“আমি ইউনাইটেডে থাকতে চারটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই চারটা রাত ছিল সবচেয়ে স্পেশাল।”
বলছিলেন কিংবদন্তি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। নাহ, স্রেফ নস্টালজিয়া নয়, এবার বিধ্বংসী এক সংবাদের প্রতিক্রিয়ার একটা অংশ হিসেবেই এই কথাটা বললেন তিনি। চ্যাম্পিয়নস লিগের ভবিষ্যৎটাই যে এখন শঙ্কার মুখে!
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানির সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম ‘ডার স্পিগেল’ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, যা নিয়ে পরবর্তীতে ফুটবলবিশ্বে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী এগারোটি ফুটবল ক্লাব নিজেরা এমন একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট (ইউরোপিয়ান সুপার লিগ) আয়োজন করতে চায়, যে টুর্নামেন্টের উপর মহাদেশটির ফুটবলের সবচেয়ে বড় নীতিনির্ধারণী সংস্থা উয়েফার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না – এই ধরনের বিস্ফোরক তথ্য দেয়া হয়েছিল সেই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের দাবি করা তথ্য যদি সত্য হয়, তবে মহাদেশীয় পর্যায়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো টুর্নামেন্ট থাকার পরও কেন ক্লাবগুলো নতুন টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করছে, এটি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছিল সে সময়। পরবর্তীতে বড় ক্লাবগুলোর প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে আরও কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ হলে এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের পেছনে যে অন্ধকার দিকগুলো রয়েছে, তা বেরিয়ে আসে।
২০১৮ সালে ডার স্পিগেলের প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, সেই বিতর্কের পালে আবার নতুন করে হাওয়া লেগেছে। এবার আর শঙ্কা নয়, সুপার লিগ এখন রীতিমতো প্রকাশ্য। খুব সহজেই বোঝা যায়, যদি এই টুর্নামেন্ট আদতে নিয়মিত আয়োজিত হতে শুরু করে, তবে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের দীর্ঘদিনের অবকাঠামো একেবারে ভেঙে পড়বে, ক্লাব ফুটবল আরও বেশি অর্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে, সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে মাঝারি ও ছোট ক্লাবগুলো। ফুটবলে এতদিন ধরে বড় ক্লাবগুলো সাথে ছোট ক্লাবগুলোর যে পার্থক্য ছিল, তা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
কিন্তু আলোচনা এখানেই শেষ হয় না।
ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আয়োজনের নেপথ্যে
ইউরোপের বিভিন্ন লিগের শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলো কেন এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিল, সেই বিষয়টি খোলাসা করা যাক। সহজ সত্য, এই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের কারণ পুরোপুরি অর্থনৈতিক। ক্রিকেটে ‘তিন মোড়ল’ তত্ত্বের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? এই সুপার লিগ দিয়ে ফুটবলও হয়তো অনেকটা সেই পথেই যাত্রা শুরু করল।
ইউরোপীয় পর্যায়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা জাতীয় লিগগুলোতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে বড় ক্লাবগুলো, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় হবে প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগ থেকে। গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই টুর্নামেন্টে যেহেতু শুধু বড় ক্লাবগুলো অংশগ্রহণ করতে পারবে, তাই এই টুর্নামেন্টের টিভিস্বত্ত্ব ও অন্যান্য উৎস থেকে তুলনামুলক অনেক বেশি আয় হবে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছর বেশ কিছুদিন ফুটবল বন্ধ থাকায় এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ইউরোপের সব বড় ক্লাবেরই বড় অংকের লোকসান গুণতে হয়েছে। এরপর থেকে ইউরোপিয়ান সুপার লিগের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভব করছে বড় ক্লাবগুলো, যেহেতু এই টুর্নামেন্ট তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দেবে।
রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ হতে চলেছেন সুপার লিগের সভাপতি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যুগ্ম চেয়ারম্যান জোয়েল গ্লেজার এবং ‘জুভ সুপ্রিমো’ আন্দ্রেয়া আগনেল্লি হতে যাচ্ছেন ভাইস-চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলো সাকুল্যে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ পাবে তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং কাঠামোর উন্নয়ন সামনে রেখে, কোভিড পরিস্থিতিতে হওয়া ক্ষতির পরিমাণ লাঘবেও সেটা রাখবে বড় ভূমিকা। লিভারপুল এবং ইউনাইটেড দুই দলই পাবে ৩১০ মিলিয়ন। বাকিরা পাবে ২০০ মিলিয়ন করে।
একটু আগেই বলা হলো, বিশাল অঙ্কের আয় হতে যাচ্ছে। কিন্তু কত বড় সেই অঙ্কটা? লিগে যেকোনো দল প্রতিটা ম্যাচ হারলেও তাদের পকেটে ঢুকবে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রেলিগেশনের দুশ্চিন্তা তো রইলোই না, উপরন্তু টাকার অঙ্কটাও বেশ চওড়া। আর চ্যাম্পিয়ন হলে? ২১২ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত!
