ইতালির সমৃদ্ধ ইতিহাস তাদের প্রতিটি শহর ঘিরেই। রোম, ফ্লোরেন্স, ভেনিস কিংবা পার্মা সবগুলো শহরই শিল্প-সংস্কৃতির আঁতুড় ঘর। তবে ‘৯০ এর দশকের দিকে পার্মা শহরটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও একই সময়ে ফুটবলের জগতেও ঘটে পার্মার উত্থান। ক্যাম্পানিলিসমো, যার শাব্দিক অর্থ শহরপ্রীতি, সবচেয়ে বেশি দেখা যেতো পার্মার মানুষদের মধ্যেই। নিজেদের স্থান বা ঐতিহ্য নিয়ে বরাবরই গর্ববোধ করে পার্মার বাসিন্দারা। তবে ফুটবলের বিচারে সেসময় ঢের পিছিয়ে পার্মা। জুভেন্টাস, মিলান, রোমাদের তুলনায় পার্মা নিতান্তই সাধারণ ক্লাব। তবে পার্মার বাসিন্দাদের আরেকটু গর্ব করার সুযোগ দিতেই ‘৯০ এর দশকে সবাইকে চমকে দিয়ে ঘটে ক্লাব পার্মারও উত্থান।
১৯৯২ সাল থেকে ২০০২- এই এক দশকে দুটি উয়েফা কাপ, একটি ইউরোপিয়ান কাপ, একটি ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, তিনটি কোপা ইতালিয়া জেতা পার্মার উত্থানের শুরু ১৯৮৫ থেকেই। তৎকালীন পার্মার কোচ আরিগো সাচ্চির আবিষ্কার ডায়মন্ড আকৃতির ৪-৪-২ ফর্মেশনই আমূল বদলে দেয় পার্মাকে। জোনাল মার্কিংয়ের সাথে দুর্দান্ত প্রেসিং; যার ফলস্বরুপ ১৯৮৫ সালে সিরি বি-তে উত্তীর্ণ হয় পার্মা। এর ঠিক দুই বছর পরেই ১৯৮৬-৮৭ মৌসুম শেষে সিলভিও বেরলুস্কোনির ফোন পেয়ে পার্মা ছেড়ে এসি মিলানে যোগ দেন সাচ্চি। সেখানে গিয়ে মিলানকে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেলেও পার্মার ইতিহাসে তিনি এখনও জীবন্ত।
সাচ্চির চলে যাওয়ার পর পার্মা প্রেসিডেন্ট আর্নেস্তো চেসেরিনি সেবারই পার্মালটের সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তিতে যান। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই সিরি ডি থেকে সিরি বি এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে থাকা পার্মার ভাগ্যও তখন স্থির হয়। সাচ্চির পর প্রথম কোচ হয়ে আসেন নেভিও স্কালা। আগের মৌসুমে ক্লাব রেগিনাকে সিরি বি-তে প্রমোশন করানো স্কালার কোচিংয়ের ধরন খুব পছন্দ হয়ে যায় চেসেরিনির। পার্মার দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই ক্লাবে নিজের প্রভাব ফেলতে শুরু করেন তিনি। সাচ্চির ৪-৪-২ ফর্মেশন থেকে সরে এসে দলকে তিনি খেলানো শুরু করেন ৫-৩-২ ফর্মেশনে। এই পরিবর্তন দ্রুতই সাফল্য বয়ে আনে পার্মার জন্য। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সিরি বি-তে নিজেদের স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী রেজিনাকে ২-০ গোলে হারিয়ে চতুর্থ স্থান ধরে রেখে সিরি আ-তে উত্তীর্ণ হয় পার্মা। নিজেদের আগের ৭৭ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সিরি আ-তে খেলার সুযোগ অর্জন করে নেয় তারা।
তবে এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি চেসেরিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা এই ভদ্রলোক এর কয়েক মাস আগেই পরলোক গমন করেন। তবে এটি একদিক দিয়ে শাপেবর হয়েই আসে পার্মার জন্য। চেসেরিনির মৃত্যুর পর পার্মা ক্লাবের ৯৮% শতাংশই কিনে নেয় পার্মালট। প্রেসিডেন্ট পদে আসেন পার্মালটেরই প্রেসিডেন্ট ক্যালিস্টো তানজি। তিনি এসেই দলের খোলনলচে পাল্টে দেন। দলে ভেড়ান ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক তাফারেল আর বেলজিয়ান সুইপার কিপার জর্জ গ্রুনকে। ব্যাকলাইনের জন্য আসেন লুইগো এপোলিনি ও লরেঞ্জো মেনোত্তি। আলেসান্দ্রো মেলির পাশাপাশি সুইডিশ প্রতিভাবান মিডফিল্ডার থমাস ব্রলিনকেও মাঝমাঠে আনেন তানজি।
