চার বছর অনেক সময়। এই সময়ের মধ্যে বহু জল গড়িয়েছে নদী থেকে সাগরে। প্রজন্মের শিশুরা অকাতরে আকড়ে ধরেছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভালোবাসাকে। যে ভালোবাসার কথা বলা হচ্ছে, সেটি ফুটবল। আগের জনমে কেউ পাখি হয়ে জন্মালে, পরের জনমে বিমান হতে চাইবে; এমনটা বোধ করি খুব একটা হয় না। বিশ্বকাপের গল্প যখন বলা হবে, তখন বাস্তবতাটা আরও শক্ত। আগের বারের ফাইনালিস্ট দল এবার শিরোপা জিততে চাইবে কিংবা শিরোপা জয়ী দল ধরে রাখতে চাইবে সেই মুকুটকে। এর বেশি কিছু তো নয়! কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প বলে। ভাগ্য নিজেই যেন ‘ভাগ্যের হাতে’। যেমন এবারের কথা ধরা যাক। চলতি রাশিয়া বিশ্বকাপে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন দল জার্মানি বাদ পড়লো গ্রুপ পর্ব থেকে।
চার বছরের মাঝে একেবারে শিখর থেকে শূন্যে। মজার ব্যাপার হলো, এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে বাদ পড়েছিল ইতালি। তার আগের আসরে ২০০৬ সালে এই ইতালিই হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন। আবার ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন দল স্পেনও গ্রুপ পর্ব থেকে ২০১৪ বিশ্বকাপ আসরে বাদ পড়ে যায়। এমন ঘটনা আরও আছে। সেসব আলোচ্য বিষয় নয়।
ম্যানুয়েল ন্যয়ার, টমাস মুলার, মেসুত ওজিল, টনি ক্রুসরা যে ২০১৪ আসরের দলের মতো শক্তিশালী দল গড়তে পারেননি তা নিয়ে দ্বিমত নেই। তাই বলে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়াটা যেন একটু বেশিই দৃষ্টিকটু দেখায়। সেটাও আবার গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে র্যাংকিংয়ের অনেক নিচে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে। হতবিহব্বল জার্মানি একাধিক সুযোগ তৈরি করেও পায়নি কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা। কেন এমনটা হলো? এর পিছনে দাঁড় করানো যেতে পারে একাধিক কারণ। এর মাঝে ‘উল্লেখযোগ্য’ ৫টি কারণ জেনে নেওয়া যাক।
জয়ের ক্ষুধায় অনীহা
সবার আগে এটা মাথায় রাখতে হবে, জয়ের ধারা বজায় রাখা কতটা শক্ত কাজ। জার্মানি জাতীয় ফুটবল দল ২০১৪ সাল থেকে দারুণ সময় কাটাচ্ছে। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে শুরু। এরপর ২০১৭ সালে উয়েফা অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়, ২০১৭ কনফেডারেশন কাপ জয়; সবকিছুর উর্ধে নিয়ে গেছে তাদের। সবচেয়ে বড় কথা, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে টুর্নামেন্টেই তারা অংশ নিয়েছে, অন্তত সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছে তারা।
২০১৪ দলের সঙ্গে এই দলের ‘ম্যাড়ম্যাড়ে’ খেলা দৃষ্টিকটু হলেও ২৩ সদস্যের মধ্যে ১৩ জন বড় বড় ক্লাবে খেলছে। যেখানে নাম রয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাস, বার্সেলোনা, প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি), ম্যানচেস্টার সিটি ও রিয়াল মাদ্রিদের। তারপরও হুট করেই যেন জয়ের ধারা থমকে গেল জার্মানদের।
দলের সদস্য জুনিয়ান ড্রাক্সলার নিজেই এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এই দল ২০১৪ জার্মানি দলের মতো জ্বলে উঠতে পারছে না। দলটি জয়ের ক্ষুধা হারিয়েছে উল্লেখ করে মেক্সিকোর বিপক্ষে হারের পর তিনি বলেন, “আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ২০১৪ সালের মতো এই দল একইভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি।”
সাফল্য ধরে রাখা কঠিনই বটে। বিশেষ করে ক্রীড়াক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তারপরও জার্মানির সাফল্য নিয়ে গল্প হবে। কিন্তু দলের পারফর্মেন্সই প্রমাণ দিচ্ছে, তারা জয়ের প্রতি নিজেদের প্রয়োজনীয় মনযোগ ও ক্ষুধার অভাব দেখিয়েছে।
অদ্ভুত স্কোয়াড নির্বাচন
রাশিয়া বিশ্বকাপে কোচ জোয়াকিম লো যেভাবে দল নির্বাচন করেছেন, তা আসলে ব্যাট-বলে হয়নি। তার একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। টুর্নামেন্টের আগেভাগে বায়ার্ন মিউনিখের স্ট্রাইকার সান্দ্রো ওয়াগনারকে দল থেকে বাদ দেন তিনি। অথচ তাকে বলা হচ্ছিলো, জার্মানির সেরা স্ট্রাইকার। তার বদলে নেওয়া হলো মারিও গোমেজকে যার ফর্ম এখন একরকম তলানিতে। শুধু তা-ই নয়, গেল মৌসুমে বুন্দেসলিগায় সবচেয়ে বেশি ১২ গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন যেই ফিলিপ ম্যাক্স, তাকেও দলে নেননি লো। জায়গা পাননি মারিও গোটশে, আন্দ্রে শুরলের মতো ফুটবলাররা।
