প্রথম পর্বে আমরা বলেছিলাম ইউরো ২০০৮-এর গ্রুপ পর্বের গল্পগুলো। আজ শেষ পর্বে আমরা বলবো ঐ টুর্নামেন্টের নকআউট পর্ব এবং স্পেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনের গল্পগুলো।
প্রতিটি গ্রুপের প্রথম দুটো দল, অর্থাৎ চারটা গ্রুপ থেকে মোট আটটা দল নিজেদের নাম লেখায় কোয়ার্টার ফাইনালে। গ্রুপ ‘এ’-এর চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল মুখোমুখি হয় গ্রুপ ‘বি ‘-এর রানার্সআপ জার্মানির। একইভাবে গ্রুপ ‘বি’-এর চ্যাম্পিয়ন ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল ‘এ’-এর রানার্স আপ তুরস্ক। অপর দুই ম্যাচে ছিল গ্রুপ ‘সি’ ও ‘ডি’ এর চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডস ও স্পেন যথাক্রমে মুখোমুখি হয় রাশিয়া ও ইতালির।
কোয়ার্টার ফাইনাল-১ (পর্তুগাল বনাম জার্মানি)
যেকোনো টুর্নামেন্টে জার্মানি চিরকালই ‘ফেভারিট’। আর সেই জার্মানির প্রতিপক্ষ সর্বশেষ আসরের রানার্সআপ পর্তুগাল, নকআউট পর্বের এমন জিভে জল আনা হাই-ভোল্টেজ লড়াইটার দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো ফুটবল-দুনিয়া। আর এমন ম্যাচের আগেই কি না পর্তুগিজ শিবিরে দেখা দিল অস্থিরতা!
চেলসির তরফ থেকে ঘোষণা এলো, ইউরোর পরেই ম্যানেজারের দায়িত্ব নেবেন পর্তুগালের কোচ লুই ফেলিপে স্কলারি, ওদিকে রিয়াল মাদ্রিদ প্রতিনিয়ত চুক্তি করার চাপ দিয়ে যাচ্ছিল দলের সেরা তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে, এর সাথে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়; সব মিলিয়ে যে মোমেন্টাম নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল পর্তুগাল, সেটা হারিয়ে ফেলে নকআউট পর্ব শুরু হতে না হতেই। ম্যাচেও এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ম্যাচের শুরু থেকেই আধিপত্য ছিল জার্মানির, ঘড়ির কাঁটায় আধঘণ্টা পেরোনোর আগেই পর্তুগালের গোলরক্ষক রিকার্ডো বাধ্য হলেন নিজেদের জাল থেকে দুইবার বল কুড়িয়ে আনতে। বাইশতম মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে পোডলস্কির ক্রসে পা লাগিয়ে গোলের সূচনা করেন বাস্তিয়ান শোয়াইন্সটাইগার। ২৬ তম মিনিটে শোয়েন্সটাইগারের ফ্রি-কিকে মাথা লাগিয়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন অরক্ষিত মিরোস্লাভ ক্লোসা। বিরতির আগে নুনো গোমেজের গোলে ম্যাচে পর্তুগিজরা ফেরার ইঙ্গিত দিলেও ৬১তম মিনিটে আবারও শোয়াইন্সটাইগারের ফ্রিকিকে মাইকেল বালাকের গোলে কার্যত সব আশা শেষ হয়ে যায় পর্তুগালের। ৮৭ মিনিটে পস্তিগার গোলে শুধু ব্যবধানটাই কমেছে। ৩-২ ব্যবধানের জয়ে জার্মানি প্রথম দল হিসেবে নাম লেখায় সেমিফাইনালে।
কোয়ার্টার ফাইনাল-২ (ক্রোয়েশিয়া বনাম তুরস্ক)
