যেকোনো প্রতিযোগিতায় কোয়ার্টার ফাইনাল এমন একটি জায়গা যেখান থেকে আপনি সাফল্যের সুঘ্রাণ পাবেন। আপনার মনে হবে আপনি যশ এবং খ্যাতির খুব কাছে রয়েছেন, কিন্তু তবুও তা থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হয় আপনি এখান থেকে সাফল্যের পথে আরো এগিয়ে যাবেন, নয়তো হবে পদস্খলন, হেরে গিয়ে আগের সব পরিশ্রমকে পণ্ড হয়ে যাবে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সেমিফাইনালে উঠার পথ অনেক ক্ষেত্রেই তাই নাটকীয় হয়। আপনি ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে যাওয়ার ঘটনাটিই ধরুন। নাটকীয়তার কমতি ছিল সেই খেলায়? তবে আপনি যদি এই কোয়ার্টার ফাইনাল ধাপে হেরে বসেন, তবে ইতিহাসের একটি গৌরবময় স্থানে নিজেকে দেখার সুযোগ হারাবেন।
বিশ্বকাপ ফুটবল তার ইতিহাসে আমাদের এমন অনেক বিখ্যাত কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ উপহার দিয়েছে। অবশ্য টুর্নামেন্টের ফরম্যাট অনুযায়ী এর আগে অনেকবারই কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল না। ফিফা একেক টুর্নামেন্টে একেকরকম নিয়ম করতে গিয়ে প্রথম রাউন্ডে গ্রুপভিত্তিক খেলার পর ২য় রাউন্ডেও আরেকটি গ্রুপভিত্তিক খেলা হতো। সেইখান থেকে একটি বা দুইটি দল নকআউট পর্বে যেত।
এই সিস্টেমের খারাপ দিক কী ছিল? গ্রুপের শেষ খেলার আগে দলগুলো জানত যে পরের রাউন্ডে যেতে হলে তাদের কী করতে হবে। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা পেরুর সাথে খেলার আগেই জানত যে তাদের বড় ব্যবধানে জিততে হবে, তারা জেতেও ৬-০ গোলে। তবে এই সিস্টেম কিছু ভাল খেলাও উপহার দিয়ে গিয়েছে। যেমন ১৯৮২ সালে মাদ্রিদে ব্রাজিল এবং ইতালির মধ্যকার খেলাটি, যেটায় ইতালি পাওলো রসির হ্যাটট্রিকে ৩-২ গোলে জয়লাভ করে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ফিফা এই দ্বিতীয় গ্রুপ রাউন্ড বাতিল করে সেখানে নকআউট হিসেবে আবারও কোয়ার্টার ফাইনালকে নিয়ে আসে। এবং সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের একটি খেলায় আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড বিশ্ববাসীকে একটি অতুলনীয় খেলা উপহার দেয়। ‘হ্যান্ড অফ গড’ এবং ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ ছিল ওই খেলারই উপহার। এছাড়া ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড ৩-২ গোলে হারায় শক্তিশালী ক্যামেরুনকে, ১৯৯২ সালে ব্রাজিল নেদারল্যান্ডসকে হারায় ৩-২ গোলে, আর ১৯৯৮ সালে ডেনিস বার্গক্যাম্পের শেষ মিনিটের গোলে নেদারল্যান্ডস আর্জেন্টিনাকে হারায় ২-১ গোলে।
২০১০ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের কথা আপনাদের কারোর মনে আছে? মাত্র ২টি দিনের ব্যাপার ছিল। এই দুইদিনে ৪টি খেলা। এই ৪টি খেলা কত যে নাটকীয়তা উপহার দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। স্বচক্ষে তার সাক্ষী যারা ছিলেন, তারা আসলেই ভাগ্যবান।