শুধু দল নির্বাচন নয়, খেলার ধরণটাও যেহেতু বলে দেন কোচ, তাই সেখানেও দেখা গেছে ভুতুড়ে কাণ্ড। জার্মানির প্রায় প্রতি ম্যাচেই টিমো ওয়ার্নারকে বারবার লেফট ফ্ল্যাঙ্ক আর সেন্টার ফরোয়ার্ডে সরানো হচ্ছিলো। এমনকি দলের দুই সেরা ফুটবলার টমাস মুলার আর মেসুত ওজিল কখন মাঠে ঢুকছিলেন আর কখন তাদের বের হয়ে আসতে হচ্ছিলো সেটা নিয়ে একরকম ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অবস্থাটা এমন যে, কোচ জোয়াকিম লো নিজেই বুঝতে পারছেন না তার শক্তিশালী দল কোনটা হবে। অর্থাৎ, তিনি নিজেই তার শক্তির জায়গাটা জানেন না।
এ কারণেই কিনা বিশ্বকাপে এবার অদ্ভুত দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দলীয় কোন্দল
এবারের জার্মানি দলে দলীয় কোন্দলের খবর পাওয়া গেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে ২৩ সদস্যের জার্মান দলের এই কোন্দল হলো ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী দল ও ২০১৭ রাশিয়ার কনফেডারেশন কাপজয়ী দলের মধ্যে। দলে ৯ জন ফুটবলার ব্রাজিল বিশ্বকাপ দলে ছিলেন। ১৩ জন ছিলেন কনফেডারেশন কাপজয়ী দলে। কেবলমাত্র দুজন, ম্যাথিয়াস গিন্টার ও জুলিয়ান ড্র্যাক্সলার এই দুই গ্রুপের বাইরে।
এবারের আসরে দলের কোচ জোয়াকিম লোর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল এই দুটি ভাগের মধ্যে ‘ভালো’ সম্পর্ক বজায় রাখা। তিনি চেষ্টা করেছিলেন সবার মধ্যে এটা ভাবাতে যে, যারা ব্রাজিল বিশ্বকাপে ছিল তারা যেন শিরোপা ধরে রাখতে চায়। আর যারা রাশিয়ায় কনফেডারেশন কাপে ছিলেন তারা যেন আবারও রাশিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখে।
একই চেষ্টা করেছিলেন দলের অধিনায়ক ম্যানুয়েল ন্যয়ার। সেটা কতটা বাস্তব হয়েছে তা অজানা। কিন্তু দল যে সুবিধা করতে পারেনি, সেটা গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়া দেখেই টের পাওয়া যায়।
ইতিহাসের ‘অভিশাপ’
বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নদের ইতিহাসে বিশেষ সুবিধার না। একবার শিরোপা জিতলে, পরেরবার বাদ পড়তে হবে এটা যেন অনেক সময় নিয়মে পরিণত হয়। অন্তত জার্মানির এই বিদায়ে গেল ৪ আসরে একই অবস্থা হচ্ছে। জার্মানি হয়তো এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে নামার আগে সেই কালো ইতিহাস মাথায় রেখেই নেমেছিল। কে জানে, ব্যর্থতার পিছনে হয়তো এই ইতিহাসও দায়ী।
২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইতালি। পরের আসরে তারা প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। এবার তো বাছাইপর্বই পার করতে পারেনি দলটি। ২০১০ আসরে চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ২০১৪ আসরে তাদের বিদায় গ্রুপপর্বে। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি, যারা কি না এক আসর বাদে এই রাশিয়া বিশ্বকাপে বিদায় নিলো।
জার্মান বধের জ্ঞান বৃদ্ধি
ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলোতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার খেলার কারণে, প্রতিপক্ষের ব্যাপারে অনেকটা জানাশোনা হয়ে যায়। যেমনটা হয়েছিল মুস্তাফিজুর রহমানের ক্ষেত্রে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সানরাইজার্স হায়দরাবাদে তাকে নেটে প্রচুর বল করতে হতো। যার ধারাবাহিকতায় নিজের রহস্য প্রায় হারিয়ে বসেছিলেন তিনি।
ফুটবলেও একই অবস্থা। ক্লাব ফুটবলের দৌরাত্ম্যে প্রতিপক্ষের শক্তির জায়গাটা খুব বেশি লুকানোর সুযোগ নেই। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল জার্মানি বিপক্ষে তাদের শক্তি-দুর্বলতা ক্লাব ফুটবলের মাধ্যমেই অনেকটা জানা-বোঝা হয়ে গেছে।
‘এফ’ গ্রুপে জার্মানির প্রতিপক্ষ ছিল মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও সুইডেন। যার মধ্যে মেক্সিকান ডিফেন্ডার কার্লোস সালসেদো খেলেন জার্মান ফ্রাঙ্কফুডের হয়ে। এছাড়া দেশটির ক্লাব ভের্ডার ব্রেমেনের হয়ে খেলেন সুইডেনের লুডভিগ অগাস্টিনসন। আরেক সুইডিশ এমিল ফোর্সবার্গ খেলেন জার্মানির আরবি লেইপজিগের হয়ে।
তাদের সবাই জার্মান জাতীয় দলের কৌশল, তাদের অবস্থান ও ফুটবল নিয়ে চিন্তাশক্তির ব্যাপারে ধারণা রাখে। যেগুলো জার্মান প্রতিরোধ ভাঙতে তাদের সহায়তা করেছে। একইসঙ্গে নিজ নিজ দলে জার্মান দলের ব্যাপারে কৌশলগত সুবিধা পেতে পরামর্শও দিতে পেরেছে।
ফিচার ইমেজ- FIFA