শেষ চারে জার্মানির প্রতিপক্ষ কে হবে, সেটা নির্ধারণের ম্যাচই ছিল এই দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনাল, যেখানে মুখোমুখি হয় গ্রুপ ‘বি’-এর চ্যাম্পিয়ন ক্রোয়েশিয়া আর গ্রুপ ‘এ’-এর রানার্স আপ তুরস্ক। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের শেষ মুহূর্তে দুটো গোল দিয়ে টেনেটুনে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা তুরস্কের বিপক্ষে জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর পোল্যান্ডকে পরাজিত করা ক্রোয়েশিয়াই ছিল ‘ফেভারিট’, অন্তত খাতা-কলমে তো বটেই। পাশাপাশি, শেষ মুহূর্তে কোয়ার্টারের টিকেট নিশ্চিত করা তুরস্কের ‘হার না মানা’ মনোভাব নিয়ে কোন সন্দেহ না থাকলেও গোলরক্ষক ভলকানের লাল কার্ডজনিত নিষেধাজ্ঞা আর নিয়মিত কয়েকজন খেলোয়ড়ের চোট তাদের জন্য কাজটা আরও কঠিন করে দিয়েছিল।
দুই দলের জন্যই পুরো ম্যাচটা বেশ কঠিন ছিল, সুযোগ এসেছিল দুই দলের কাছেই। তবে সেরা সুযোগগুলো পেয়েছিল ক্রোয়েশিয়াই, আর প্রতিবারই কোনো না কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল তুর্কিরা। নব্বই মিনিট গোলশূন্য থাকার পর ম্যাচটা তাই গড়ায় অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে।
অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে, ১১৯ মিনিটের মাথায় একটা ভুল করে বসেন নিয়মিত গোলরক্ষক ভলকানের অনুপস্থিতিতে খেলতে নামা রুস্তু রেসবার। বলের দখল নিতে পোস্ট ছেড়ে একটু বেশি দূরে চলে গিয়েছিলেন তিনি, লুকা মডরিচ সেই সুযোগে বল কেড়ে নিয়ে ক্রস করেন বক্সের ভেতরে থাকা ইভান ক্লাসনিচকে। গোললাইন থেকে হাতছোঁয়া দূরত্বে থাকা ক্লাসনিচের কোন সমস্যাই হয়নি বলটাকে জালে জড়াতে। ‘তুরস্কের হৃদয় ভেঙে’ ক্রোয়েশিয়ার জয়োল্লাস তখন ছুঁয়ে গেছে কোচ স্লাভেন বিলিচকেও, পুরো ক্রোয়াট দলটাই তখন উদযাপন করছে মাঠে।
কিন্তু তুরস্কের হৃদয় তো এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাওয়ার নয়। কোচ ফাতিহ তেরিম আবারও উজ্জীবিত করলেন তাঁর খেলোয়াড়দের, আরেকবার লড়ার প্রাণশক্তি জোগালেন। ১২০ মিনিটের পরে ইনজুরি সময়ে মাঝমাঠের কাছাকাছি জায়গায় ক্রোয়েশিয়াকে অফসাইডের ফাঁদে ফেলে ফ্রি-কিক আদায় করল তুরস্ক, সব খেলোয়াড়কে সামনে পাঠিয়ে দিয়ে ফ্রি-কিক নিতে নিজেই এগিয়ে এলেন গোলরক্ষক রুস্তু রেসবার। শেষ সুযোগ!
রস্তু বলটা ভাসিয়ে সিলেন বাতাসে, সেটা খুঁজে নিল ফরোয়ার্ড সেমিহ সেনতুর্কের মাথা। এরপর তার অসাধারণ শটে বল জড়াল পোস্টের উপরের বাঁ কোণের জালে। আরো একবার পিছিয়ে পড়েও হাল না ছাড়ার নজির স্থাপন করলো তুর্কিরা, আরো একবার শেষ মুহূর্তে ম্যাচের ফলাফল বদলে দিল ‘কামব্যাক কিং’রা।
কিন্তু তখনো তো সব শেষ হয়ে যায় নি। ম্যাচটা টাইব্রেকারে গড়িয়েছে, সেখানে তো দুই দলের সমান সুযোগ আছে ম্যাচ জেতার! না, মাত্রই ছাইয়ের গাদা থেকে বিপুল বিক্রমে উঠে আসা তুর্কিদের মনোবলের সামনে অসহায় দেখাল ক্রোয়েশিয়াকে। মদরিচ, রাকিটিচরা পেনাল্টি মিস করলেন, ওদিকে তুরস্কের প্রত্যেক পেনাল্টি-টেকারই বল জড়ালেন জালে। তখনও রুস্তুর নায়ক হওয়া বাকি। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ক্রোয়েশিয়ার চতুর্থ শটে। ম্লাদেন পেত্রিচের শটটা ঠেকিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিত করলেন, ক্রোয়েশিয়া নয়, টাইব্রেকারে ৩-১ ব্যবধানে জিতে সেমিফাইনালে যাচ্ছে তুরস্কই। হয়তো আরো একটা রূপকথার আশায়!
