১৯৭৯ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর সাবেক আয়াক্স খেলোয়াড় ব্যারি হালশফ গ্রিসে কিছুদিন কোচিং করিয়েছিলেন। একদিন গ্রিসের এক গ্রামে হালশফ গিয়েছিলেন বেড়াতে, গিয়ে দেখেন সেখানকার এক বুড়ো লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক নয়নে। তারপর হালশফের ভাষায়, “বুড়ো লোকটি আমার হাত ধরে, তারপর হাত দুটি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।’’ তারপর বলা শুরু করে- “সে সময়ে আমার গ্রামে কোনো টিভি ছিলো না, আয়াক্সের প্রতিটি খেলা দেখার জন্য আমি দুই মাইল হেঁটে অন্য একটি গ্রামে গিয়ে খেলা দেখতাম।’’ চোখের সামনে তার নায়কদের একজনকে দেখতে পেয়ে আর আবেগ আটকে রাখতে পারেনি লোকটি।
ফুটবল ইতিহাসে আরো অনেক দল আছে যারা হয়তো এই আয়াক্স টিমের চেয়ে বেশী অথবা সমান ট্রফি জিতেছে। কিন্তু এই আয়াক্স টিমের মাহাত্ম্য অন্য জায়গায়। আয়াক্সের সেই টিম ট্রফি জেতার পাশাপাশি ফুটবলে বিপ্লব নিয়ে এসেছিলো। বর্তমানে যে তিকিতাকা অথবা প্রেসিং গেম দেখা যায় এর শুরু হয়েছিল আয়াক্সের হাত ধরেই। আয়াক্সের সেই দর্শন ফুটবলকে পরিবর্তন করে দিয়েছে চিরতরে। বর্তমানে বার্সেলোনা যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে সফলতা পেয়েছে, সেটির আঁতুড়ঘর এই আয়াক্সই। তাছাড়া আরিগো সাচ্চির সেই কিংবদন্তীতুল্য মিলানেও এই আয়াক্স টিমের প্রভাব ছিলো সুস্পষ্ট।
আয়াক্সের সাফল্য আসতে শুরু করে ইংলিশ কোচ জ্যাক আর্নল্ডের হাত ধরে। টোটাল ফুটবলের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন এই ইংলিশ ভদ্রলোকই। জ্যাক আর্নল্ড পাসিং ফুটবল পছন্দ করতেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে তখন চলছে পাওয়ার আর ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ বেসড ফুটবল। তাই তিনি একরকম বাধ্য হয়েই পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডে। আয়াক্সকে তিন কিস্তিতে মোট ২৭ বছর কোচিং করিয়েছিলেন তিনি। এই ২৭ বছরে আয়াক্স জিতেছিলো ৮টি লীগ আর একটি KNVB কাপ। এগুলোর কোনোটিই এর আগে আয়াক্স জেতেনি। আর্নল্ড দায়িত্ব ছাড়ার পরে ভিক বাকিংহাম আয়াক্সের সাফল্য অব্যাহত রাখেন। জ্যাক আর্নল্ড আয়াক্স ছেড়ে পাড়ি জমান স্বদেশ ইংল্যান্ডে। সেখানে শেফিল্ড ওয়েডনেসডেকে দুই বছর কোচিং করানোর পর ১৯৬৪ সালে আবার ফিরে আসেন এফসি আয়াক্সে। কিন্তু এবার ভাগ্য আর আগের মত সুপ্রসন্ন ছিলো না। নতুন বছরের শুরুতেই আয়াক্সের অবস্থান পয়েন্ট টেবিলের একদম তলায় রেলিগেশান জোনে গিয়ে ঠেকে। টিমকে রেলিগেশান জোনে নিয়ে যাওয়ায় বরখাস্ত হন তৎকালীন আয়াক্সের সফলতম কোচ।
তারপর দায়িত্ব দেয়া হয় আয়াক্সেরই সাবেক খেলোয়াড় রাইনাস মিশেলকে। প্লেয়ার হিসেবে মিশেলের তেমন বড় কোনো নামডাক ছিল না। আয়াক্সের দায়িত্ব নেয়ার পরপর জ্যাক আর্নল্ডের মতোই মিশেল জোর দেন নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর। সঙ্গে খেলোয়াড়দেরকে কঠিন পরিশ্রম করার নির্দেশ দেন যাতে তারা মিশেলের চাহিদা মতো একাগ্রতা এবং আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আসতে পারে খেলায়। দায়িত্ব নেয়ার পর মিশেলের প্রাথমিক কাজ ছিলো আয়াক্সকে রেলিগেশান থেকে বাঁচানো। এসেই মিশেল টিমের ফর্মেশন আর্নল্ডের W-M থেকে নিয়ে আসেন ৪-২-৪ এ। পরের সিজনেই লিগ জিতে নেয় আয়াক্স। মিশেলের অধীনে টানা ৪ সিজন এই ধারা অব্যাহত থাকে। ইউরোপের গন্ডীতে তখনো আয়াক্সের তেমন নাম ডাক ছড়ায়নি। ১৯৬৯ সালে ইউরোপিয়ান কাপের সেমিফাইনালে বিল শ্যাংকলির লিভারপুলকে ৫-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে যায় আয়াক্স। ফাইনালে এসি মিলানের কাছে হেরে গেলেও তখন তারা পরিচিত পায় তাদের অ্যাটাকিং ব্র্যান্ডেড ফুটবলের জন্য, ইউরোপে নাম ছড়িয়ে পড়ে আয়াক্সের।
ভেলিবর ভাসোভিককে পারটিজান বেলগ্রেড থেকে সাইনিংয়ের মাধ্যমে ইউরোপ শাসনের দিকে একধাপ এগিয়ে যায় আয়াক্স। টিমকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য মিশেল ছিলেন বদ্ধপরিকর। এতটাই বদ্ধপরিকর যে, ১৯৬৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপে ডুকলা প্রাগের বিপক্ষে আত্মঘাতী গোল করার জন্য তখনকার আয়াক্স ক্যাপ্টেনকেই বেচে দেয় নেদারল্যান্ডের আরেক ক্লাব পিএসভির কাছে। তার জায়গাতেই দলে আসেন ভাসোভিক। মিশেল তখন আয়াক্সকে খেলাচ্ছেন টোটাল ফুটবল। তার সিস্টেম ছিলো একদম কিপার থেকে বিল্ড আপ করা। এজন্য ডিফেন্ডারদেরকে ডিফেন্সের পাশাপাশি পাসিং এবং সামনে এগোনোর দক্ষতাও থাকতে হবে। ঠিক এখানেই বাজিমাত করেন যুগোস্লোভিয়ার এই কম বয়সী ডিফেন্ডার ভাসোভিক। পরবর্তীতে সাক্ষাতকারে ভাসোভিক বলেন,
“আমি যখন এসেছিলাম, টোটাল ফুটবল আমার খুবই পছন্দ ছিলো। আমি চাইতাম পেছনে থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে। আর ঠিক সেই সুযোগটাই আমাকে করে দিয়েছিলো মিশেল। আমাকে দেয়া হয় লিবেরো রোল। আমি ছিলাম ডিফেন্সে লাস্ট ম্যান, দ্য আর্কিটেক্ট।’’
হাশলফের সাথে জুটি গড়ে ভাসোভিক গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য ডিফেন্সিভ ওয়াল। আয়াক্স ঘরোয়া লীগে সাফল্য পেলেও ইউরোপিয়ান লেভেলে সাফল্য পাওয়ার মতো মান আয়াক্সের ছিলো না। মিশেল একে একে বিদায় করেন গ্রেট বালস, টনি প্রঙ্ক, ক্লাস নুনিংগা, থিও ভান এবং নিয়ে আসেন হাশলফ, ভাসোভিক, রুড ক্রুল ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার মিডফিল্ড জেনারেল জোহান নেসকেন্সকে।
৪-২-৪ ফর্মেশনে মিডফিল্ডে আউটপ্লেইড হওয়ার সমস্যার সমাধান করার জন্য মিশেল টিমের ফর্মেশন পরিবর্তন করে নিয়ে আসেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। মিডফিল্ডে ৩ জনকে নামানোর ফলে খেলা কন্ট্রোলে আসে আর উইংগারদের অথবা স্ট্রাইকারদের একজন নিচে নেমে আসায় আয়াক্স মিডফিল্ডে বাড়তি আরেকজন প্লেয়ার পেতো। ফলে মিডফিল্ডে আধিপত্য বিস্তার করতো সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
মিশেল আয়াক্সকে খেলান এক নতুন সিস্টেমে। এই সিস্টেমে সব প্লেয়ারই অ্যাটাকার আবার ডিফেন্ডার। আয়াক্স এক অ্যাগ্রেসিভ ফ্লুইড সিস্টেম ফলো করতো। এই সিস্টেমে উইংগাররা কভার দিতো ফুলব্যাকদের, উইংগাররা আবার মিডলে ড্রিফট করে স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলতো। প্রেসিং বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় হলেও তখনকার দিনে প্রেসিং সেভাবে প্রচলিত ছিলো না। আয়াক্স সেটিকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য উচ্চতায়। প্রতিপক্ষ বল নেয়ার সাথে সাথে আয়াক্সের প্লেয়াররা মৌমাছির মতো ঘিরে ধরতো আর বল কেড়ে নিতো অনায়াসেই। ফলে আয়াক্সের বিপক্ষে খেলা হয়ে উঠেছিলো এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মিশেলের দর্শন ছিলো পাস এবং কুইক মুভমেন্ট। আয়াক্সের প্রত্যেক প্লেয়ারই ছিলেন খুব ভালো মানের পাসার, এমনকি কিপারও। গোলকিপারকে দলে নেয়া হয়েছিলো হাত দিয়ে ভাল সেভ করার জন্য নয়, বরং পা দিয়ে ভালো পাস দেয়ার জন্য! তখনকার আয়াক্স ছিলো যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
আয়াক্স টিমের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। ক্রুইফকে বলা হয় পার্ট টাইম ফুটবলার আর ফুল টাইম আর্টিস্ট। আয়াক্সের খেলা দেখতে এসে আর্টিস্ট, রাইটার, বিখ্যাত বেলেরিনা রুডলফ নুরেভ একবার মন্তব্য করেছিলো, “ক্রুইফের ড্যান্সার হওয়া উচিত ছিলো।” ক্রুইফ ছিলেন স্কিলফুল ড্রিফটিং সেন্টার ফরোয়ার্ড, জোহান নেসকেন্স ছিলেন মিডফিল্ডের এক শক্ত সমর্থ্য জেনারেল, আরি হান ও জেরি মুহরেনের ছিলো ট্যাক্টিকাল ডিসিপ্লিন, আর এদের পিছনে ছিলেন যুগোস্লোভিয়ান স্টিল ভাসিভোক। এই নিয়ে ছিলো আয়াক্সের টোটাল ফুটবল।
১৯৭১ সালে আয়াক্স তাদের ইতিহাসের প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমানে যেটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ নামে পরিচিত) জেতার পরে মিশেল পাড়ি জমান বার্সেলোনাতে। যাওয়ার আগে তিনি বলে যান, “আয়াক্সের হয়ে আমার যতকিছু জেতা সম্ভব আমি জিতেছি, এর চেয়ে জেতার বেশি কিছু এখানে বাকি নেই।’’
মিশেল যে ভুল ছিলেন, তা প্রমাণ হয়ে যায় কিছুদিন পরেই। মিশেলের স্থলাভিষিক্ত হন স্টেফান কোভাক। কোভাকের প্লেয়িং স্টাইল মিশেলের চেয়ে কিছুটা কম অ্যাগ্রেসিভ ছিলো। এতে অবশ্য প্লেয়াররা একটু বিরতি পান মিশেলের হার্ড ওয়ার্কিং সিস্টেম থেকে। প্রথম সিজনেই ইন্টার মিলানকে হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপসহ ঐতিহাসিক ট্রেবল জিতে নেয় আয়াক্স। ট্রেবল জেতার পরও কোভাককে বরখাস্ত করার চিন্তাভাবনা করে আয়াক্স ম্যানেজমেন্ট। তাদের ভাষ্যমতে কোভাক প্লেয়ারদেরকে অনেক বেশী স্বাধীনতা দিতেন, তার সিস্টেম ছিলো সফ্ট। কিন্তু প্লেয়ারদের প্রতিবাদের মুখে আয়াক্স ম্যানেজেমেন্ট তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। প্লেয়ারদের আস্থার প্রতিদান পরের সিজনেই ফিরিয়ে দেন কোভাক। টানা তৃতীয়বারের মতো ইউরোপিয়ান কাপ জিতে নেয় এফসি আয়াক্স।
কোভাকের প্রতি অনেকের অভিযোগ ছিলো তিনি প্লেয়ারদেরকে অনেক বেশী স্বাধীনতা দেন। ইউরোপিয়ান কাপ জেতার পরে কোভাক নিজেই এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আয়াক্স ছেড়ে ফ্রান্সের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কোভাকের জায়গা নিতে আসেন জর্জ নোবেল। নোবেল এসেই প্লেয়ারদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন দলের ক্যাপ্টেন নির্বাচন করার। যদিও ক্রুইফ ছিলেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা এবং আয়াক্সের ইঞ্জিন, কিন্তু বয়স একটু বেড়ে যাওয়ায় টিমে তার প্রভাব একটু কমে এসেছিলো। ফলে টিমমেটরা তার বদলে পিট কাইজারকে ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচিত করে। ক্যাপ্টেন্সি হারিয়ে ক্ষোভে গুরু মিশেলের পথ ধরে ক্রুইফও পাড়ি জমান বার্সেলোনাতে। খারাপ ফলাফলের দরুণ পরের সিজনেই বরখাস্ত হন নোবেল, যাওয়ার আগে প্লেয়ারদের নারীপ্রীতি এবং অ্যালকোহলকেই দায়ী করেন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায় আয়াক্স তথা বিশ্ব ফুটবলের জাদুকরী এক অধ্যায়ের।
আয়াক্সের এই টিম হচ্ছে সংগীতের বিটলস, সিনেমার জেমস বন্ড এবং কিশোর বালকের দেয়ালে সেটে থাকা সেই হিরোর ছবি, যারা বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে আয়াক্সকে ফুটনোট থেকে একটি আস্ত চ্যাপ্টার বানিয়ে দেখিয়েছে। আয়াক্সের সেই সাফল্য এখন না থাকলেও তাদের উদ্ভাবন এখনো টিকে আছে বর্তমান ফুটবল বিশ্বে।