বৃষ্টিতে পণ্ড হয়েছে একটি ম্যাচ। বাকি আট ম্যাচের পাঁচটিতে হার, তিনটিতে জয়। সেমিফাইনালের স্বপ্নসাধ তিমিরে হারিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনকে ‘ব্যর্থ’ ট্যাগ দেওয়াই যায়। বড় মঞ্চের অতীতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশাও পূরণ হয়নি। ২০১১, ২০১৫ আসরের মতোই এবারও তিন জয় নিয়েই দেশে ফিরছে বাংলাদেশ।
গত ১ মে প্রায় আড়াই মাসের সফরে দেশ ছেড়েছিল টাইগাররা। শুরুতে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলেছিল। আয়ারল্যান্ডে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি জয়ের ইতিহাস গড়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। বহুজাতিক টুর্নামেন্টে ছয়টি ফাইনাল হারের পর সপ্তম মিশনে ট্রফি জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ।
অনেক স্বপ্নের বিশ্বকাপেও দারুণ শুরু পেয়েছিল টাইগাররা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে উড়ন্ত শুরুটা সেমিফাইনালের আশাকে আরও জোরালো করেছিল। কিন্তু তারপর নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের কাছে হার, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পয়েন্ট ভাগাভাগিতে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। পরে আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জয় আবারও সেমি’র দৌড়ে ফিরিয়েছিল বাংলাদেশকে। যদিও শেষবেলায় ভারত-পাকিস্তানের কাছে হেরে সেমি’র স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়।
নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পরও সেমিফাইনালের চৌকাঠে পা রাখতে পারেনি টাইগাররা। শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনের ‘পোস্টমর্টেম’ করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।
বাংলাদেশ কি দুর্ভাগা দল?
লর্ডসে সংবাদ সম্মেলনে দুর্ভাগ্যের চেয়ে কিছু জায়গায় নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের ব্যর্থতাকেই তুলে ধরেছেন মাশরাফি। তিনি বলেছেন,
‘আমি দুই দিক থেকেই বলতে পারি। অবশ্যই কিছু জায়গা আছে, যেখানে আমরা নিজেরা প্রমাণ করতে পারতাম আমাদের সামর্থ্য আছে। তবে অবশ্যই ভাগ্যের একটি সাহায্য লাগতো, সবকিছু নিজেদের পক্ষে যাওয়ার জন্য। আমি মনে করি দুই দিক থেকে সেই সুযোগগুলো আমরা হারিয়েছি।’
বিশ্বকাপে দলের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন
অধিনায়কের মতে, দলের খেলোয়াড়রা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। মাশরাফি বলেছেন,
‘খেলোয়াড়েরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিছু জায়গায় আমরা অনেক উন্নতি করতে পারতাম। আমরা জানতাম আমাদের দুর্বলতা কোথায়। কিন্তু আমরা সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, যদিও সেটা সম্ভব ছিল। সত্যি কথা বলতে, এই (দুর্বলতার) জায়গাগুলো নিয়ে পুরো দলই হতাশ। তারপরও যদি এই ম্যাচটি (পাকিস্তানের বিপক্ষে) ভালোভাবে শেষ করতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো।’
পুরো টুর্নামেন্টে ক্যাচ মিস ও বাজে ফিল্ডিংই কি পার্থক্য গড়ে দিয়েছে?
এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বাজে ফিল্ডিং দলের তালিকায় উপরেই থাকবে বাংলাদেশের নাম। টুর্নামেন্টজুড়ে যাচ্ছেতাই ফিল্ডিং ডুবিয়েছে দলকে। সঙ্গে সব মিলিয়ে অন্তত আটটি ক্যাচ মিসের মতো ভুলকে সঙ্গী করেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। মাশরাফি বলেছেন,
‘কিছু ম্যাচে ফিল্ডিং আমাদের অনেক বেশি ভুগিয়েছে। এই ধরনের উইকেটে ফিল্ডার হিসেবে রান থামালে বোলারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। কিন্তু ফিল্ডাররা সেই কাজটি করতে না পারায় ডুবতে হয়েছে। যখনই কোনো বড় জুটি হয়েছে, আমরা ফোকাস হারিয়েছি। কিছু ক্যাচ মিস হতেই পারে। কিন্তু ক্রমাগত একই ভুল হলে প্রশ্ন উঠবেই। আমি আশা করি, আমরা এই ব্যাপারটি নিয়ে কাজ করব, এবং ভবিষ্যতে শক্তভাবে ফিরে আসব।’
নতুন বলের বোলিং নিয়ে হতাশা
নতুন বলে বাংলাদেশের বোলিং ছিল নির্বিষ, বিবর্ণ। ইনিংসের শুরুতে উইকেট নিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার কাজটি কেউই করতে পারেননি। মাশরাফি বলেছেন,