কোয়ার্টার ফাইনাল-৩ (নেদারল্যান্ডস বনাম রাশিয়া)
তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুটো দুর্দান্ত দল, একদিকে ফ্রান্স-ইতালিকে পেছনে ফেলে গ্রুপসেরা হওয়া নেদারল্যান্ডস, অন্যদিকে আরশাভিনের প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত রাশিয়া। তবে দলীয় সমন্বয়, ফর্ম আর পুরো টুর্নামেন্টে খেলার ধরন বিবেচনায় নেদারল্যান্ডসকে কিছুটা এগিয়ে রাখাটা দোষের ছিল না।
তবে খেলার ধরন যেমনই হোক, গাস হিডিঙ্কের রাশিয়া কিন্তু পুরো ১২০ মিনিটই লড়ে গেলো মার্কো ফন বাস্তেনের নেদারল্যান্ডসের চোখে চোখ রেখে। দুই দলই খেলল চমৎকার আক্রমণাত্মক ফুটবল। আরশাভিনের ঝলকে রাশিয়াই একটু এগিয়ে ছিল বরং, আর খেলার সেই ধারাতেই ৫৬ মিনিটের মাথায় রোমান পাভলিউচেঙ্কোর গোলে এগিয়ে যায় রাশানরা। এই গোলটাই প্রায় সেমিফাইনালে পৌঁছে দিচ্ছিল গাস হিডিঙ্কের দলকে, তবে নির্ধারিত সময়ের চার মিনিট বাকি থাকতে ওয়েসলি স্নেইডারের ফ্রি-কিকে মাথা লাগিয়ে ডাচদের সমতায় ফেরান রুড ফন নিস্তলরয়। ম্যাচটা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, তবে আরশাভিনের নেতৃত্বে রাশান-আধিপত্য বজায় ছিল এই সময়েও।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে, ১১২তম মিনিটে, বাঁ প্রান্ত থেকে আরশাভিনের ক্রস খুঁজে নেয় দিমিত্রু তরবিনস্কিকে। ডাচ রক্ষণসেনারা মার্কিংয়ে ভুল করেছিলেন, কিন্তু তরবিনস্কি ভুল করেননি, ২-১ এ এগিয়ে দেন রাশিয়াকে।
এর চার মিনিট পরে আবারও ম্যান মার্কিংয়ে ভুল নেদারল্যান্ডসের, আবারও ভুলের মাশুল দিতে হলো, আর সেই পরিচিত ‘জল্লাদ’-এর নাম আন্দ্রে আরশাভিন। দ্রুত থ্রো-ইন থেকে ফাঁকায় বল পেয়ে যান তিনি, এরপর শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন কমলা-কফিনে। ফন নিস্তলরয়, স্নেইডার, রোবেন, ফন পার্সিদের মতো দারুণ সব খেলোয়াড় পেয়েও ডাচরা আটকে গেল শেষ আটে।
কোয়ার্টার ফাইনাল-৪ (ইতালি বনাম স্পেন)
গ্রুপপর্বে সবগুলো ম্যাচ জিতে নকআউটে উঠলেও কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির পাশাপাশি স্পেনের প্রতিপক্ষ ছিল ইতিহাস। ১৯২০ সালের অলিম্পিকের পর স্পেন কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ইতালিকে পরাজিত করতে পারেনি, ১৯৮৪ এর পর কখনো সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি লা রোহারা।