কোয়ার্টার ফাইনালের দিকে যাওয়ার আগে আসুন ২০১০ বিশ্বকাপের কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার একদম প্রথম থেকে স্মরণ করি। এই টুর্নামেন্টটি সেবারই প্রথম আফ্রিকা মহাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। ৩২টি দলের মধ্যে সেবার স্লোভাকিয়া ও সার্বিয়া প্রথমবারের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সেখানে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। এমনকি সেবারই ১৯৬৬ সালের পর আবারও এসে হাজির হয় উত্তর কোরিয়া, যারা কি না ১৯৬৬ সালে শুধুমাত্র এক ইউসেবিওর কাছে হেরে বিদায় নেয়। ২০১০ সালের ১১ জুন জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়ামে উদ্ভোধনী খেলায় মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও মেক্সিকো। ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে শাবালালা গোল দেয়ার পর ধারাভাষ্যকার পিটার ড্রুরির সেই বিখ্যাত লাইন, “শাবালালাআআআআ, গোল বাফানা বাফানা, গোল ফর সাউথ আফ্রিকা, গোল ফর অল আফ্রিকা।” তবে ধারাভাষ্যকারদের সাথে পাল্লা দিতে সেই বিশ্বকাপে হাজির হয়েছিল ভুভুজেলা নামের এক প্লাস্টিকের বাঁশি, যার আওয়াজে ঢাকা পড়ে যেত মাঠের বাকি সব আওয়াজ।
গ্রুপ পর্বে কী কী ছিল? ২০০৬ এর চ্যাম্পিয়ন ইতালি শুরুতেই বিদায় নেয়। রব গ্রিনের হাত ফসকে বল গোলে ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচ হাতছাড়া করে ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন স্পেন সুইসদের সাথে প্রথম ম্যাচেই হেরে বসে। দ্বিতীয় রাউন্ডে বাতিল হয় ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের এক নিশ্চিত গোল বাতিল হয়, যার সূত্র ধরে পরে ফুটবলে আসে গোললাইন টেকনোলজি। এসব কিছুই আমাদের নিয়ে আসে নাটকীয় কোয়ার্টার ফাইনালে।
প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে নেলসন ম্যান্ডেলা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল ও নেদারল্যান্ডস। দুইদলই গ্রুপ পর্বে যার যার গ্রুপের শীর্ষে ছিল। ব্রাজিল দলে ছিলেন লুইস ফ্যাবিয়ানো, রবিনহো, কাকা, দানি আলভেজ, মাইকন। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসে ছিলেন ফন পার্সি, রোবেন, কিউট, স্নাইডার, ফন বোমেল, ডি ইয়ং। নেদারল্যান্ডস তাদের কমলা রঙ নিয়ে নামলেও ব্রাজিলকে নামতে হয় নীল নিয়ে।
খেলার শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল ব্রাজিলের। আলভেজের ক্রস থেকে পাওয়া বল আলতো টোকায় জালে জড়ান রবিনহো, কিন্তু আলভেজ অফসাইডে থাকায় তা বাতিল হয়। তবে কিছুক্ষণ পরেই ফেলিপে মেলোর থ্রু বল নেদারল্যান্ডসের রক্ষণের বুক চিড়ে খুঁজে নেয় রবিনহোকে। শুধু এক টাচেই বলটিকে স্টেকেলেনবার্গের পাশ দিয়ে জালে পাঠান তিনি। ব্রাজিলের জয়ের জন্য মঞ্চ তখন প্রস্তুত। খেলার ৩০ মিনিটে রবিনহো লেফট ফ্ল্যাংক দিয়ে সুন্দর একটি বল বানিয়ে দিয়েছিলেন লুইস ফ্যাবিয়ানোকে, যিনি বলটি ব্যাকহিল করে দেন কাকাকে। কাকার নেয়া দুর্দান্ত শট সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ডাচ গোলরক্ষক স্টেকেলেনবার্গ। এছাড়া টাইট এঙ্গেল থেকে নেয়া মাইকনের শট নেটের পাশে গিয়ে লাগে। সবদিকে পিছিয়ে থেকেই ডাচরা বিরতিতে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধে আস্তে আস্তে খেলার নিয়ন্ত্রণ নেয়া শুরু করে ডাচরা। রোবেনকে আটকাতে হিমশিম খেতে শুরু করে ব্রাজিলের ডিফেন্স। রাইট উইংয়ে রোবেন বল দেন স্নাইডারকে। স্নাইডার ক্রস করে বক্সে ফেলেন বল। বলটি ধরতে সামনে চলে আসেন গোলরক্ষক হুলিও সিজার। তার সামনে থাকা ফেলিপে মেলোর সাথে ধাক্কা লাগে বল ধরা নিয়ে। বল ফেলিপে মেলোর মাথা ছুঁয়ে চলে যায় ব্রাজিলের জালে।
১৫ মিনিট পর একটি কর্নার পায় নেদারল্যান্ডস, তা নিতে যান রোবেন। রোবেনের নেয়া কর্নার গিয়ে পড়ে সবার সামনে থাকে ডার্ক কিউটের মাথায়। আলতো করে ফ্লিক করে তা পেছনে পাঠান তিনি। সেখানে স্নাইডার বল পেয়ে যান এবং হেড করে গোল দিয়ে নিজেদের এগিয়ে নেন। মাথা থাপড়াতে থাপড়াতে উদযাপনের দিকে ছুটে যান তিনি। ব্রাজিল অবশ্য এরপর ম্যাচে ফিরতে মরিয়া হয়ে ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছিল। কিন্তু ডাচদের দ্বিতীয় গোলের মিনিট পাঁচেক পর রাইট উইংয়ে রোবেনকে ফেলে দেন ফেলিপে মেলো, ফেলে দিয়ে আবার মাড়িয়ে দেন রোবেনের উরু। শাস্তিস্বরূপ সরাসরি লাল কার্ড দেখান তাকে রেফারি। মেলোর সাথে তখনই মাঠ ছেড়ে চলে যায় ব্রাজিলের জয়ভাগ্য।
নেদারল্যান্ডস কিন্তু ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ফন পার্সির বানিয়ে দেয়া বলটি মিস করেন স্নাইডার, হ্যাটট্রিকের সুযোগটিও হারান তিনি। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ব্রাজিলের কোচ দুঙ্গা ঘোষণা দেন, এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই তিনি দল ছাড়বেন। কোয়ার্টারের দুইদিনের নাটকের শুরু ছিল এটি।
কয়েক ঘণ্টা পর জোহানেসবার্গে উরুগুয়ের মুখোমুখি হয় ঘানা। সেখানে নিরপেক্ষ সমর্থকেরা সমর্থন দেয় ঘানাকে। কারণ সেই ম্যাচটি জিতলে ঘানা হবে সেমিফাইনালে খেলা প্রথম আফ্রিকান দল। আর তা যদি আরো করা যায় নিজ মহাদেশে তবে তা তো সোনায় সোহাগা।
গ্রুপপর্বে ঘানা কেবল দুইটি গোল করতে সমর্থ হয়, দুটোই ছিল পেনাল্টি থেকে করা আসামোয়াহ জিয়ানের গোল। জার্মানির পর তারাই ছিল গ্রুপে দ্বিতীয়। দ্বিতীয় পর্বে ঘানা ২-১ গোলে হারায় যুক্তরাষ্ট্রকে। সেখানেও জিয়ান করেন ১ গোল। বলা যায় ঘানার এতদূর আসার পুরো কৃতিত্বই তার।
তাদের বিপক্ষে থাকা উরুগুয়েতে জিয়ানের এই দায়িত্ব পালন করতেন ডিয়েগো ফোরলান ও লুইস সুয়ারেজ। উরুগুয়ে তাদের গ্রুপে প্রথম হয়, সেখানে ফোরলানের ছিল দুই গোল। আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সুয়ারেজ করেন দুই গোল। এই দুইজন কোনো কারণে ব্যর্থ হলে সাহায্য করতে আসতেন এডিনসন কাভানি ও আন্দ্রে আব্রু।
দুই দলই ধীরেসুস্থে সতর্কতার সাথে খেলা শুরু করে। ফোরলান, সুয়ারেজ, জিয়ান – সবার সামনেই সুযোগ এসেছিল দলকে এগিয়ে নেয়ার, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। বিরতির আগ মুহূর্তে আচমকা সুলে মুনতারির ৪০ গজ দূর থেকে নেয়া একটি শট বুলেটের মতো করে ঢুকে যায় উরুগুয়ের জালে। পুরো স্টেডিয়াম তখন লাল, হলুদ, সবুজ পতাকায় বাঁধভাঙ্গা। এই অবস্থায় বিরতিতে যায় দুই দল।
ঘানা এই লিড ধরে রাখতে পারে শুধু ১০ মিনিটের জন্য। বিরতির ১০ মিনিট পর ঘানার বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পায় উরুগুয়ে, তা নিতে যান ফোরলান। সবাই যখন সেখানে একটি ক্রস আশা করছিলেন, ফোরলান তখনই খেয়াল করেন ঘানার গোলরক্ষক কিংসন সামান্য এগিয়ে রয়েছেন। তিনি বল মারেন তার মাথার উপর দিয়ে। বল গিয়ে পড়ে ঘানার জালে। খেলায় আসে সমতা।
খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে সেখানে ঘানার হয়ে সুযোগ মিস করেন কেভিন-প্রিন্স বোয়াটেং। খেলার যখন আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি ছিল, তখন উরুগুয়ের বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পায় ঘানা। ফ্রি কিকে বলটি ফেলা হয় বক্সে থাকা খেলোয়াড়দের জটলার ভেতর। সেখানে বলটি পান স্টিফেন আপিয়াহ। তার শট গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করে দেন সুয়ারেজ, ফিরতি বল পেয়ে যান আদিইয়াহ, তিনি হেড দিয়ে বল জালে পাঠাতে চান। কিন্তু এবারও বাদ সাধেন সুয়ারেজ, এবার বল ঠেকান হাত দিয়ে। ঘানার হওয়া নিশ্চিত গোলটি হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দেন সুয়ারেজ। রেফারির সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি সুয়ারেজকে লালকার্ড দেখান এবং ঘানাকে পেনাল্টি দেন। পেনাল্টি নিতে এগিয়ে আসেন আসামোয়াহ জিয়ান, যিনি এই বিশ্বকাপের আরো ২ গোল করেছিলেন পেনাল্টি থেকে। জিয়ানের সামনে তখন সুযোগ জাতির নায়ক হয়ে দলকে প্রথম আফ্রিকা দেশ হিসেবে ঘানাকে সেমিফাইনালে তোলার।
কিন্তু তিনি কী করলেন? বলে শট নেয়ার আগেই উরুগুয়ের গোলরক্ষক মুসলেরা তার ডানে লাফিয়ে পড়েন। জিয়ান একদম আসুরিক শক্তি দিয়ে বলকে সেদিকেই হিট করেন। বল একটু উপর দিয়ে যাওয়ায় মুসলেরা আর নাগাল পাননি। কিন্তু বলটি জালের ছোঁয়াও পায়নি, গোলবারে লেগে বাইরে চলে যায়। জিয়ানকে দেখে মনে হল যে মুহূর্তের মধ্যে তার শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। রেফারির খেলা শেষের বাঁশি বেজে ওঠে তখনই। একদিকে গোলরক্ষকের উল্লাস, অন্যদিকে স্ট্রাইকারের হতাশাগ্রস্থ চেহারা। ক্যামেরা দেখা যায় টানেলে নিজের জার্সি টেনে উদযাপনরত লুইস সুয়ারেজ; অনেকটা বাজিতে জিতে যাওয়ার আনন্দে তিনি মাতোয়ারা।
জিয়ানকে সতীর্থরা সান্ত্বনা দেয়ার তেমন সময়ও পায়নি। কারণ এরপরই পেনাল্টি শ্যুটআউট শুরু হয়। উরুগুয়ের হয়ে প্রথম পেনাল্টিটি নেন ডিয়েগো ফোরলান, তিনি গোল করেন। এবার ঘানার হয়ে পেনাল্টি নিতে আসেন মিনিটখানেক আগে পেনাল্টি মিস করা জিয়ান। কতটা দৃঢ মনোবলের অধিকারী হলে এমন মুহূর্তে তিনি আবার আসেন পেনাল্টি নিতে! তবে এবার আর আগের ভুল করেননি, নার্ভ ধরে রেখে সুন্দর প্রেসিং শটে বল পাঠিয়ে দেন জালের উপরের কোণায়।
দুই দলই প্রথম ২টি পেনাল্টি থেকেই গোল দেয়। উরুগুয়ে ৩-২ গোলে আগানো অবস্থায় জন মেনসাহর দুর্বল শট ফিরিয়ে দেন মুসলেরা, কিন্তু উরুগুয়ের পরের পেনাল্টিতেই পেরেইরার শটও বারের উপর দিয়ে চলে যায়। এগিয়ে যাওয়ার দারুন একটা সুযোগ হারায় তারা। তবে আবারও পেনাল্টি মিস করে ঘানা। আদিইয়াহ, যার হেড হাত দিয়ে ঠেকিয়েছিলেন সুয়ারেজ, এবার তার পেনাল্টি হাত দিয়ে ফেরান মুসলেরা। ফলে সমীকরণ দাঁড়ায়: পরের পেনাল্টিতে যদি উরুগুয়ে গোল করে, তবে ম্যাচ পুরোপুরি তাদের হয়ে যাবে। এবার আর সুযোগ হাতছাড়া হয়নি তাদের। সেবাস্তিয়ান আব্রু ‘পানেনকা’ শটে গোল করে উরুগুয়ের জয় নিশ্চিত করেন। দারুণ খেলেও হেরে যায় ঘানা। অপরদিকে লাল কার্ডের খাড়া মাথায় নিয়েও উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে যান সুয়ারেজ।
এখন এখানে আপনি খেলায় সুয়ারেজের কাজটিকে কীভাবে দেখবেন? সে একজন জাতীয় হিরো, নাকি আন্তর্জাতিক ভিলেন? আপনার দল এমন পরিস্থিতিতে থাকলে আপনি কী করতেন? সুয়ারেজ যে শাস্তি পেয়েছিলেন, তা-ই ছিল এমন কাজের সর্বোচ্চ শাস্তি।
সুয়ারেজের অবশ্য এইসব নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। নিজেই এটিকে দাবি করেছিলেন ‘সেভ অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ এবং ‘হ্যান্ড অফ গড’। অন্যদিকে জিয়ান ম্যাচের ফলাফল মেনে নিয়ে সুয়ারেজকে ‘জাতীয় হিরো’র খেতাব দেন। ঘটনাটি ঘটার ১২টি বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনো মুখরোচক আড্ডার এক উপকরণ এটি। ফুটবলে মোরালিটি নিয়ে কথা বলতে চাইলে এই ঘটনাটি একদম আদর্শ। কিন্তু যতই আলোচনা হোক না কেন, এই একদিনে বাড়ির পথ থেকে ব্রাজিল আর ঘানাকে ফেরানোর আর কোনো রাস্তা ছিল না।
এই খেলার রেশ ছিল পরেরদিনও, ফুটবল বিশ্ব মুখিয়ে ছিল সুয়ারেজ কী শাস্তি পাচ্ছেন তা দেখতে। অন্যদিকে কেপটাউনে তখন মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপের ইতিহাসে যাদের মধ্যকার ক্লাসিক ম্যাচের উদাহরণ অনেক।
জার্মানির এই পর্যন্ত আসতে বেশ কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়। প্রথম খেলায় সার্বিয়ার সাথে ১-০ গোলে হেরে পরের ঘানাকে হারিয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে আসে তারা। সেকেন্ড রাউন্ডে ইংল্যান্ডকে হারায় তারা ৪-১ গোলে। দুর্দান্ত ফর্মের জার্মানি তখন উড়ছিল মুলার, ওজিল, ক্লোসা, পোডোলস্কি, শোয়াইনস্টাইগারের উপর ভর করে। ২০১০ বিশ্বকাপের আবিষ্কার ছিলেন ওজিল আর মুলার।
অন্যদিকে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দারুণ ফর্মে ছিল আর্জেন্টিনা। তাদের ডাগআউটে ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা, মাঠে ছিলেন সময়ের সেরা লিওনেল মেসি। মেসি কোনো গোল না পেলেও আর্জেন্টিনা সহজেই গ্রুপপর্ব উতরে যায় নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রিসকে হারিয়ে।
আর্জেন্টিনা–জার্মানির মধ্যকার ম্যাচের আগে হয় আরেক বিতর্ক। টমাস মুলারের সাথে প্রেস কনফারেন্সে বসতে অস্বীকৃতি জানান ম্যারাডোনা। তাকে ‘বলবয়’ বলেন তিনি। জার্মানি এই ম্যাচে বলতে গেলে তাদের সব রাগের উদ্গীরণ করে দেয়। মাত্র ৩ মিনিটে তারা আর্জেন্টিনার বক্সের বাইরে ফ্রি-কিক পায়। সেখেন থেকে শোয়াইনস্টাইগারের পাঠানো বলে মাথা ছুঁইয়ে ম্যাচের প্রথম গোল করেন মুলার। এই গোলের পর জার্মানি একেক পর এক আক্রমণ করে দিশেহারা করে ফেলে আর্জেন্টিনার ডিফেন্সকে। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করা যায়নি। মিরোস্লাভ ক্লোসাও মিস করেন সহজ এক সুযোগ। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ডি মারিয়া আর হিগুয়াইনের মিসে খেলায় আর ফেরা হয়নি আর্জেন্টিনার।
৬৮ মিনিটে দলের দ্বিতীয় গোল আসে মিরোস্লাভ ক্লোসার পা থেকে। আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুকে যান পোডোলস্কি, থ্রু পাসও পেয়ে যান একটি। তিনি বলটিকে আলতো করে বক্সে লো ক্রস করেন। রোমেরো ব্লক করতে ব্যর্থ হলে বল পান ক্লোসা। হালকা ছোঁয়ায় ফাঁকা পোস্টে গোল করেন তিনি। ৬ মিনিট পর শোয়াইনস্টাইগার বল নিয়ে বাইলাইনে চলে যান। রোমেরো তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বক্সে বলটিকে কাট ব্যাক করে দেন। সেই বলটি ট্যাপ ইন করে গোল করেন ফ্রিডরিক।
আর্জেন্টিনার কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন ক্লোসা। একদম শেষ মিনিটে তিনি নিজের দ্বিতীয় ও দলের হয়ে চতুর্থ গোলটি করেন। নিজের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের চতুর্দশ গোলটি করে তিনি উদযাপন করেন নিজের আইকনিক বাতাসে ডিগবাজির মাধ্যমে। বিশ্বকাপের ৪ খেলায় ১০ গোল করা আর্জেন্টিনা করুণ আত্মসমর্পণ করে জার্মানদের কাছে। মেসি, ডি মারিয়া, তেভেজ, হিগুয়াইনকে নিয়ে গড়া আক্রমণভাগ ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয় জার্মানির কাছ।
কোয়ার্টার ফাইনালের ৩ ম্যাচই দারুণ উপভোগ্য ছিল ফ্যানদের কাছে। আর বাকি ছিল একটি খেলা। সেখানে ইউরোজয়ী স্পেন মুখোমুখি হয় প্যারাগুয়ের। কাগজে-কলমে পরিস্কারভাবে এগিয়ে ছিল স্পেন। কিন্তু নাটকীয়তায় পূর্ণ কোয়ার্টার ফাইনালে এই খেলাটিই বা নাটক থেকে বাদ যাবে কেন?
স্পেনের এই বিশ্বকাপ যাত্রাই তো শুরু হয় এক নাটকীয় হারে। ক্যাসিয়াসের ভুল বলুন কি যাই বলুন, ওই এক গোলে তারা গ্রুপের ১ম ম্যাচে হারে সুইজারল্যান্ডের কাছ। এরপর আইবেরীয় ডার্বিতে পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আসে। কোয়ার্টার ফাইনাল অব্দি আসতে স্পেন করে ৫টি গোল, তার মধ্যে ৪টিই এসেছিল ডেভিড ভিয়ার পা থেকে।
অন্যদিকে প্যারাগুয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে আসে। তাদের জন্য বাদ পড়ে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। দ্বিতীয় পর্বে তারা মুখোমুখি হয় জাপানের। ১২০ মিনিটে গোলশূন্য ড্রতে শেষ হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ৫টি শট থেকেই গোল করেন প্যারাগুয়ের খেলোয়াড়েরা।
স্পেন পরিষ্কারভাবেই ফেভারিট হলেও তাদের উপর আলাদা একটি চাপ ছিল। এর আগ পর্যন্ত কখনোই তারা তাদের সামর্থ্যের সমান খেলা বিশ্বকাপে দেখাতে পারেনি। এবার সেই সুযোগ ছিল তাদের সামনে।
খেলার প্রথমার্ধে একটি গোল পায় প্যারাগুয়ে। স্পেনের বক্সে আসা একটি ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন অস্কার কারদোজো। কিন্তু বক্সে বলটি যায় ফাঁকায় থাকা নেলসন ভালদেজের পায়ে। ভালদেজ গোলও করেন। কিন্তু লাইন্সম্যান অফসাইডের পতাকা তোলায় গোলটি বাতিল হয়। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা যায়, সেখানে কোনো অফসাইড হয়নি। কারদোজো অফসাইডে থাকলেও তারা সাথে বলের কোনো সংযোগ ঘটেনি। বাজে সিদ্ধান্তের জন্য শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার একটি মোক্ষম সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় প্যারাগুয়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে একটি কর্নার পায় প্যারাগুয়ে। কর্নারের সময় কারদোজোকে টেনে বক্সে ফেলে দেন পিকে। রেফারিও তাৎক্ষণিক পেনাল্টির আদেশ দেন। কারদোজো নিজেই পেনাল্টি নেন। কিন্তু ওই পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেন ক্যাসিয়াস।
