গত বিশ্বকাপ ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে যখন মারিও গোটজে আর্জেন্টিনার জালে বল জড়ান, ততক্ষণে মেসিদের হাতে ছিলো মাত্র সাত মিনিট। সাত মিনিটে আর্জেন্টিনা ম্যাচে তো ফিরতে পারেইনি, বরং নার্ভ হারিয়ে শেষ সাত মিনিট খেললো আরো বাজে ফুটবল। বিশ্বকাপ মানেই এরকম টানটান উত্তেজনা আর বারুদে ঠাসা সব ম্যাচ। যেখানে মাঠের শক্তিমত্তার চেয়ে নার্ভ ধরে রাখাও বড় ব্যাপার হয়ে উঠে। গতবারের আর্জেন্টিনার মত তীরে এসে তরী ডুবেছে অনেক দলেরই। চলুন দেখে আসা যাক বিশ্বকাপের এমন পাচঁটি ম্যাচ, যেখানে অন্তিম মূহুর্তে কাঁদতে হয়েছে অন্য একটি দলকে।
আন্দ্রেস ব্রাহিমি (জার্মানি)– ৮৫ মিনিট
আর্জেন্টিনা ০-১ জার্মানি (১৯৯০ বিশ্বকাপ– ফাইনাল)
ম্যাচটিকে বিশ্লেষণ করলে এককথায় বলতে হয় কোডেসালের শেষ মুহূর্তের পেনাল্টি হুইসেলে ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টিনার কান্না। দিয়েগো ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে ফাইনালে ওঠা আর্জেন্টিনা পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে আন্ডারডগ হয়েই খেলতে নামে। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা একই দুটি দল ইতালি বিশ্বকাপেও ফাইনালে মুখোমুখি হয়। তবে এইবার আলবিসেলেস্তেদের হারের মুখটাই দেখতে হয়।
প্রথম থেকেই জার্মানির মুহূর্মুহূ আক্রমণ আটকাতেই ব্যস্ত ছিলো আর্জেন্টিনা। ৬৫ মিনিটে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পেদ্রো মনজন লোথার ম্যাথিউসকে ফাউল করার জন্য ফাইনালে লাল কার্ড দেখে যখন বেরিয়ে যান, তখন ব্যাপারটা আরো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। তবুও ম্যারাডোনার নেতৃত্বে দারুন টিম প্লেতে জার্মানিকে গোলবঞ্চিত রাখে আর্জেন্টিনা। পরবর্তীতে দেজোত্তির দ্বিতীয় হলুদ কার্ডে নয়জনের দলে পরিণত হয় সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নেরা। ৮৫ মিনিটে রবার্তো সেনসিনির ট্যাকলে রুডি ভোলার আর্জেন্টিনার ডি বক্সে পড়ে যান। মেক্সিকান রেফারি তাতেই স্পটকিকের বাঁশি বাজান। যদিও রবার্তো সেনসিনির করা ট্যাকলটি সঠিক ছিলো, কিন্তু এডগার্ডো কোডেসাল পেনাল্টির সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। আর্জেন্টাইন গোলকিপার গয়োকোচিয়া পেনাল্টি সেইভে অসাধারণ দক্ষ হওয়ায় নিয়মিত পেনাল্টি টেকার লোথার ম্যাথিউস পেনাল্টি না নিয়ে আন্দ্রেস ব্রাহিমিকে শটটি নিতে দেন। অন্তিম মুহূর্তে আন্দ্রেস ব্রাহিমির শটে কপাল পোড়ে ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টাইনদের। তীরে এসে তরী ডোবায় ক্রন্দনরত ম্যারাডোনা অভিযোগের আঙুল তোলেন রেফারি কোডেসালের দিকে।
ডেনিস বার্গক্যাম্প (নেদারল্যান্ড) – ৯০ মিনিট
নেদারল্যান্ড ২-১ আর্জেন্টিনা (১৯৯৮ বিশ্বকাপ – কোয়ার্টার ফাইনাল)
ফ্রান্সের মার্শেই স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার ফাইনালে আক্ষরিক অর্থেই তারার মেলা বসেছিলো। একদিকে আর্জেন্টিনার বাতিস্তুতা, ভেরন, সিমিওনে, ওর্তেগা। অন্যদিকে ডাচদের ক্লাইভার্ট, বার্গক্যাম্প, ডেভিডস, ফন ডার সার। প্রথম থেকেই আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে খেলা জমে উঠে। ১২ মিনিটেই ক্লাইভার্টের গোলে এগিয়ে যায় ডাচরা। পাঁচ মিনিট পরেই অফসাইড ফাঁদ ভেঙে আর্জেন্টিনাকে সমতায় ফেরান লোপেজ।
তবে দ্বিতীয়ার্ধে দুটি লাল কার্ড খেলায় নিয়ে আসে উত্তেজনা। দুটি হলুদ কার্ড খেয়ে নিউম্যান যখন মাঠ ছাড়ছেন তখন ৭৬ মিনিটের খেলা চলছে। দশজনের ডাচকে তখন চেপে ধরেন বাতিস্তুতা, ওর্তেগারা। কিন্তু সেই সুবিধা আর্জেন্টিনা ভোগ করতে পারে মাত্র দশ মিনিট। ৮৬ মিনিটে ফন ডার সারের সাথে হাতাহাতিতে লাল কার্ড দেখেন আর্জেন্টাইন তারকা আরিয়েল ওর্তেগা। এর ঠিক তিন মিনিট পরেই ঘটে অঘটনটি। রোনাল্ড কোম্যানের বাড়ানো লং পাসটি আর্জেন্টিনার ডি বক্সে দারুণ দক্ষতায় রিসিভ করেন ডেনিস বার্গক্যাম্প। এক রিসিভেই মার্কারে থাকা আয়ালাকে ছিটকে ফেলেন। তারপর বাঁ পা দিয়ে ঠাণ্ডা মাথার ফিনিশে আর্জেন্টিনার কফিনে ঠুকে দেন শেষ পেরেক। ম্যাচটি নেদারল্যান্ড জিতে যায় ২-১ গোলে। উড়তে থাকা আর্জেন্টিনা বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনালেই। আর সাবেক আর্সেনাল ফরোয়ার্ড বার্গক্যাম্পের দৃষ্টিনন্দন রিসিভটি ঢুকে যায় ইতিহাসের পাতায়।
ফাবিও গ্রোসো (ইতালি)– ১১৯ মিনিট
ইতালি ২-০ জার্মানি ( ২০০৬ বিশ্বকাপ – সেমিফাইনাল )
ডর্ট্মুন্ড স্টেডিয়ামে ২০০৬ বিশ্বকাপে শেষ চারে মুখোমুখি হয় ক্লিন্সম্যানের জার্মানি ও মার্সেলো লিপ্পির ইতালি। প্রথমার্ধে কোনো দলই ভালো কোনো সুযোগ তৈরী করতে পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধে দুই দল খেলায় ফিরলেও গোলের দেখা পায়নি কোনো দলই। সেই সুবাধে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
খেলার যখন ১১৯ মিনিট, তখন কর্নার কিক পায় ইতালি। এদিকে মোটামুটি নিশ্চিত ড্র জেনে ক্লিন্সম্যান সেই সময় টাইব্রেকারে কারা কারা শট নেবেন, সেটি ঠিক করছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! কর্নার থেকে আসা বল জার্মান ডিফেন্ডাররা ভালোভাবে ক্লিয়ার করতে না পারলে ডি বক্সের বাইরে দাঁড়ানো পিরলোর পায়ে যায় বলটি। পিরলোর পাস থেকে ফাবিও গ্রোসোর নেওয়া তীর্যক শটে স্তব্ধ হয়ে যায় ডর্টমুন্ড স্টেডিয়ামে বসে থাকা হাজার হাজার জার্মান দর্শক। সেই গোল তো জার্মানি শোধ করতে পারেইনি, উল্টো প্রতি আক্রমণ থেকে ১২১ মিনিটে খেয়ে বসে দ্বিতীয় গোলটিও। দেল পিয়েরোর পা থেকে আসা গোলটিতে ২-০ জয় পায় ইতালি। অন্তিম মুহূর্তের দুই গোলে ঘরের মাঠে জার্মানদের কাঁদিয়ে ফাইনালে উঠে আজ্জুরিরা। সেবার ফ্রান্সকে হারিয়ে নিজেদের চতুর্থ শিরোপাটিও ঘরে তোলে মার্সেলো লিপ্পির দল।
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা (স্পেন)– ১১৬ মিনিট
স্পেন ১-০ নেদারল্যান্ড (২০১০ বিশ্বকাপ – ফাইনাল)
৩২ বছর কোনো বিশ্বকাপ না জেতা দুই দল উঠলো ফাইনালে। অর্থাৎ জোহানেসবার্গে যেই জিতুক, প্রথমবারের মতো উঁচিয়ে ধরতে পারবে সোনালী অধরা ট্রফিটি। ডাচদের ভরসা হয়ে ছিলেন স্নাইডার, রোবেন আর কাইটরা। অন্যদিকে স্পেনের রয়েছে এক ঝাঁক প্রতিভাবান সোনালি প্রজন্ম।
পুরো ম্যাচে দুই দলের মিসের মহড়া দেখা যায়। বিশেষ করে ক্যাসিয়াসকে একা পেয়ে রোবেনের মিসটি এখনো কাঁদায় কমলা বাহিনীদের। ৯০ মিনিটে কোনো দলই গোল করতে না পারলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ম্যাচের ১০৯ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে ডাচদের ১০ জনের দল করে দিয়ে মাঠ ছাড়েন জন হেইটিঙ্গা। সবাই যখন টানা দ্বিতীয়বারের মত টাইব্রেকার ফাইনালের জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনই লা রোজাদের উচ্ছ্বাসে ভাসান আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ফ্যাব্রিগাস থেকে বল পেয়ে ১১৬ মিনিটের ভলিতে ডাচদের জালে বল জড়ান সাবেক বার্সেলোনার এই জাদুকর। তৃতীয়বারের মতো কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ে ক্রুইফের শিষ্যরা। দেল বক্সের অধীনে ইনিয়েস্তার অন্তিম গোলে প্রথমবারের মতো শিরোপা উল্লাসে মাতে ইউরোপের দেশ স্পেন।
মারিও গোটজে (জার্মানি)– ১১৩ মিনিট
জার্মানি ১-০ আর্জেন্টিনা (২০১৪ বিশ্বকাপ– ফাইনাল)
সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম মারাকানায় সর্বোচ্চ তৃতীয়বারের মতো জার্মানি-আর্জেন্টিনা ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে যেমন মেসির সুযোগ ছিলো আর্জেন্টিনার শিরোপা খরা ঘোচানোর, তেমনি জার্মানির সুযোগ ছিলো আমেরিকা থেকে প্রথম কোনো ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে শিরোপা নিয়ে দেশে ফেরা। সে যুদ্ধে জয় হয় ডাই ম্যানশ্যাফট খ্যাত জার্মানদের।
খেলা শুরু থেকেই ডিফেন্স ধরে রেখে পাল্টা আক্রমণে খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। গোটা কয়েক সুযোগও পায় তারা। কিন্তু হিগুয়াইন, আগুয়েরো, প্যালাসিও, মেসিদের একের পর এক শিশুসুলভ মিসে লিড নেওয়া হয়নি আলবিসেলেস্তেদের। গোলশূন্য ড্রতেই প্রথম ৯০ মিনিট শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ে দুই দলের পরিশ্রান্ত খেলায় ফুটবলপ্রেমীরা যখন ধরেই নিয়েছিলো আরেকটি টাইব্রেকার নামক রোমাঞ্চের নাটক হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই শুর্লের ক্রস থেকে সাইড ভলিতে বল জালে জড়িয়ে মেসিদের স্তব্ধ করে দেন ‘জার্মান মেসি’ খ্যাত মারিও গোটজে। গোটজের ১১৩ মিনিটের করা গোলে প্রথমবারের মতো টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ থেকে পিছিয়ে পড়ে। সেই ম্যাচে মেসি পারেননি, পারেননি কোনো আর্জেন্টাইন। আবারো ফাইনাল ব্যার্থতায় বিমর্ষ মুখে মাঠ ছাড়ে আলেসান্দ্রো সাবেলার দল। জোয়াকিম লো এর অধীনে জার্মানি জিতে নেয় চতুর্থ শিরোপা। মিরোস্লাভ ক্লোজার বদলি নামা মারিও গোটজে বনে যান জার্মান নায়ক।