নির্ধারিত নব্বই ও অতিরিক্ত ত্রিশ, সর্বমোট ১২০ মিনিটের লড়াইয়ের পরও দুই দলের রক্ষণ অক্ষত থাকার পরে ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণের একটা পথই খোলা থাকে, দুই দলের দুই অধিনায়ক, সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াস আর জিয়ানলুইজি বুফনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া। টাইব্রেকার নামক এই লড়াইয়ে ড্যানিয়েল ডি রসি আর আন্তোনিও ডি নাতালের শট ঠেকিয়ে দেন ক্যাসিয়াস, বুফন ফিরিয়ে দেন দানি গুইজাকে। স্পেনের হয়ে পঞ্চম শট নেওয়ার আগে তাই সেস ফ্যাব্রিগাসের সামনে সমীকরণ একদম পরিষ্কার, গোল করলেই সেমিফাইনালে! ভুল করেননি ফ্যাব্রিগাস, ৪-২ এ জিতে স্পেনও উঠে গেলো শেষ চারে।
সেমিফাইনাল-১ (জার্মানি বনাম তুরস্ক)
একদিকে ‘ফেভারিট’ জার্মানি, আরেকদিকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াইয়ের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠা তুরস্ক, প্রথম সেমিফাইনালটা তাই জমজমাট এক ম্যাচেরই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল। গ্রুপপর্বে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারলেও জার্মানরা সেই ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠেছিল কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে পরাজিত করে। আর তুরস্ক তো পুরো টুর্নামেন্টে এগিয়ে চলছিল শেষ মুহূর্তে করা গোলগুলোর ওপর ভর করে।
তবে সেমিফাইনালে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। বাসেলে অনুষ্ঠিত ঐ ম্যাচের ২২তম মিনিটে গোল করে এগিয়ে যায় তুর্কিরা। জার্মানি অবশ্য ম্যাচে ফিরতে বেশি সময় নেয়নি, ২৬তম মিনিটেই শোয়েন্সটাইগারের গোলে সমতা ফেরায় তারা। এরপর ৭৯ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসার গোলে এগিয়ে যায় জার্মানি, কিন্তু প্রতিপক্ষ যেহেতু তুরস্ক, ম্যাচ তো এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে না! ৮৬তম মিনিটে সেমিহ সেনতুর্কের গোলে ম্যাচে সমতা ফেরায় তুর্কিরা। ম্যাচের শেষ গোল তো তুরস্কই করবে, টুর্নামেন্টের ইতিহাস তো এটাই বলে, নাকি?
না, তুরস্কের সৌভাগ্যের কোটা শেষ হয়ে গিয়েছিল কোয়ার্টারে ফাইনালেই। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। ম্যাচটা যখন অতিরিক্ত সময়ে যাচ্ছে প্রায় নিশ্চিতভাবেই, এমন সময়ে, ম্যাচের নব্বইতম মিনিটে ফিলিপ লামের অসাধারণ গোলে ফাইনালে পৌঁছে যায় জার্মানি। শেষ চার থেকেই বিদায় নিতে হয় তুরস্ককে, সাথে অবশ্য দর্শকদের হৃদয়টাও জিতে নিয়েছিল তারা!