কিছু সময় পরই পেনাল্টি আসে অপর প্রান্তে। থ্রু বল ধরতে গিয়ে আলকারাজের পায়ের সাথে ‘ল্যাং’ খেয়ে প্যারাগুয়ের বক্সে পড়ে যান ডেভিড ভিয়া। স্পেনের সেই পেনাল্টি নিতে আসেন জাবি আলোনসো। ধীরস্থিরভাবে শট নেন গোলকিপারের ডান দিকে, গোলও করেন। কিন্তু রেফারি বাঁশি বাজান পেনাল্টি আবার নেয়ার জন্য, কারণ স্পেনের একজন খেলোয়াড় পেনাল্টি নেয়ার পূর্বেই দৌড়ে বক্সে এক পা দিয়ে ফেলেছিলেন। পেনাল্টি রিটেকে আলোনসো এবার মারেন বাম পাশে। কিন্তু সেটি ফিরিয়ে দেন প্যারাগুয়ের গোলরক্ষক। ফিরতি বলে শট দিতে আসেন ফ্যাব্রেগাস কিন্তু তার আগেই গোলরক্ষক বলটি সরিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে বল পেয়ে যান রামোস। তার শট ফিরে আসে পোস্টে লেগে।
খেলা যখন অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই ইনিয়েস্তা প্যারাগুয়ের ৩ জনকে কাটিয়ে বল নিয়ে প্যারাগুয়ের ডিফেন্স গলে ঢুকে পড়েন এবং ফাঁকায় দাঁড়ানো পেদ্রোকে পাস দেন। পেদ্রোর সামনে তখন শুধু গোলরক্ষক। কিন্তু পেদ্রো মারেন পোস্ট বরাবর। পোস্টে লেগে বল আসে ভিয়ার পায়ে। ভিয়ার শটও গিয়ে লাগে আরেক পোস্টে। কিন্তু এবার আগের মতো অন্য খেলোয়াড়ের কাছে বল যায়নি। এক পোস্টে লেগে বল গিয়ে ধাক্কা খায় আরেক পোস্টের সাথে। এবার ধাক্কা খেয়ে অবশেষে বলটি ঢুকে যায় প্যারাগুয়ের জালে।
এই একমাত্র গোলেই প্যারাগুয়েকে হারায় স্পেন। এই জয়েই অবশেষে তারা উঠে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। বিশ্বকাপে তাদের যে বদনাম, তাদের যে অভিশাপ ছিল তা ভাঙ্গার পথে এটি ছিল একটি বড় ধাপ। কারণ সেমিফাইনাল মানে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটাই উঠে যাওয়া।
সেদিন রাতে ফুটবল বিশ্বের মানুষ ঘুমাতে যায় এমন অভূতপূর্ব কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ৪টি খেলায় এমন সব ঘটনা ঘটে, যা ইতঃপূর্বে আর কখনো হয়নি। সচরাচর কোনো বিশ্বকাপ বলুন কিংবা অন্য কোনো টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে ১-২টি খেলা থাকে মনে রাখার মতো। কিন্তু এভাবে চারটি মনে রাখার মত ম্যাচ ইতিহাসেই বিরল। কী ছিল না এই কোয়ার্টার ফাইনালে? ফেভারিটদের হেরে যাওয়া, হিরোর ভিলেইন রূপ, কাল্ট হিরোর আবির্ভাব, আফ্রিকানদের সাহসিকতা ও হৃদয় ভাঙার গল্প, গোলের বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়া, পেনাল্টি নাটক, শাপভঙ্গসহ আরো কত কী!
২০১০ বিশ্বকাপ এভাবেই নিজের পরিচয় রেখেছে ইতিহাসের পাতায়। শুধু এই একটি পর্বই এমন সব নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে যে যারা এর সাক্ষী ছিল তারা এই নিয়ে গল্প করে যেতে পারবে আজীবন।
আফ্রিকার পক্ষ থেকে ফুটবল বিশ্বের জন্য উপহার এটি, বলা যায় কি? কেন নয়!