বর্তমানে ওয়ানডের সেরা ব্যাটসম্যান কে? নির্দ্বিধায় যে কেউ বলে দিতে পারবে বিরাট কোহলির নাম। কিন্তু কোহলির চোখে তাঁর চেয়েও প্রতিভাবান আছেন আরেকজন। তিনি আর কেউ নন; রোহিত শর্মা। মেধার পাশাপাশি পরিশ্রম দিয়েই কোহলি আজ এই অনন্য উচ্চতায়। অপরদিকে রোহিতের যত অর্জন তার পুরোটাই প্রতিভা। ফিটনেসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক রেকর্ড ভাঙা-গড়া খেলায় মেতে আছেন এই ভারতীয় ওপেনার। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ২০০ তম ম্যাচ খেললেন রোহিত। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের ইতিহাসে ৭৯ তম খেলোয়াড় হিসেবে এই মাইলফলক ছুঁলেন তিনি। ২০০ ম্যাচেই রোহিতের রয়েছে অজস্র অর্জন। আজ আমরা দেখবো রোহিত শর্মার ২০০ ম্যাচের ক্যারিয়ারের কিছু ঝলক।
রান উৎসব
২০০৭ সালে বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় রোহিতের। ‘প্রতিভাবান’ তকমা গায়ে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে পা রাখলেও নিজেকে প্রথমদিকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। প্রথম ছয় বছরে ৩০.৪৩ গড়ে মাত্র ১,৯৭৮ রান সংগ্রহ করেন, যেখানে শতক ছিলো মোটে দুটি। সেই সময় গম্ভীর ও শেবাগ ভারতের নিয়মিত ওপেনার ছিলেন বিধায় রোহিতকে ব্যাট করতে হতো একটু নিচে নেমে। তবে ২০১৩ সালে এই দুজনের বিদায়ের পর ধোনির পরামর্শে ওপেনিং শুরু করেন তিনি। আর তাতেই পুরো ক্যারিয়ারের খোলনলচে পাল্টে যায়। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিত ওয়ানডেতে ভারতের জার্সি গায়ে দিয়েছেন ১১৩ ম্যাচে। আর তাতে ৬০.০১ গড়ে রান তুলেছেন ৫,৮২১। শতক হাকিয়েছেন ২০টি। পাশাপাশি দ্বিশতকও রয়েছে ৩টি। ২০১৩ এর আগে যেখানে রোহিতের স্ট্রাইক রেট ছিলো ৭৭.৯৪, তা এরপরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২.৯৪ এ।
ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করার পর থেকে পরবর্তী প্রতিটি বছরই ৫০ এর উপর গড়ে রান তুলেছেন তিনি। এদিক থেকে রোহিতের চেয়ে এগিয়ে শুধু ডি ভিলিয়ার্স। ডি ভিলিয়ার্স ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টানা সাত বছর ৫০ এর উপর গড়ে রান তুলেছিলেন। গত ছয় বছরের মধ্যে তিনবার এক পঞ্জিকাবর্ষে হাজারের উপর রান করেছেন রোহিত।
১৯৯ ম্যাচ শেষে রোহিত শর্মার রানসংখ্যা ৭,৭৯৯। ক্যারিয়ারে ১৯৯ ম্যাচের পর তাঁর থেকে রান বেশি ছিলো মাত্র দুজনের। কোহলি (৮,৭৬৭ রান) এবং ডি ভিলিয়ার্সের (৮,৫২০ রান)। অন্যদিকে হাশিম আমলা অবশ্য ১৭৩ ম্যাচেই সংগ্রহ করেছেন ৭,৮৯৬ রান।
সেঞ্চুরিনামা
নিয়মিত ওপেনিংয়ের পর থেকে রোহিত শর্মা করেছেন ২০টি সেঞ্চুরি। আর ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২২টি সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি করা ইনিংসগুলোতে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট ও গড়ের রেকর্ডেও এক নাম্বার স্থান দখল করেছেন তিনি। এই ২২ ইনিংসে রোহিতের গড় ১৪৫.০০। পেছনে ফেলেছেন ডেভিড ওয়ার্নারের ১৩৫.৯৩ গড়। এই ম্যাচগুলোতে রোহিতের স্ট্রাইক রেটও ঈর্ষনীয়। ১১১.৩৪ স্ট্রাইক রেটে এই রানগুলো তুলেছেন তিনি। পেছনে ফেলেছেন শেন ওয়াটসনের ১১০.০২ স্ট্রাইক রেট।
সেঞ্চুরি করার পর রোহিত আরো বেশি দানবীয় রুপ ধারণ করেন। সেঞ্চুরিতে পৌঁছার মুহূর্তে যেখানে তাঁর স্ট্রাইক রেট থাকে ৯৫.৮৬, তা ইনিংস শেষ করার পর গিয়ে দাঁড়ায় ১৭৩.৬৮ এ। সেঞ্চুরি নিয়ে আরেকটি রেকর্ডও রয়েছে রোহিত শর্মার ক্যারিয়ারে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিতে সেঞ্চুরির পর টানা ১০টি সিরিজে কমপক্ষে একটি করে সেঞ্চুরি রয়েছে তাঁর, যেটি কিনা একটি বিশ্বরেকর্ডও।
রোহিত শর্মা তাঁর পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সর্বমোট রেকর্ড ৭টি দেড় শতাধিক রানের ইনিংস খেলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি দ্বিশতকও। ওয়ানডের ইতিহাসে ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের মালিকও রোহিত। কলকাতায় ২০১৪ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে তিনি দানবীয় ব্যাটিংয়ে করেন ২৬৪ রান।
দ্য হিটম্যান
পুরো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে রোহিত শর্মা ছাড়িয়েছেন ৩০০ ছয়ের মাইলফলক, যেটি কি না তিনি ছাড়া এখন পর্যন্ত করতে পেরেছেন মাত্র ছয়জন ব্যাটসম্যান। তাঁরা হলেন শহীদ আফ্রিদি, ক্রিস গেইল, ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম, সনাৎ জয়াসুরয়া, এবি ডি ভিলিয়ার্স ও মহেন্দ্র সিং ধোনি।
বলা বাহুল্য, রোহিতের ৩০০ এর উপর ছয়ের বেশিরভাগই এসেছে ওয়ানডেতে। ওয়ানডেতে তাঁর ছয়ের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২১৫টি। তিনি যৌথভাবে ধোনির সাথে এই ফরম্যাটে ভারতের সবচেয়ে বেশি ছক্কা পেটানো খেলোয়াড়। তবে যেখানে ২১৫ ছয় হাঁকাতে গিয়ে ধোনির লেগেছে ২৫৯ ইনিংস, সেখানে রোহিতের দরকার হয়েছে মাত্র ১৮৩ ইনিংস। এক পঞ্জিকাবর্ষেও ভারতীয় হিসেবে ওডিআইতে সর্বোচ্চ ছয়ের রেকর্ড রয়েছে রোহিতের। ২০১৭ সালে ৪৬টি ছয় হাঁকিয়েছেন তিনি। তার চেয়ে এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন শুধুমাত্র দুজন- এবি ডি ভিলিয়ার্স (৫৮ ছয় – ২০১৫) ও শহীদ আফ্রিদি (৪৮ ছয় – ২০০২)।
ওয়ানডের ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছয় মারার ক্ষেত্রেও এক নাম্বার স্থান দখল করেছেন রোহিত। যদিও তার রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন ক্রিস গেইল ও এবি ডি ভিলিয়ার্স। ২০১৩ সালে বেঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০৯ রানের ইনিংস খেলার পথে সর্বোচ্চ ১৬টি ছয় মেরেছিলেন তিনি। অন্যদিকে কলকাতায় শ্রীলংকার বিপক্ষে ২৬৪ রান করতে গিয়ে মেরেছেন সর্বোচ্চ ৩৩টি চার। সেই ম্যাচে এর পাশাপাশি ৯টি ছয় হাঁকিয়ে এক ইনিংসে বাউন্ডারি থেকে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও করেন তিনি।
প্রিয় ও অপ্রিয় প্রতিপক্ষ
রোহিতের ২০০ ম্যাচের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিলো অস্ট্রেলিয়া। এক অস্ট্রেলিয়ার সাথেই ৬৫.৮৫ গড়ে ১,৭৭৮ রান করেন তিনি। অজিদের বিপক্ষে শতক হাঁকিয়েছেন ৭টি। সর্বোচ্চ ৬৬টি ছয়ও অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের বিপক্ষে।
ওডিআই ক্যারিয়ারে রোহিত শর্মার প্রিয় বোলার জেমস ফকনার। ফকনারের বিপক্ষে একবারও আউট না হয়ে সবচেয়ে বেশি রান তুলেছেন তিনি। ফকনারের ২১১ ডেলিভারিতে রোহিত ২৩টি চার ও ৫ ছয়ের মাধ্যমে তুলেছেন ২২৩ রান। অন্যদিকে অপ্রিয় বোলারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে রয়েছেন এঞ্জেলো ম্যাথিউস। এখন পর্যন্ত ৭ বার আউট হয়েছেন ম্যাথিউসের বলে। তাঁর বলের বিপক্ষে রোহিতের স্ট্রাইক রেটও রোহিতসুলভ নয়। মাত্র ৫৮.৮৬। এই শ্রীলংকানের বিপক্ষে প্রতি ২৫ বলেই একবার সাজঘরে ফিরেছেন তিনি।
প্রিয় পার্টনার
ভারতের হয়ে ওপেনিংয়ে শিখর ধাওয়ানের সাথে ইনিংসের উদ্বোধন করলেও পরিসংখ্যান অনুযায়ী রোহিতের প্রিয় পার্টনার কোহলি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৮টি দ্বিশতক পার্টনারশিপে জড়িত ছিলেন রোহিত। কোহলির (১২টি) পরেই রোহিতের অবস্থান। এই ৮টির মধ্যে ৫টিই করেছেন কোহলির সাথে জুটি বেঁধে, যেটি একটি রেকর্ডও। কমপক্ষে ২,০০০ রানের পার্টনারশিপ করেছেন এরকম জোড়ার মধ্যে রোহিত-কোহলির গড় ৬৪.৫৯, যেটির অবস্থান আমলা-ডি ভিলিয়ার্সের (৭২.৩৫ গড়) এর পরেই।
মাত্র ৩১ বছর বয়সী রোহিতের সামনে পড়ে রয়েছে ক্যারিয়ারের অনেকখানি অংশ। বর্তমানের এই বিধ্বংসী ফর্ম অব্যাহত রাখলে আরো বহু রেকর্ডই পায়ে লুটাবে রোহিত শর্মার। ‘প্রতিভাবান’ রোহিত শর্মা যে সেটি পারবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।