভেতরে।”
গ্রোবেলার মনে করতে পারেন এরপরও তার দিকে অনেক কিছু ছুড়ে মারা হয়েছে। ক্যারিয়ার জুড়ে অনেক কিছুই হজম করেছেন তিনি,
“আমার ক্যারিয়ার জুড়ে আমাকে অনেক কিছুই ছুড়ে মারা হয়েছে। ধার করা মুদ্রা ছোড়া হয়েছে। বিলিয়ার্ড বল, একবার একটা ডার্ট ছোড়া হয়েছিলো বার্নলিতে। আলু আর ব্লেড তো ছিলোই।”
কিন্তু এসব ছুড়ে মারার অভিজ্ঞতা, এসব নোংরা আর ছুরি দেখা গ্রোবেলারের জন্য মধুর অভিজ্ঞতা। কারণ ফুটবলের এসব অভিজ্ঞতাই তাকে এর চেয়ে অনেক বিভৎস যুদ্ধের স্মৃতি থেকে দূরে রাখতে পেরেছে।
ফুটবল মাঠের ভালোর মতো এসব মন্দও তাই তার কাছে সেরা স্মৃতি।