কোন ক্লাবগুলো এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারবে?
ইউরোপের কোন ‘বড়’ এবং ‘ঐতিহ্যবাহী’ ক্লাবগুলো প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আয়োজনে পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে, সে তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। ডার স্পিগেলের ফাঁস হওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ‘প্রতিষ্ঠাতা সদস্য’ হিসেবে কোনো বাছাইপর্ব ছাড়াই এই প্রস্তাবিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহন করতে পারবে। প্রতিষ্ঠাতা দল ১২টির নাম: স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা, ইংল্যান্ডের আর্সেনাল, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহ্যাম হটস্পার, ইতালির জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান ও এসি মিলান।
উল্লেখ্য, জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ ও ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেই এখনও এই টুর্নামেন্টের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। অফিসিয়াল বিবৃতি অনুযায়ী, টুর্নামেন্টের প্রথম মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আরও তিনটি ক্লাব যোগ দিবে। আরও এমনকি প্রথম বিশ বছর এই ক্লাবগুলোকে যে অবনমন করা (Relegate) হবে না, সে বিষয়েও একমত হয়েছে তারা। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ যেহেতু বিশটি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে, তাই বাকি পাঁচটি দল নির্ধারিত করা হবে আগের মৌসুমের ফলাফলের উপর নির্ভর করে।
টুর্নামেন্টটির ফরম্যাট
আগামী আগস্ট মাস থেকেই এই টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশটি দলকে দুটো গ্রুপে ভাগ করে প্রতিটি গ্রুপে দশটি দল অংশগ্রহণ করবে, যেখানে প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষে থাকা তিনটি দল সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা লাভ করবে। প্রতি গ্রুপের চতুর্থ ও পঞ্চম দলটি নিজেদের মধ্যে দুই লেগের প্লে-অফ খেলবে, জয়ী দল বাকি দলগুলোর সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে অংশগ্রহণ করবে। অর্থাৎ গ্রুপপর্ব শেষে পঞ্চম স্থানে থাকলেও কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার সুযোগ থাকছে। তবে জাতীয় লিগ ও অন্যান্য জাতীয় টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, এমনটাই আভাস দেয়া হয়েছে।
টুর্নামেন্টের নীলনকশা এবং বানিজ্যিকীকরণ
মজার বিষয় হচ্ছে, ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর প্রধান কর্তাব্যক্তিদের মাথায় ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগ’-এর ধারণা ঢুকিয়েছিলেন একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী। শুধু অংশগ্রহণ করলেই বড় অংকের অর্থ সংগ্রহ করা যাবে, এই ধরনের টুর্নামেন্টের কথা অতীতে বেশ কয়েকবার উঠলেও কখনো জোর দিয়ে তা নিয়ে ভাবা হয়নি। চার্লি স্টিল্লিটানো নামের একজন ব্যক্তি, যিনি কি না ‘রিলেভেন্ট স্পোর্টস’-এর এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, প্রাথমিকভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নস কাপ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাচাই করতে চেয়েছিলেন এই ধরনের টুর্নামেন্ট আসলে তাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয় কি না। ২০১৬ সালের দিকে তিনি ইউরোপের বড় ক্লাবগুলাের কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদেরকে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আয়োজনের মাধ্যমে বিশাল অংকের অর্থ কামানোর বিষয়টি অবহিত করেন। বড় ক্লাবগুলো বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়, যেহেতু শত শত মিলিয়ন ইউরো কামানোর সুযোগ সবসময় আসে না। ইউরোপিয়ান সুপার লিগের মাধ্যমে যে অর্থ আয় করা যাবে, তা দিয়ে ট্রান্সফার মার্কেটে পছন্দের খেলোয়াড় কেনা থেকে শুরু করে করোনার মতো দুর্যোগ মোকাবেলা করা — সবই অনায়াসে সম্পন্ন করা যাবে।
ক্লাবগুলো কীভাবে বাড়তি অর্থ আয় করবে এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে?
ইউরোপিয়ান সুপার লিগের মাধ্যমে কীভাবে বাড়তি অর্থ আয় করা যাবে, সেটি বোঝার চেষ্টা করা যাক। উদাহরণ হিসেবে লিভারপুল এবং নিউক্যাসল ইউনাইটেডকেই ধরে নেওয়া যাক।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলকে নিউক্যাসলের সাথে প্রতি বছর অন্তত দুইবার করে খেলতে হয়। যেহেতু নিউক্যাসল প্রিমিয়ার লিগের খুব বড় কোনো নাম নয়, কিংবা এমন কোনো দল নয় যারা লিভারপুলের সাথে শক্তভাবে লড়তে পারবে, তাই স্বাভাবিকভাবে এই খেলা দেখতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে না। কিন্তু যদি এমন হয়, লিভারপুল বছরে অন্তত দুইবার রিয়াল মাদ্রিদের সাথে খেলছে? সেক্ষেত্রে দেখা যাবে, অন্যান্য অনেক ম্যাচের চেয়েই এই দু’টি ম্যাচের জন্য লিভারপুল বিশাল মিডিয়া কাভারেজ পাবে। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ যদি আয়োজিত হয়, তাহলে অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলো নিয়মিত বড় দলগুলোর সাথে খেলতে পারবে, নিয়মিত বিশাল মিডিয়া কাভারেজ পাবে, যা আগে কখনোই ছিল না। টিভিস্বত্ত্ব থেকে নিয়মিত বিশাল পরিমাণ অর্থ আয় করতে সক্ষম হবে ক্লাবগুলো।
প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগ থেকে কী পরিমাণ অর্থ আয় করতে সক্ষম হবে অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলো, তার একটি চিত্রও তুলে ধরা যাক।
বর্তমানে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট হলো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। যে ক্লাবটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি জিতে নেয়, তারা উয়েফার কাছ থেকে প্রায় একশ’ মিলিয়ন ইউরো লাভ করে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ-জয়ী লিভারপুল সব মিলিয়ে প্রায় ১১০ মিলিয়ন ইউরো লাভ করেছিল। সেখানে নতুন প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, যে ১২টি ক্লাব এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রধান কুশীলব হিসেবে কাজ করছে, তারা শুধু অংশগ্রহণের জন্যই বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে পাবে তার কয়েক গুণ বেশি টাকা! এছাড়া টিভিস্বত্ত্ব ও অন্যান্য স্পন্সরশিপের মাধ্যমে আরও বড় অংকের অর্থ আয় করতে পারবে বড় ক্লাবগুলো।
ছোট ও মাঝারি ক্লাবগুলোর কী হবে?
প্রতিষ্ঠাতা ১২টি ক্লাব রবিবার একটি যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“সুপার লিগ এমন একটি সময়ে গঠিত হচ্ছে যখন বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ইউরোপীয় ফুটবলের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অস্থিতিশীলতা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। নতুন এই বার্ষিক ইউরোপীয় টুর্নামেন্ট ফুটবলে দীর্ঘমেয়াদে আরও বেশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।”
তবে বাস্তবতাটা একেবারেই অন্যরকম। এই প্রস্তাবিত টুর্নামেন্ট যদি আয়োজিত হয়েই যায়, তাহলে সবচেয়ে বিপদে পড়বে ছোট ও মাঝারি ক্লাবগুলো। ফুটবলে পেট্রোডলারের বিনিয়োগ শুরু হওয়ার পর অনেক বড় ক্লাবের সাথে এখনই ছোট ক্লাবগুলো পেরে উঠছে না। ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা যেখানে শুধু রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের জন্যই পাঁচশ’ মিলিয়ন ব্যয় করার সামর্থ্য রাখেন, সেখানে ইউরোপের অনেক ক্লাবের পুরো স্কোয়াড ভ্যালু ৫০০ মিলিয়ন নয়!
প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগে শুধু অংশগ্রহণের মাধ্যমেই যেখানে বড় ক্লাবগুলো শত শত মিলিয়ন অর্থ আয় করবে, সেখানে ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণেরই সুযোগ না থাকায় প্রতি বছর তারা বিশাল অংকের অর্থ কামানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। শুধু তাই নয়, সুপার লিগ দলগুলোকে যদি শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধই করা হয়, সেক্ষেত্রে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগও পড়ে যাবে বিশাল এক অস্তিত্ব-সঙ্কটে। বর্তমানে প্রতিটি বড় ক্লাবেরই আয়ের একটি অংশ উয়েফা গ্রহণ করে, যেটি ছোট ক্লাবগুলোকে উন্নয়নের জন্য প্রদান করা হয়। শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগের মাধ্যমেই উয়েফা প্রতি বছর প্রায় দুই বিলিয়ন ইউরো প্রদান করে বিভিন্ন ক্লাবকে। প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগে যেহেতু উয়েফার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তাই স্বাভাবিকভাবেই বড় ক্লাবগুলোর বিশাল পরিমাণ আয়ের বিন্দুমাত্র অংশও ছোট ক্লাবগুলো পাবে না।
প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবের সমর্থকেরা বিতর্কের শুরু থেকেই এই সম্ভাব্য টুর্নামেন্টের বিরোধিতা করে আসছেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো দারুণ জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট থাকার পরও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে এই ধরনের প্রতিযোগিতা আয়োজনের পক্ষে যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। টুর্নামেন্ট সম্পর্কে ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করলে খালি চোখেই বোঝা যায়, ইউরোপের অভিজাত ক্লাবগুলোকে শক্তিশালী করতেই এই টুর্নামেন্ট আয়োজিত হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে ইতঃমধ্যেই ছোট ক্লাবগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে এই ধরনের টুর্নামেন্ট বড় ক্লাবগুলোকে এতটাই শক্তিশালী করবে যে ভবিষ্যতে ছোট ক্লাবগুলো ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারবে না।
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে,
GUARDIAN SPORT: Football in turmoil #TomorrowsPapersToday pic.twitter.com/ksZlrAEKgv
— Neil Henderson (@hendopolis) April 18, 2021
দ্য মেইল, এক্সপ্রেস স্পোর্টস, কিংবা মেট্রো স্পোর্টসরা তো রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণাই শুনতে পাচ্ছে,
EXPRESS SPORT: It’s War #TomorrowsPapersToday pic.twitter.com/uNLsJ4FSEt
— Neil Henderson (@hendopolis) April 18, 2021
গ্যারি নেভিল বলেছেন,
“ফুটবল প্রতিযোগিতার আধুনিকায়নের বিপক্ষে নই আমি ঠিক। আমাদের প্রিমিয়ার লিগ আছে, চ্যাম্পিয়নস লিগ আছে। কিন্তু… কোভিড পরিস্থিতির এই চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে এমন একটা প্রস্তাবনা নিয়ে আসাটা আমার কাছে স্রেফ একটা জঘন্য কেলেঙ্কারি বলেই মনে হচ্ছে।”
লিভারপুলের সাবেক মিডফিল্ডার ড্যানি মার্ফির মতে, প্রস্তাবিত সুপার লিগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে খেলোয়াড়েরা নিজেদেরকে একটু বেশিই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন,
“পরিকল্পনাটি (ইউরোপিয়ান সুপার লিগের) খুব নিষ্প্রাণ শোনাচ্ছে। ইতঃমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ বিরোধিতা লক্ষ্য করছি লিগ এবং ফেডারেশন থেকে, যারা এই টুর্নামেন্টের জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি সমর্থকরাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমি মনে করি, খেলোয়াড় ও ম্যানেজারদের ক্ষেত্রেও আমরা একই রকম দৃশ্য দেখতে পাবো।”
পোর্তো প্রেসিডেন্ট পিন্টো ডা কস্তাও সুপার লিগের বিপক্ষেই সুর ধরেছেন,
“আমরা এমন কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারি না যা নীতিবিরুদ্ধ। আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগেই আছি, আর আগামী বছরগুলোতেও সেখানেই থাকতে চাই।”
ফিফা ও উয়েফার প্রতিক্রিয়া
উয়েফাকে পাশ কাটিয়েই এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে যাচ্ছে বড় ক্লাবগুলো। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা ইউরোপা লিগের মাধ্যমে উয়েফা অংশগ্রহণকারী সব দলের মাঝেই যেভাবে অর্থ বন্টন করতে পারতো, নতুন এই টুর্নামেন্টে সে ধরনের কিছু আর থাকছে না। কারণ এখানে উয়েফার পরিবর্তে আয়োজক হিসেবে থাকছে বড় ক্লাবগুলো, আর টুর্নামেন্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। উয়েফা এই টুর্নামেন্ট সম্পর্কিত তথ্য গণমাধ্যমে আসার শুরুতেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। অফিসিয়াল বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে,
“যেসব খেলোয়াড় এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে, তাদেরকে জাতীয় দলে আর খেলতে দেয়া হবে না। আর অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোকে জাতীয়, বৈশ্বিক কিংবা মহাদেশীয় — সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা হবে।”
বৈশ্বি ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফাকেও পাশে পাচ্ছে উয়েফা। একটি বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে,
“বিভিন্ন গণমাধ্যমের উপর্যুপরি অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার ফিফা বিবৃতি দিয়েছে, এবং আবারও স্পষ্টত জানাতে চায় যে, এটি ফুটবলের সংহতি এবং ন্যায়সঙ্গত পুনঃবণ্টন মডেলের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে যা ফুটবলকে একটি বৈশ্বিক খেলা হিসেবে বিকশিত করতে পারে। আর বিশ্বব্যাপী ফুটবলের বিকাশ ঘটানোই ফিফার প্রাথমিক লক্ষ্য।
আমাদের দৃষ্টিতে এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী, জাতীয়, আঞ্চলিক অথবা বৈশ্বিক যেকোনো ফুটবল প্রতিযোগিতা র্সবদা সংহতি, অন্তর্ভুক্তি, অখণ্ডতা এবং ন্যায়সঙ্গত আর্থিক বণ্টনের মধ্য দিয়ে আয়োজিত হতে হবে। এছাড়াও প্রতিযোগিতাগুলো আর্থিক পুনঃবণ্টন এবং বিতরণের নীতিসমূহ অনুসরণ করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদিত পরিচালনা পরিষদ ক্রীড়া এবং কূটনৈতিক উপায়ে এমনভাবে নিয়োগ করা উচিত যাতে করে উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যায়। আর এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত নীতিসমূহের প্রতি সম্মান না করার কারণে ফিফার আন্তর্জাতিক কাঠামোর বাইরে অবস্থান করা একটি ‘ক্লোজড ইউরোপিয়ান ব্রেকওয়ে লিগ’কে ফিফা অস্বীকৃতি প্রদান করতে পারে।
ফিফা বরাবরই বিশ্ব ফুটবলে একতা প্রতিষ্ঠায় অবস্থান করেছে, এবং উত্তপ্ত আলোচনায় জড়িত সকল পক্ষকে ফুটবলের ভালোর জন্য সংহতি, সুষ্ঠু চেতনায় শান্ত, গঠনমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ সংলাপে জড়িত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। ফিফা অবশ্যই ফুটবলের সামগ্রিক স্বার্থে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই করবে।”
ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আসলে ফুটবল বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত পর্যায়, যেখানে বড় ক্লাবগুলো নিজেদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যেখানে তারা ছাড়া আর কেউই থাকবে না। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ যদি সত্যিই আয়োজিত হয়, তাহলে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ যে অস্তিত্ব-সংকটে পড়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। বড়-ছোট সব ক্লাবের মিশেলে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এমন একটি প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছিল, যেখানে প্রতিটি মৌসুমেই নিত্যনতুন গল্প রচিত হতো। এই মৌসুমেই বারো বছর বয়সী ক্লাব রেডবুল লাইপজিগের কাছে শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিদায়, পুঁচকে পোর্তোর কাছে রোনালদোর জুভেন্টাসের বিদায়, কিংবা ইউরোপা লিগ খেলার পথে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের সেমিফাইনালে উঠে যাওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের রোমাঞ্চিত করেছে। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আয়োজিত হলে এই ঘটনাগুলো আর কখনই দেখা যাবে না।
লিভারপুলের প্রাক্তন ম্যানেজার বিল শ্যাঙ্কলি বলেছিলেন,
“The socialism I believe in is everybody working for the same goal and everybody having a share in the rewards. That’s how I see football, that’s how I see life.”
আর আজ তার মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পর সুপার লিগের আয়োজনের ঘোষণাতে প্রাক্তন ম্যানসিটি ডিফেন্ডার মাইকা রিচার্ডস ফুটবলের মর্যাদাহানি হিসেবেই দেখতে চাচ্ছেন,
“টাকার নেশায় ওরা বাকি সব ভুলে গেছে। ফুটবলটাও এখন এমন হয়ে গেল। আমার কাছে এটা চূড়ান্ত মর্যাদাহানি বৈ কিছু নয়।”
ইউরোপিয়ান সুপার লিগ ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে যে নেতিবাচক পরিবর্তন আনবে, তা এই খেলার সৌন্দর্য্যকেই শেষ করে দিবে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার কাছে হেরে যাবে ফুটবলের শতবর্ষী মর্যাদা।