বাংলাদেশের পর ভারতের মাটিতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো ইংল্যান্ড। তাদের ক্রিকেটের ইতিহাসে এটি একটি দুঃস্বপ্ন, যত দ্রুত ভুলতে পারবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ঢাকা টেস্ট হারার পর ভারতের মাটিতে ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল ইংল্যান্ড। চেন্নাই টেস্টের মধ্য দিয়ে তাদের ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হলো। ম্যাচের শেষ দুই সেশনের আগপর্যন্ত বোঝা যাচ্ছিলো ম্যাচটি নিষ্প্রাণ ড্রয়ের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে শেষ দুই সেশনে ১০ উইকেট হারিয়ে ৫ ম্যাচের সিরিজে ৪-০ তে পরাজিত হয় ইংল্যান্ড।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক সিরিজে এর আগে কখনো ৪টি টেস্ট জিতে নি ভারত। সর্বশেষ টেস্ট সিরিজ জিতেছিলো অর্ধযুগ আগে এবং দুই যুগ আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিলো ভারত।
চেন্নাইয়ে শেষ এবং ৫ম টেস্টে সিরিজে চতুর্থবারের মতো টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ইংলিশ দলপতি অ্যালিস্টার কুক। কিছুদিন আগে চেন্নাইয়ে ঘূর্ণিঝড়ে স্টেডিয়ামের চিত্র বদলে দিয়েছিলো, ঠিক যেমনটা ভারত এই সিরিজে ইংল্যান্ডের দলের চিত্র বদলে দিয়েছে।
চেন্নাই টেস্টে নিজেদের বেঁচে থাকা সম্মান রক্ষার্থে শুরুটা ভালোই করে ইংল্যান্ড। মঈন আলীর ১৪৬ রানের সাথে জো রুটের ৮৮ রান এবং অভিষিক্ত লিয়াম ডসনের ৬৬* ও আদিল রাশিদের ৬০ রানের উপর ভর ৪৭৭ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। প্রায় দুইদিন ফিল্ডিং করে ব্যাট করতে নামা ভারত জবাবটা ভালোই দেয় ইংল্যান্ডকে। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে দুই ওপেনার রাহুল এবং পার্থিব প্যাটেল ১৫২ রান যোগ করেন। এরপর দ্রুত পূজারা এবং কোহলি আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেও কারুন নায়ারকে নিয়ে নিজের প্রথম দ্বি-শতকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন রাহুল। কিন্তু দিনের সবচেয়ে বাজে বলে ১৯৯ রানে আদিল রাশিদের শিকারে পরিণত হন রাহুল। টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৯ জন ব্যাটসম্যান ১৯৯ রানে আউট হয়েছেন।
রাহুল আউট হয়ে গেলেও আশ্বিন, জাদেজাদের নিয়ে দ্বিতীয় ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে ৩০৩* রানের অপরাজিত থাকেন মাত্র ৩য় টেস্ট খেলতে নামা কারুন নায়ার।
কারুন নায়ারের ৩০৩* রানের সাথে আশ্বিনের ৬৭ এবং জাদেজার ৫১ রানের ইনিংসে ভারত নিজেদের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে। শেষ পর্যন্ত ৭ উইকেটে ৭৫৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
প্রথম ইনিংসে ৪৭৭ রান করেও ২৮২ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ইংল্যান্ড। ম্যাচের ৫ম দিনের ১ম সেশন পর্যন্ত ম্যাচে ছিলো ইংল্যান্ড। কিন্তু শেষ দুই সেশনে এসে খেই হারিয়ে ফেলে কুকবাহিনী। ৪ উইকেটে ১৯২ রান থেকে ২০৭ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। এতে করে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে টানা দুই ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে পরাজিত হলো ইংল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে ৪৭৭ রান বা তার চেয়ে বেশি রান করে ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ হারার রেকর্ড ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামান রবীন্দ্র জাদেজা, ৭ উইকেট নিয়ে একাই ড্র হওয়া ম্যাচ জিতিয়ে দেন জাদেজা। আজকে তাকে দেরিতে ব্যবহার করেন কোহলি। সিরিজে এর আগে ৫ বার কুককে আউট করার পরেও প্রথম ১৮ ওভারে তাকে বোলিংয়ে আনেন নি বিরাট।
ভারতের বিপক্ষে সিরিজটা যতটা বাজে ভাবে শেষ হয়েছে ততটা বাজে ভাবে শুরু করে নি ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের সাথে ঢাকা টেস্টে পরাজয়ের স্মৃতি নিয়ে ভারতে প্রথম টেস্টে ভালোই শুরু করেছিলো ইংল্যান্ড। রাজকোটে প্রথম টেস্টে জো রুট, মঈন আলী এবং বেন স্টোকসের শতকে প্রথম ইনিংসে ৫৩৭ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। জবাবে ভারতের হয়ে বিজয় এবং পূজারার শত রানের ইনিংস খেলার পরেও ইংল্যান্ড ৪৯ রানের লিড পেয়েছিলো।
দ্বিতীয় দফা ব্যাট করতে নেমে অ্যালিস্টার কুকের ১৩০ রানের ইনিংসের সহায়তায় ৩ উইকেটে ২৬০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেছিলো ইংল্যান্ড। ভারতের মাটিতে কুকের এটি ৫ম শতক এবং ইংলিশ অধিনায়ক হিসাবে ১২তম শতক ছিলো। দুটিই অ্যালিস্টার কুকের একক রেকর্ড।
স্বাগতিক ভারতকে প্রথম টেস্টেই কাঁপিয়ে দেয় ইংলিশরা। তাদের দেয়া ৩১০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৭১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। এরপর বিরাটের দায়িত্বশীল ৪৯* রান এবং আশ্বিন ও জাদেজার যোগ্য সহায়তায় ম্যাচ রক্ষা করতে সক্ষম হয় ভারত।