এতসব খেলোয়াড় পেয়ে স্কালা নিজের ফর্মেশনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যান। দুই ফুল ব্যাককে উইং ব্যাক করে দিয়ে মূলত ৩-৫-২ ফর্মেশনে চলে যান। সেবার স্কালার অধীনে অভাবনীয় সাফল্য পায় তারা। প্রথম মৌসুমেই লিগে পঞ্চম স্থান অর্জন করে উয়েফা কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয় পার্মা।
পরের মৌসুমে এসে কিছুটা অবনমিত হয়ে সপ্তম স্থানে চলে গেলেও মৌসুম শেষে কোপা ইতালিয়া ফাইনালে জুভেন্টাসকে হারিয়ে পার্মা জানান দেয় যে, হারিয়ে যেতে আসেনি তারা। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম শিরোপাও ছিলো কোপা ইতালিয়ার শিরোপাটি। আর এই শিরোপা দিয়েই শুরু হয় পার্মার ইতিহাসের স্মরণীয় দশ বছর, আর জুভেন্টাসের সাথে এক তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাও।
এদিকে ততদিনে পার্মা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। দেদারসে জার্সি বিক্রিও চলছে। আর পার্মালট নামের ডেইরি কোম্পানির ব্যবসাও সেই সুবাদে তুঙ্গে। একদিকে যেমন অর্থ আসছিলো, আবার সেই অর্থ খরচ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি পার্মা প্রেসিডেন্ট। পরের মৌসুমেই নাপোলি থেকে ক্লাবে যোগ দেন জিয়ানফ্রাঙ্কো জোলা। এছাড়া নেস্তর সেনসিনি, মাসিমো ক্রিপ্পা দলের গভীরতাও বাড়িয়ে দেয়। উদিনেস থেকে আসেন এস্পিরিলা। এই এস্পিরিলার জোড়া গোলেও ভিসেন্তে ক্যালদেরনে গিয়ে এটলেটিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে বসে পার্মা। ইউরোপিয়ান কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ ছিলো সেটি। পরবর্তীতে ওয়েম্বলিতে ফাইনালে জিতে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কাপও জিতে নেয় পার্মা। ঘরোয়া লিগে সেই মৌসুমে তৃতীয় হয়েছিলো ক্লাবটি। তবে লিগে তার চেয়েও ঐতিহাসিক অর্জন ছিলো ফ্যাবিও ক্যাপেলোর এসি মিলানের টানা ৫৮ ম্যাচ জয়ের ধারা ভাঙাটা।
১৯৯৪/৯৫ মৌসুম ছিলো স্কালার দলের শীর্ষে আরোহনের সময়কাল। সেবার জুভেন্টাসের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলেছিলো পুরো মৌসুম ধরেই। লিগ জুভেন্টাসের পেছনে থেকে দ্বিতীয় আর কোপা ইতালিয়ার ফাইনালেও জুভেন্টাসের কাছে হারার প্রতিশোধ পার্মা নেয় ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে। মার্সেলো লিপ্পির দলকে স্কালার দল হারায় ২-১ গোলে। তবে তখনও স্কুদেত্তো জেতা হয়নি ক্লাবটির। দলের পূর্ণতা আনতে এর পরের মৌসুমে তানজি দলে ভেড়ান রিস্টো স্টইচকভকে। ১০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এই বুলগেরিয়ান যোগ দেন পার্মাতে। রিস্টো স্টইচকভ দলে আসায় মূলত বিপদে পড়েন স্কালা। স্টইচকভের দলের অন্তর্ভূক্তিতে অবশ্যই দলের ট্যাকটিকাল কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তিনি তা না করায় সেই সিজন শেষে পয়েন্ট টেবিলে পার্মার স্থান থাকে ছয়ে। তাই স্কুদেত্তোর নেশায় এবার স্কালাকে সরিয়ে ডাগ আউটে আনা হয় কার্লো আনচেলোত্তিকে।