সেমিফাইনাল-২ (রাশিয়া বনাম স্পেন)
রাশিয়া-স্পেনের সেমিফাইনালটা ছিল কার্যত গ্রুপ ডি-এর প্রথম ম্যাচের ‘রিপিট টেলিকাস্ট’। অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুকে অনুষ্ঠিত ঐ ম্যাচে রাশিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুভসূচনা করে স্পেন। টুর্নামেন্টে দ্বিতীয়বারের মতো দুই দল মুখোমুখি হয় এই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে, ভিয়েনার আর্ন্সট-হ্যাপেল স্টেডিয়ামে। এই ম্যাচের ফলাফলও ছিল আগেরবারের মতোই, এবারও স্প্যানিশদের কাছে ধরাশায়ী হয় রাশানরা।
৫০তম মিনিটে জাভি হার্নান্দেজ, ৭৩তম মিনিটে দানি গুইজা আর ৮২তম মিনিটে ডেভিড সিলভার গোলে ৩-০ গোলে রাশিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে জার্মানির প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের দাঁড় করায় স্পেন।
ফাইনাল (জার্মানি বনাম স্পেন)
পুরো টুর্নামেন্টের গল্প তো বলা হলো, ফাইনালের ফলাফলটাও আপনি জানেন নিশ্চয়ই। সেই গল্পটা তাই আপাতত মুলতবি থাকুক, এখন স্পেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনের গল্পটা বলা যাক।
এই ইউরো জয়টাই কিন্তু স্পেনের জন্য প্রথমবারের মতো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ঘটনা নয়, এর আগে ১৯৬৪ সালেও একবার ইউরো জিতেছিল তারা। তবে এই ২০০৮ সালের ইউরোটা তাদের জন্য বিশেষ, কেননা বছরের পর বছরের ব্যক্তিনির্ভরতা ও এর ফলাফল হিসেবে ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করার পর স্পেন শিখেছিল একটা দল হয়ে খেলতে। কোচ লুইস আরাগোনেসের অধীনেই এই ‘বিপ্লব’টা আসবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তিনিই জাতীয় দলে এনেছেন পরিবর্তনটা। বিশেষত ক্লাব পর্যায়ে বার্সেলোনার পজেশন-ভিত্তিক, টেকনিক্যাল এবং দ্রুত পাসিংয়ের ফুটবলটাকে জাতীয় দলে অনুবাদ করার কারিগর ছিলেন তিনি। আরাগোনেসের নিজের কোচিং-দর্শনের সাথে এই ফুটবলটা পুরোপুরি যায় না, তবে তার সুদূরপ্রসারী চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল অনাগত ভবিষ্যৎ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, স্পেনের ফুটবলের সোনালী প্রজন্ম, যার একটা বড় অংশই উঠে এসেছে বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়া থেকে, তাদেরকে ঐ ঘরানার ফুটবলটাই খেলতে দেওয়া স্পেনের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
স্পেন জাতীয় দলের খেলার ধরনও সবসময়ই খেলোয়াড়দের উচ্চমাত্রার টেকনিক্যাল বিষয়গুলোকে বের করে আনে। তবে আরাগোনেস বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বড় মঞ্চে সাফল্য এনে দিতে পারবে না ‘লা ফুরিয়া রোহা’ বা ‘লাল হিংস্র দল’কে, এর সাথে চাই আবেগ, তীব্রতা, আর আক্রমণাত্মক মানসিকতা। জাতীয় দলের কোচ হওয়ার ছয় বছর আগে ১৯৯৮ সালে আরাগোনেস বলেছিলেন,
“আমরা যা করতে পারি তা হলো আমাদের নিজস্ব বৈচিত্র্যকে সম্মান করা। প্রতিটি দেশেরই ফুটবল খেলার একটা নিজস্ব উপায় রয়েছে। ‘লা ফুরিয়া রোহা’ কেবল একটি ডাকনাম না… এটি একটি দর্শন যা জাতীয় দলকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।”
– লুইস আরাগোনেস, সাবেক স্পেন কোচ
২০০৬ এর বিশ্বকাপে আরাগোনেসের যাত্রাটা ভালো চলেনি, ২০০৮ এর ইউরোর বাছাইপর্বের শুরুটাও হয়নি মনমতো। ২০০৬ এর অক্টোবরে উইন্ডসর পার্কে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সুইডেন আর রোমানিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ের পর আরাগোনেস নিশ্চিত হয়ে যান, সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না। একটা বড়সড় পরিবর্তন প্রয়োজন।
আরাগোনেস যেটা করলেন, স্পেনের খেলার ধরনে একটু একটু করে পরিবর্তন আনলেন, পরিবর্তন এলো খেলোয়াড়দের মধ্যেও। প্রবল বিতর্কের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তিতুল্য স্ট্রাইকার রাউল গঞ্জালেসকে ছাঁটাই করা হলো। ‘স্পেন: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব লা রোহা’স হিস্টোরিক ট্রেবল’-এ গ্রাহাম হান্টার রাউলের বিদায়কে তুলনা করেছেন একটা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সাথে, যে বিস্ফোরণের সাথে সাথে স্পেন দল তাদের আসল শক্তিটা বুঝতে পেরেছিল।
তবে রাউলকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা যতটা কঠিন হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। এর কারণ স্পেনের শক্তিশালী পাইপলাইন। দ্রুত-পাসিং আর পজেশন-ভিত্তিক ফুটবলে অভ্যস্ত প্রচুর ফুটবলার উঠে আসতে থাকে স্পেনে, যা আরাগোনেসের সিদ্ধান্তকে আরো সহজ করে দেয়। আর এই ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তের বলি শুধু রাউল নন, হোয়াকিন, সালগাদো, কানিজারেসের মতো খেলোয়াড়দের জন্যও জাতীয় দলের দরজা এক প্রকার বন্ধই হয়ে যায়। এক সাথে সৌভাগ্য ফেরে স্পেনের, ১৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে তারা আসে ইউরোতে। যদিও ১৬ ম্যাচের এই পরিসংখ্যানটা সরাসরি বলছে না ইউরোর আগে শেষ প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তাদের কষ্টে পাওয়া জয়ের কথা। এটা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল, স্পেনে প্রতিভার অভাব নেই, কিন্তু ‘পূর্বপুরুষদের’ ব্যর্থতার বোঝাটা তাদের জন্য একটু বেশিই ভারী যায় সময়ে সময়ে।
ইউরোর প্রথম ম্যাচে রাশিয়ার বিপক্ষে স্পেন নেমেছিল ৪-৪-২ ফরমেশন নিয়ে, বল পায়ে আক্রমণের সময়ে সেটা পরিণত হচ্ছিল ৪-২-৪-এ। এই ফরমেশনের নেতৃত্বে ছিলেন লিভারপুলের হয়ে দুর্দান্ত প্রথম মৌসুম কাটানো ফার্নান্দো তোরেস আর ডেভিড ভিয়া। ডেভিড ভিয়া পরে ঐ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলসংগ্রাহক হন, যদিও ইনজুরির জন্য ফাইনাল খেলা হয়নি তার।
যাই হোক, প্রথম ম্যাচে রাশিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ডেভিড ভিয়া, স্পেনকে এনে দিয়েছিলেন শুভসূচনা। পাশাপাশি তোরেসের সাথে তার মাঠের বাইরের বন্ধুত্বের ছাপ পড়েছিল মাঠেও। প্রথম ম্যাচে গোল না পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচেই সুইডেনের বিপক্ষে নিজের গোলের খাতা খুলেছিলেন তোরেস, ঐ ম্যাচেই শেষ মুহূর্তে গোল করে জয় এনেছিলেন ডেভিড ভিয়া।
তবে রাশিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে যেমন স্পেনকে দেখা গিয়েছিল, সুইডেনের বিপক্ষের ম্যাচে তেমন স্পেনকে দেখা যায়নি। সুইডেনের বিপক্ষে দুই অর্ধের শেষভাগে গোল পেয়েছিল স্পেন, যার অন্যতম কারণ স্পেনের পজেশন-ভিত্তিক খেলার সাথে খাপ নিতে না পেরে প্রায় পুরোটা সময়েই বলকে তাড়া করে ফিরেছিল সুইডেন। আর এর ফলাফলই ক্লান্তি, আর শেষ মুহূর্তে গোল হজম।
গ্রিসের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচেও একই ঘটনা ঘটেছিল। স্পেনের পজেশন-ভিত্তিক ফুটবলে বলের পেছনে দৌড়ালে যে নিজেরা ক্লান্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না, এটা তখনও প্রতিপক্ষরা বুঝে উঠতে পারেনি। এই কারণে প্রতিপক্ষ দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, অপরদিকে স্পেন পাচ্ছিল বাড়তি শক্তি নিয়ে অর্ধ শেষ করার সুবিধা।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের দেখা হলো পুরনো প্রতিপক্ষ ইতালির সাথে। বড় টুর্নামেন্টে স্পেনের ভালো না করার পুরনো অভ্যাস তো আছেই, সাথে আজ্জুরিদের সাথে বড় টুর্নামেন্টে হারার অভিশাপটাও নিশ্চয়ই স্পেনকে তাড়া করে ফিরছিলো। প্রতিপক্ষ বাছাইয়ের সুযোগ দিলে স্পেন হয়তো ইতালি ছাড়া অন্য যেকোন প্রতিপক্ষকেই বেছে নিতো।
তবে ধারেভারে এই টুর্নামেন্টের ইতালি ছিল পূর্বের ইতালির চেয়ে একটু কম ভয়ঙ্কর। টেনেটুনে গ্রুপ পর্ব পেরোনো দলটা, রোমানিয়ার বিপক্ষে গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন পেনাল্টি না ঠেকালে যারা হয়তো গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যেতো, মুখোমুখি হয়েছিল প্রবল প্রতাপের সাথে গ্রুপ পর্ব পেরোনো লা রোহাদের।
দুই দলের লড়াইয়ে স্পেন বরাবরের মতোই ধরে রাখলো বলের পজেশন, অপরদিকে ইতালি বলের পেছনে তাড়া না করে বেছে নিলো অপেক্ষা করা আর সুযোগ পেলেই আক্রমনে ওঠার কৌশল। স্প্যানিশ অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস একবার অসাধারণ সেভে দলকে না বাঁচালে তো পরের ধাপে ইতালিই যেত, স্পেন নয়। গোলশূন্য ড্রয়ের পর ম্যাচটা স্বাভাবিকভাবেই গড়ালো পেনাল্টি শুটআউটে। সেখানে অনুশীলনে অন্য গোলরক্ষকদের সাথে প্রতিযোগিতা করাটা কাজে দিলো ক্যাসিয়াসকে। ড্যানিয়েল ডি রসি আর আন্তোনিও ডি নাটালের শট ঠেকালেন তিনি, এরপর সেস ফ্যাব্রিগাসের গোলে সেমিফাইনালে উঠল স্পেন। এই গল্প তো আগেই বলেছি।
রাশিয়ার সাথে সেমিফাইনালের ম্যাচটা স্পেনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, পাশাপাশি দর্শকদের জন্যও এটা ছিল বহুল-আকাঙ্ক্ষিত ম্যাচ। এর আগে নেদারল্যান্ডের সাথে অসাধারণ পারফর্ম করা আন্দ্রেয়া আরশাভিনই ছিলেন স্পেনের পরিকল্পনার অনেকটা জুড়ে, তবে মাঠে তাঁকে খুব উজ্জ্বলরূপে পাওয়া যায়নি শেষ পর্যন্ত। স্পেনের কর্তৃত্বপূর্ণ ফুটবলও এটার অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই যখন ’ব্রেকথ্রু’ পেয়ে গেল স্পেন, বাকিটা সময় শুধুই হাঁসফাঁস করেছে রাশিয়া। মাঝমাঠ একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন জাভি হার্নান্দেজ, আরাগোনেসের ছাঁটাই-কার্যে যাকে বলি হতে হয়েছিল একসময়। তবে দলীয় সমন্বয় গড়ে উঠতেই জাভি দলে তার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করেছেন দারুণভাবে। খেলার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে আক্রমণের গতি নির্ধারণ, পুরো ব্যাপারটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন এই মিডফিল্ড-মায়োস্ত্রো। আর তার সাথে ব্রাজিলে জন্মানো স্প্যানিশ মিডফিল্ডার মার্কোস সেনা, এই দুইজনই আক্রমণের শুরু করতেন লা রোহাদের হয়ে।