১ম টেস্ট থেকে সঞ্চিত আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামে ইংল্যান্ড। ঐ এক ম্যাচেই বিরাট কোহলি টসে জিতেছেন। বিশাখাপত্তমে স্বাভাবিকভাবে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। বিরাট কোহলির ১৬৭ রান এবং পূজারার ১১৯ রানের উপর ভর করে ৪৫৫ রান করেছিলো ভারত। জবাবে আশ্বিনের ৫ উইকেট শিকারে ২৫৫ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ১ম ইনিংসে ২০০ রানের লিড নিয়ে ব্যাট করতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ২০৪ রানে অল আউট হয়ে গেলেও ততক্ষণে ইংল্যান্ডের সামনে ৪০৫ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায়।
ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নেমে সবচেয়ে বড় ভুল করে ড্রয়ের জন্য খেলে। ওপেনিং উইকেট জুটিতে হামিদ এবং কুক ৫০ ওভার নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিলেও পরের ব্যাটসম্যানরা কেউই দাঁড়াতে পারেন নি ক্রিজে। শেষ পর্যন্ত ১৫৮ রানে অল আউট হয়ে ২৪৬ রানের ম্যাচ হেরে যায় ইংল্যান্ড। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি তারা। মোহালিতে ৩য় টেস্টে রবীন্দ্র জাদেজার অলরাউন্ডিং নৈপুণ্যে ৮ উইকেটের জয় পায় ভারত। ঐ ম্যাচটি মূলত ভারতের লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের কাছেই হেরে যায় ইংল্যান্ড। ঐ ম্যাচে ইংল্যান্ডের প্রাপ্তি বলতে হাসিব হামিদের আহত হাত নিয়ে অসাধারণ এক ইনিংসই ছিলো।
মুম্বাইয়ে ৪র্থ টেস্টে সিরিজ জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নামে ভারত। আবারো টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। অভিষিক্ত জেনিংসের শতক এবং জস বাটলারের ৭৬ রানের উপর ভর করে বরাবর ৪০০ রান করে ইংল্যান্ড।
জবাবে অধিনায়ক বিরাট কোহলির ২৩৫ রান, ওপেনার মুরালি বিজয়ের ১৩৬ রান এবং নয় নাম্বারে ব্যাট করতে নামা জয়ন্ত যাদবের ১০৪ রানের ইনিংসে ৬৩১ রান সংগ্রহ করে ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩১ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে আশ্বিনের বোলিং তোপে পড়ে মাত্র ১৯৫ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। এতে করে ইনিংস ও ৩৬ রানের জয়ে সিরিজ জিতে নেয় ভারত। জো রুটের ৭৭ রান এবং বেয়ারস্টোর ৫১ রান ছাড়া আর কেউই উল্লেখযোগ্য রান করতে পারে নি। ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়েও ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেন নি আশ্বিন। ২৩৫ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন বিরাট কোহলি।
টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের নেতৃত্ব পাওয়ার পর ভিন্ন এক বিরাট কোহলিকে দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব। অভিষেকের পর থেকেই ওডিআইতে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে আসছেন বিরাট কোহলি। এ বছর টেস্ট, ওডিআই এবং টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট সব বিভাগেই সাফল্য পাচ্ছেন তিনি। বিরাট কোহলি এ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ১৮ ইনিংসে ৭৫.৯৩ ব্যাটিং গড়ে ১২১৫ রান করেছেন। ডিআইতে ১০ ইনিংসে ৯২.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ৭৩৯ রান এবং টি-টুয়েন্টিতে ১৩ ইনিংসে ১০৬.৮৩ ব্যাটিং গড়ে ৬৪১ রান করেছেন তিনি। অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে ২২ ম্যাচে ৬৩.৯৬ ব্যাটিং গড়ে ২১১১ রান করেছেন কোহলি। অধিনায়ক হওয়ার আগে তার টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং গড় ছিলো ৪০ এর ঘরে।
২৩৫ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্ট, ওডিআই এবং টি-টুয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই ব্যাটিং গড় ৫০+ বিরাট কোহলির (টেস্ট ক্রিকেটে ৫০.১০, ওডিআইতে ৫২.৯৩ এবং টি-টুয়েন্টিতে ব্যাটিং গড় ৫৭.১৩)। মাইকেল ক্লার্ক, ব্রাডম্যান, রিকি পন্টিং এবং ম্যাককালামের পর ৫ম ব্যাটসম্যান হিসাবে এক পঞ্জিকাবর্ষে ৩টি দ্বি-শতক হাঁকালেন বিরাট কোহলি। ক্যারিয়ার সেরা ২৩৫ রানের ইনিংস খেলার পথে ভারতীয় অধিনায়ক হিসাবে তিনি এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন। মাহেন্দ্র সিং ধোনির করা ২২৪ রানের ইনিংসটিকে টপকে ২৩৫ রান করেন কোহলি। অধিনায়ক হিসাবে তার ব্যাটিং গড় ৬৩.৯৬। টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ের দিক দিয়ে ২য় স্থানে আছেন কোহলি। ১০১.৫১ ব্যাটিং গড় নিয়ে সবার উপরে আছেন ডন ব্রাডম্যান । টেস্ট সিরিজের পর লম্বা সময় বিরতি আছে। ইংল্যান্ড এক মাসের বেশি সময় পাবে নিজেদের নতুনভাবে দাঁড় করানোর।