কার্লো আসার পর দলে তরুণ কিছু প্রতিভাবান যোগ দেওয়ায় পার্মার স্কুদেত্তো জয়ের আশার পালেও হাওয়া লাগে। লিলিয়ান থুরাম, বুফন, ক্রেসপো, চিয়েসা, স্ট্যানিচ, ক্যানাভারো পরবর্তীতে দুনিয়া কাঁপানো এসব খেলোয়াড়দের যাত্রা শুরু হয়েছিলো পার্মাতে একইসাথে। কার্লো আনচেলত্তি দলকে পুনরায় ক্লাসিক্যাল ফর্মেশন ৪-৪-২ এ খেলানো শুরু করেন। প্রথম মৌসুমেই সাফল্য ধরা দিয়েছিলো প্রায়। ভাগ্য আর নিজেদের দোষেই স্কুদেত্তো ফসকায় সেবার। চার ম্যাচ বাকি থাকা অবস্থায় মিলান ও জুভেন্টাসের সাথে ড্র হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জুভেন্টাস থেকে ২ পয়েন্ট পিছিয়ে লিগ টেবিলে দ্বিতীয় হয় পার্মা।
তবে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৯৮/৯৯ মৌসুমই হয় ক্লাবের ইতিহাসের সেরা সাফল্য। আগের মৌসুমে ব্যর্থ হওয়ার পর তানজির স্কুদেত্তোর প্রতি আচ্ছন্নতা আরো বেড়ে যায়। আর ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে সরে দাঁড়ান আনচেলোত্তি। তার জায়গায় আসেন ফিওরেন্টিনা কোচ আলবার্তো ম্যাসেলিনি।
ম্যাসেলিনির যোগদান শুধু শিরোপার জন্যই নয়, বরং সুন্দর ফুটবলের জন্যও। সেবার প্রেসিডেন্ট দলে রবার্তো ব্যাজ্জিওকে ভেড়াতে চাইলেও ম্যাসেলিনি রাজি ছিলেন না। কোনো তারকা খেলোয়াড় দলে না টানার পক্ষেই ছিলেন তিনি। দলগত সুন্দর ফুটবলের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাই সাফল্যও আসলো হাতেনাতে। বুফনকে গোলকিপার ভূমিকায় রেখে সামনে তিনি খেলালেন থুরাম, ক্যানাভারো আর সেনসিনিকে। মাঝমাঠে ভেরনকে রেখে সামনে চিয়েসা আর ক্রেসপোই দলকে করে তোলেন অপ্রতিরোধ্য। সেবার কোপা ইতালিয়া ও উয়েফা কাপ ফাইনাল দুটিই জিতে নেয় পার্মা। উয়েফা ফাইনালে মার্শেইয়ের সাথে ৩-০ জয়ে তাদের নিয়ে ছেলেখেলায় মেতেছিলো ক্রেসপো-ভেরনরা।
মাঝে কিছু শিরোপা জিতলেও ২০০২ সালে আবার কোপা ইতালিয়াই পার্মার শেষ শিরোপা হয়ে থাকে। এরপরই অর্থনৈতিকভাবে ধস নামে ক্লাবটির। পার্মালট ছিলো ইতালির অষ্টম সর্ববৃহৎ কোম্পানি, যা কি না ইতালির জিডিপির ১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করতো। সেই কোম্পানিই দেউলিয়া হয়ে গেলো। ২০ বিলিয়ন ইউরো ঋণের বোঝা নিয়ে জেলে গেলেন প্রেসিডেন্ট ক্যালিস্তো তানজি। দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছর জেলও খাটেন তিনি। অন্যদিকে উপায় না পেয়ে আর টাকার অভাবে ক্লাবও খেলোয়াড় বিক্রি করা শুরু করে। ক্রেসপো ও ভেরন দুজনই লাজিওতে চলে যান ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। বুফন ও থুরাম ৮০ মিলিয়নের বিনিময়ে যোগ দেন জুভেন্টাসে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। এত বিশাল বড় ঋণের সামনে এই অর্থ নিতান্তই নগণ্য। পার্মার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, যার জন্য পুরো দায়ী তানজি ও তার পরিবারের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ।
সেই পার্মা এখন কালেভদ্রে খেলে সিরি আ-তে। শিরোপা জয় তো দূরে থাক, মাথা উঁচু করেই আর দাঁড়ানো হয়নি ক্লাবটির। পার্মার স্থানীয় একটি বচন ছিলো এরকম যে, “যখন তুমি গাছে উঠবে মনে রাখবে তুমি যত উঁচুতে উঠবে গাছের শাখা-প্রশাখা তত চিকন ও হালকা হবে, আর তুমি মাটি থেকেও অনেক দূরে অবস্থান করবে।” পার্মার উত্থান-পতনের সাথে বচনটি মিলে যায় সম্পূর্ণরুপেই।
খেলাধুলার চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
ফুটবল সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো: