ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে ১১টি আসরে সর্বমোট ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলা ক্রিকেটারের সংখ্যা ১,০৫৭। বিশ্বকাপে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা খুবই গর্বের বিষয়। তবে অনেক খেলোয়াড়ই আছেন, যারা বিশ্বকাপ খেলেছেন ঠিকই, কিন্তু নিজের জন্মভূমির হয়ে নয়। নানা কারণে অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছেন ছোটবেলাতেই, অনেকে আবার প্রফেশনাল ক্রিকেটে নাম লিখানোর পরও নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য দেশে। এইবারের বিশ্বকাপও ব্যতিক্রম নয়। এইবারও বেশ কিছু ক্রিকেটার খেলবেন ভিন্ন দেশের জার্সি গায়ে। চলুন দেখে আসা যাক, সেইসব খেলোয়াড়দের বৃত্তান্ত।
ইমরান তাহির (দক্ষিণ আফ্রিকা / জন্মভূমি – পাকিস্তান)
কিছুদিন আগেই চল্লিশে পা দিয়েছেন ইমরান তাহির। তবে এই বুড়ো হাড়েও ভেলকি দেখিয়ে যাচ্ছেন এই স্পিনার। এই বয়সে এসেও দক্ষিন আফ্রিকার স্পিন বিভাগের পুরো দায়িত্ব ইমরান তাহিরের কাঁধে। আর সে দায়িত্ব যে তিনি সামলাতে পারবেন, তাতে কারো সন্দেহও থাকার কথা নয়।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ২০১১, ২০১৫ বিশ্বকাপ খেললেও আদতে একটা সময় ইমরান তাহিরের খেলার কথা ছিলো জন্মভূমি পাকিস্তানের হয়ে। সবার বড় ছেলে হওয়ায় মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে জন্মস্থান লাহোরের একটি শপিং মলে কাজ করা শুরু করেন তাহির। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় দ্রুতই, ডাক পান পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।
কিন্তু আবারও হারিয়ে যান তাহির। মাঝে কাউন্টি ক্রিকেট খেললেও তেমন কিছু করতে পারেননি। পরবর্তীতে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে ৫ বছর ঘরোয়া লিগ খেলার পর নির্বাচকদের নজরে পড়েন তাহির। ২০১১ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাঁর। আর সেই বিশ্বকাপেরই বড় চমক এবং আবিষ্কার ছিলেন ইমরান তাহির। বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অপরিহার্য এই সদস্য ঘোষণা দিয়েছেন, বিশ্বকাপ শেষেই ইতি টানবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্যারিয়ার।
ইয়োন মরগান (ইংল্যান্ড / জন্মভূমি – আয়ারল্যান্ড)
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্ম নেওয়া এই ইংল্যান্ড অধিনায়ক অবশ্য খেলেছেন আয়ারল্যান্ডের হয়েও। ২০০৭ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের অবিস্মরণীয় যাত্রার অংশ ছিলেন মরগান। ২০০৬ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের হয়ে অভিষেক ঘটে এই ব্যাটসম্যানের। নিজের প্রথম ম্যাচেই করেন ৯৯ রান। দুর্ভাগ্যবশত, রানআউটের ফাঁদে পড়ে শতক তুলে নেওয়া হয়নি তার। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড ভালো খেললেও মরগান ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে, ৬ ম্যাচে করেন মাত্র ৯১ রান। আয়ারল্যান্ডের হয়ে ২৩ ম্যাচে ৩৫ গড়ে তিনি করেন ৭৪৪ রান।
বিশ্বকাপের পর সানডে টাইমসের এক সাক্ষাৎকারে মরগান জানান, ছোটবেলা থেকেই ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন দেখে আসছেন তিনি। সেই সময় আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মধ্যে আয়ারল্যান্ড ছিল না। সেহেতু টেস্ট খেলার যোগ্যতাও ছিল না আয়ারল্যান্ডের। তাই ২০০৭ এর মে’তে ইংল্যান্ডের লর্ডস টেস্টের জন্য ১২তম খেলোয়াড় হিসেবে রাখা হয় মরগানকে।
কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ৩০ সদস্যের দলে ডাক পান মরগান। তার মানে দাঁড়ায়, আয়ারল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না তিনি। এতে মনঃক্ষুণ্ণ হন আয়ারল্যান্ড কোচ ও বোর্ড, কিন্তু মরগান বেছে নেন ইংল্যান্ডকেই। ধীরে ধীরে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে বর্তমানে মরগান ইংল্যান্ডের অধিনায়কই বনে গেছেন। বর্তমানে ইংল্যান্ডের হয়ে ওডিআই ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ ও সবচেয়ে বেশি রান, দুইটির মালিকই এই আইরিশ ব্যাটসম্যান। তার নেতৃত্বেই আসন্ন বিশ্বকাপে বড় ফেভারিটের তকমা জুটেছে ইংল্যান্ডের।
ইশ সোধি (নিউ জিল্যান্ড / জন্মভূমি – ভারত)
১৯৯২ সালে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম ইশ সোধির। ছোটবেলা জন্মস্থান ভারতে কাটলেও ১৯৯৬ সালে সোধির পুরো পরিবার পাড়ি জমায় নিউ জিল্যান্ডে। সেই সময় সোধির বয়স ছিলো মাত্র চার বছর। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা সোধি ২০১২-১৩ বছরে নিউ জিল্যান্ডের ঘরোয়া লিগে খেলতে শুরু করেন। অবশেষে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অভিষেক ঘটে সোধির। সেই সময়ে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি থাকায় নিয়মিত ছিলেন না একাদশে। তবে ভেট্টোরির বিদায়ের পর সোধিই হয়ে উঠেছেন নিউজিল্যান্ডের স্পিন বিভাগের মূল শক্তি। এই বিশ্বকাপেও মিচেল স্যান্টনারের সাথে স্পিন বিভাগ সামলানোর দায়িত্ব থাকবে সোধির কাঁধেই।
বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড / জন্মভূমি – নিউ জিল্যান্ড)
বেন স্টোকসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দুটোই নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। বাবা ছিলেন রাগবি কোচ। স্টোকসের ১২ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের একটি ক্লাবের রাগবি কোচ হওয়ার সুবাদে পরিবারে ইংল্যান্ড পাড়ি জমায় স্টোকস পরিবার। সেখানেই স্টোকসের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে নাম লেখান বেন স্টোকস। এরও পাঁচ বছর পর ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক ঘটে এই অলরাউন্ডারের।
তবে ২০১৩ সালে স্টোকসের পরিবার ফিরে যান নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইংল্যান্ডের হয়েই ক্যারিয়ার বড় করার। ধীরে ধীরে ব্যাটিং ও বোলিং দুই বিভাগেই নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়ে বর্তমানে ইংল্যান্ড দলের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছেন বেন। আসন্ন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তার উপর ভরসা করেই তাকিয়ে থাকবেন ইংল্যান্ড সমর্থকেরা।
কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম (নিউজিল্যান্ড / জন্মভূমি – জিম্বাবুয়ে)
জিম্বাবুয়ের হারারেতে জন্ম এই অলরাউন্ডার ক্রিকেটারের। জিম্বাবুয়েত ঘরোয়া লিগেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি ডি গ্র্যান্ডহোমের। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে জিম্বাবুয়ে দলের সদস্য হয়েই বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন এই ক্রিকেটার। ২০০৭ সালে ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে ওয়্যারউইকশায়ারের হয়ে দারুণ খেলেন তিনি। সেখান থেকে অকল্যান্ডের হয়ে খেলে পেয়ে যান নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব।
পরবর্তীতে কাকতালীয়ভাবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজের জন্মভূমি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ডি গ্র্যান্ডহোমের। আসন্ন বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের ঘোষণা করা দলেও রয়েছেন তিনি। বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে মূল একাদশে জায়গাও প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু এই বিশ্বকাপে খেলতেই পারছে না তার জন্মভূমি জিম্বাবুয়ে।
উসমান খাজা (অস্ট্রেলিয়া / জন্মভূমি – পাকিস্তান)
উসমান খাজার জন্ম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সেই সপরিবারে পাকিস্তান থেকে নিউ সাউথ ওয়েলসে পাড়ি জমায় খাজার পরিবার। অস্ট্রেলিয়াতেই ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হন এই ব্যাটসম্যান। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলেই নিজের প্রতিভার জানান দেন। ২০১১-১২ অ্যাশেজে এসে খাজার সামনে খুলে যায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার দোর। খাজার অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম কোনো মুসলিম খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার অভূতপূর্ব ঘটনার অবতারণা হয়।
নিজ জন্মভূমি পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতিও সেরে রেখেছেন খাজা। তার দুর্দান্ত ফর্মে হয়তো ‘বিপাকেই’ পড়তে পারে অস্ট্রেলিয়া। ওয়ার্নার ও ফিঞ্চের পাশাপাশি খাজাও ওপেনার; সেই হিসেবে কেউ একজন জায়গা হারাবেন, নতুবা নিচ থেকে এদের কাউকে জায়গা করে দিতে হবে আরেকজনকে। তবে আর যা-ই হোক, বিশ্বকাপের ১৫ সদস্যের দলে খাজার থাকাটা নিশ্চিতই।