রাশিয়ার বিপক্ষে পঞ্চাশতম মিনিটে জাভি গোল পেয়ে যাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্পেনকে, বাকিটা সময়ে শুধুই রাশিয়ার মধ্যমাঠ আর রক্ষণকে ছিঁডেখুঁড়ে ফেলার গল্প। ৩-০ ব্যবধানটা তো কমই হয়ে গেছে, আরো কয়েকটা গোল হতেই পারতো! তবে এই দারুণ দলীয় সমন্বয়, সেমিফাইনাল জয় আর ফাইনালে ওঠার মতো সুসংবাদের মধ্যে স্পেনের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল প্রথমার্ধে ডেভিড ভিয়ার চোটে পড়া। ফাইনাল থেকে ভিয়ার ছিটকে যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে বোঝা যাচ্ছিল, জার্মানির বিপক্ষে ফার্নান্দো তোরেসই হবেন স্পেনের আক্রমণের নেতা।
জার্মানি ফাইনালের শুরুটা করেছিল ভালোভাবেই, তবে ম্যাচের পনেরো মিনিট গড়াতেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় স্পেন, এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি লাল জার্সিধারীদের। ম্যাচের আধঘণ্টা পেরোতেই, মধ্যমাঠে আনমার্কড মার্কোস সেনা বল পেয়ে পাস দেন আরেক অরক্ষিত খেলোয়াড় জাভি হার্নান্দেজকে। জাভি বল পেয়েই দারুণ একটা টার্ন নেন, এবং ফিলিপ লাম ও পিটার মার্টেসেকারের মাঝ দিয়ে তোরেসের উদ্দেশ্যে দারুণ একটা পাস বাড়িয়ে দেন। তোরেস বল পেয়ে চিপ শটে পরাস্ত করেন জার্মান গোলরক্ষক জেন্স লেহম্যানকে। স্পেন ১-০ জার্মানি!
ফার্নান্দো তোরেসের এই গোলটা শুধুই একটা গোল নয়, এই গোলটা যেমন বিশ্ব ফুটবলে স্পেনের আধিপত্য শুরু করেছিল আনুষ্ঠানিকভাবে, তেমনি স্প্যানিশ-ঘরানার ফুটবলের পুরো চিত্রটাই ফুটে উঠেছিল এই গোলে। এই গোলেই ফাইনালের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় স্পেন, এরপর পজেশন-ভিত্তিক ফুটবল খেলা, আর জার্মান খেলোয়াড়দের কাছ থেকে বলকে দূরে রাখা। ফার্নান্দো তোরেস তো পরে বলেছিলেন,
“খেলার এমন একটা পরিস্থিতি এসেছিল, যখন জার্মানরা বলে একটা স্পর্শের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছিল। ওরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, এবং যেন বলতে চাচ্ছিল, ‘এটা কী হচ্ছে?’”
তারপর আর কী, শেষ বাঁশি বেজে ওঠা, লাল রঙা জার্সিধারীদের উল্লাস আর স্প্যানিশ ফুটবলের ইউরোপজয়!
একটা আদর্শ চ্যাম্পিয়ন দলের যেমনটা থাকা উচিত, সেই দ্রুতগতির পজেশন-ভিত্তিক পাসিং ফুটবল, দুর্দান্ত আক্রমণভাগ, জমাট রক্ষণ, এই সবই ছিল স্পেনের। তবে যেটা সবচেয়ে বেশি লা রোহাদের সাহায্য করেছে, সেটা হলো মনোভাব আর দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আনা। পুরনো ধাঁচের ব্যক্তিনির্ভর ফুটবল ছেড়ে দলীয় সমন্বয় গড়ে তুলেই সফল হয়েছিল স্পেন।
এরপরে ২০১০ এ বিশ্বকাপ জিতেছিল স্পেন, ২০১২ তে জিতেছে ইউরো, তবে তার কোনটাই ২০০৮ এর ইউরোর মতো ‘ভূমিধস’ বিজয় নয়। আর এটা মেনে নিতেই হবে, ২০১০, ২০১২ এর দুটো সাফল্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ২০০৮-এ, ফার্নান্দো তোরেস যেমনটা বলেছিলেন,
“এই সাফল্যই শেষ সাফল্য নয়, এটা তো কেবল শুরু!”