‘কিছু ছোটখাটো বিষয় অনেক পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। ফিল্ডিং এবং বোলিং নিয়ে উদ্বেগ ছিল। আমি মনে করি, বোলিং আপ টু দ্য মার্ক ছিল না, আমার থেকে শুরু করে বাকিদেরও। বিশেষ করে, প্রথম ১০-২০ ওভার পর্যন্ত। ওই সময়ে আমাদের অবশ্যই উইকেট পেতে হতো।’
এছাড়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলাররা যতটুকু সাফল্য পেয়েছেন তার সবটুকুই এসেছে ইনিংসের মাঝপথে এবং শেষভাগে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরাজের বলে মুশফিক ডি ককের ক্যাচ ছাড়ার পর রানআউটে ভাঙেন উইকেট। এরপর সাকিব এসে কার্যত ব্রেক থ্রু দেন। দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিব স্পিনে ঘায়েল করেন মার্টিন গাপটিল ও কলিন মুনরোকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচে বোলিং ছিল ছন্নছড়া। ২০তম ওভারে মিরাজের অসাধারণ ক্যাচে মাশরাফি পান বিশ্বকাপের একমাত্র উইকেট।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ার্নারের ক্যাচ সাব্বির মিস করেন শুরুতেই। সেই ভুলের মাশুল গুনতে হয় ২১তম ওভার পর্যন্ত। সৌম্য এসে ফেরান ফিঞ্চকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পেসার সাইফউদ্দিন ফেরান ক্রিস গেইলকে। নতুন বলে সেটাই একমাত্র সাফল্য বলা যায় পেসারদের জন্য। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাকিব ১১তম ওভারে বোলিংয়ে এসে পান উইকেট। ভারতের বিপক্ষে ওপেনিং জুটি টিকেছিল ৩০ ওভার পর্যন্ত। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওপেনিং জুটিতে আসে ২৩ রান।
বিশ্বকাপ থেকে পাওয়া ইতিবাচক দিক
সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। মাশরাফি বলেছেন,
‘প্রথমে আমার সাকিবের কথা বলা উচিত। আমি মনে করি, সে অসাধারণ ছিল। সে ব্যাটিং করেছে তিন নম্বরে, যতখানি সম্ভব করে দেখিয়েছে। তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। শুধু আমি নই, পুরো দলই করছে। আশা করি সাকিবের সঙ্গে ছেলেরা এগিয়ে যাবে। মুশফিকও দারুণ ব্যাটিং করেছে। সে কখনও কখনও দুর্ভাগা ছিল, তবে আমি মনে করি সে দারুণ ব্যাটিং করেছে।
টস ভাগ্যও পক্ষে ছিল না…
বিশ্বকাপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই টসে হেরেছিল বাংলাদেশ। যেখানে টস জয়টা ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে সাহায্য করেছে। অধিনায়ক বলেছেন,
‘আমি মনে করি টস অবশ্যই অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। কারণ উইকেট পরের দিকে ক্রমাগত ধীর হয়ে এসেছিল। আমরা বেশিরভাগ ম্যাচেই ব্যবহৃত উইকেটে খেলেছি। সেদিক থেকে টস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাউন্ড রবীন লিগের ফরম্যাট বিশ্বকাপের জন্য কতটা উপযোগী?
বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার এই ফরম্যাটে খেলা হলো। ১৯৯২ সালে প্রথমবার এই ফরম্যাটে খেলা হয়েছিল। মাশরাফির কাছে, এই ফরম্যাট খারাপ লাগেনি। তিনি বলেছেন,
‘এই ফরম্যাট আমার ভালোই লেগেছে। কারণ প্রতিটি দলই একে অন্যের মুখোমুখি হতে পারছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, কিছু মানুষ হয়তো আমার কথায় খুশি হতে পারবে না। যারা বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি, তাদের জন্য আমি দুঃখিত। দারুণ রোমাঞ্চকর একটি টুর্নামেন্ট ছিল। একে অন্যের বিপক্ষে খেলা, শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানা, দুর্বলতা সম্পর্কে জানা এবং কিভাবে নিজেদের খেলায় উন্নতি করা যায়, সেটা স্পষ্ট হয়েছে।’
শেষ ম্যাচেও জয়ের লক্ষ্যই ছিল…
ভারতের কাছে হারের পরই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের বিদায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিয়মরক্ষার ম্যাচে তাই দলটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি পূর্ণ ছন্দে। যদিও মাশরাফি বলছেন, লর্ডসে জয়ের জন্যই খেলতে নেমেছিল তার দল। বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেছেন,
‘জেতার জন্য নামিনি, এটা ঠিক নয়। তবে এটাও সত্যি যে, যখন জানি সেমিফাইনাল খেলব না, তখন অনেকের মনের মধ্যে কাজ করে। কাজ করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, হতাশ থাকে সবাই। তবে আমরা ম্যাচটি জেতার জন্য চেষ্টা করেছি অনেক। সত্যি হচ্ছে, এই ধরনের ম্যাচ থাকলে সেটা কঠিন হয়, দুই দলের জন্যেই। পাকিস্তান হয়তো শেষ কয়েকটা ম্যাচ জিতে টাচে ছিল, যেটা তারা থ্রু করতে পেরেছে। আমরা পুরা আসরে ইন অ্যান্ড আউট ছিলাম। জিতছি-হারছি, জিতছি-হারছি, এমন। আমরা তবুও শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলাম। ভারতের সাথে হারার পর স্বাভাবিক যে আমরা হতাশ ছিলাম। পাকিস্তানের সাথে জেতার ইচ্ছা অবশ্যই ছিল আমাদের। মোমেন্টাম ওদের সাথে ছিল। কিন্তু লাস্ট ম্যাচে আমরা বাদ পড়েছি, এটা কনফার্ম হয়েছে। এটা সবার ওপর ইফেক্ট ফেলে, যেটা সবাই শো করতে পারে না, বা করে না। এরকম সময়ে অনেক কিছু কাজ করে। সবাই চেষ্টা করেছে শেষটা ভালোমতো করার জন্য।’
বড় দলের সঙ্গে পার্থক্য
বিশ্বকাপের চার ফাইনালিস্ট ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড। লিগ পর্বে এই চার দলের কাউকেই হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। বড় দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে বড় রকমের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন মাশরাফি।
তিনি বলেছেন,
‘বড় দল বলতে আপনি ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডকে বুঝিয়েছেন। বিশ্বকাপে আসার আগে আমি তিন বিভাগ (ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং) নিয়েই সচেতন ছিলাম। আমি জানতাম, তিন বিভাগে শতভাগের চাইতে ভালো করলে আমরা তাদের সাথে জিততে পারব। এখন আমার মনে হচ্ছেম ব্যাটিংয়ে আমরা তাদের সমপর্যায়ে ছিলাম। বোলিংয়ে অনেক বড় ধরনের পার্থক্য আছে। ফিল্ডিংয়ে তার থেকেও বড় পার্থক্য আছে। এই দুইটা জায়গায় তাদের সঙ্গে আমাদের বিস্তর ফারাক, যেখানে আমাদের উন্নতির সুযোগ আছে।’
আগামী বিশ্বকাপের ফেভারিট বাংলাদেশ
২০২১ সালে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ২০২৩ সালে একই দেশে বসবে আগামী বিশ্বকাপের আসর। কন্ডিশন, আবহাওয়া, উইকেট মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য বিশাল নয়। মাশরাফির আশা, আগামী বিশ্বকাপে ফেভারিট দল থাকবে বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের সঙ্গে তরুণরাও পারফর্ম করবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। মাশরাফি বলেছেন,
‘আমাদের সামনের বিশ্বকাপ যেহেতু ভারতে… সেখানে আমি অবশ্যই বিশ্বকাপ জিততে বলব না, এটা ভাগ্যে থাকতে হবে। তবে ভারতে খেলা হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ফেভারিট বলতে হবে। আর সামনের বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আমি আশা করব, সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ এরা যেন টিকে থাকে, সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, কেউ যেন ইনজুরিতে না থাকে, বা নতুনরা যেন ইনফর্ম থেকে খেলতে পারে।’
দায় নিলেন মাশরাফি
বিশ্বকাপ যেন মুদ্রার উল্টো পিঠই দেখালো মাশরাফিকে। বল হাতে এতটা নিষ্প্রভ তাকে কখনোই দেখা যায়নি। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে এমন উইকেটখরাও আসেনি। এবার গোটা টুর্নামেন্টেই বল হাতে দেখা যায়নি চিরচেনা মাশরাফিকে।
টুর্নামেন্টের শুরু থেকে চোটের সঙ্গে লড়েছেন। ধুঁকেছেন মাঠে, দৌঁড়াতে গিয়ে খুঁড়িয়েছেন। বোলিংয়ে ছিল না ধার, ছিল না সেই আগের নিয়ন্ত্রণ। যেন নিজের কঙ্কাল নিয়েই লড়েছেন তিনি। বিশ্বকাপশেষে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজেও নিজেকে সরিয়ে নিলেন ইনজুরিজনিত কারণে। ক্যারিয়ারজুড়েই নতুন বলে বাংলাদেশের বড় ভরসা ছিলেন মাশরাফি। শুরুতে উইকেট এনে দিতে পারঙ্গম তিনি। এবার বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচেই শুরুতে বল করেছেন, কিন্তু উইকেটের দেখা পাননি। আসরে আট ম্যাচে মোট ৫৬ ওভার বোলিং করেছেন ডানহাতি এই পেসার, ৬.৪৪ ইকোনমি রেটে কেবল একটি উইকেট নিতে পেরেছেন তিনি।
ব্যর্থতার দায় নিয়ে মাশরাফি নিজের বোলিং নিয়ে বলেছেন,
‘কোনো ম্যাচেই আমরা প্রথম ১০, ১৫ বা ২০ ওভারে উইকেট নিতে পারিনি। আমার থেকে শুরু করে অন্যান্য যারা ছিল, তারা সবাই। আমি মনে করি, আমার এটাই ব্যক্তিগতভাবে দেখা উচিত। আমি যেহেতু এই সময়ে বোলিং করি, দায়িত্ব আমার।’