এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করার পর আসলে বেশ চাপেই পড়ে গিয়েছিল ব্রাজিল। কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচে জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ সেলেসাওদের কাছে ছিল না, কারণ এ ম্যাচে পয়েন্ট হারালে সার্বিয়ার সাথে ম্যাচটা হয়ে যেত ডু অর ডাই ম্যাচ। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আগের একাদশ নিয়েই খেলতে নামে ব্রাজিল। তবে আগের ম্যাচে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেললেও, তারা এ ম্যাচে ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই বেশিরভাগ সময়ে খেলেছে। অন্যদিকে কোস্টারিকা ৫-৪-১ ফর্মেশনে খেললেও প্রকৃতপক্ষে এক ব্রায়ান রুইজ ছাড়া বাকি সবাইকেই অধিকাংশ সময়ে রক্ষণভাগ সামলানোর কাজেই দেখা গিয়েছে।
শুরু থেকেই খেলার লাগাম নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় সেলেসাওরা, ছোট ছোট পাসে আক্রমণগুলো সাজাচ্ছিল ব্রাজিল। কিন্তু কোস্টারিকার জমাট রক্ষণ কিছুতেই ভাঙ্গতে পারছিল না ব্রাজিল। উল্টো খেলার ১৩ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারতো কোস্টারিকা। রাইট উইং থেকে গাম্বোয়ার বাড়িয়ে দেওয়া পাসে গোল করার ভালো সুযোগ পেয়েছিলেন সেলসো বোরজেস। কিন্তু বোরজেসের শট গোলবারের বাইরে দিয়ে চলে গেলে কোস্টারিকার আর এগিয়ে যাওয়া হয়নি। এরপর পুরো সময়ে দাপট দেখিয়ে গিয়েছে ব্রাজিল, ২৬ মিনিটে গোলও পেয়ে গিয়েছিল সেলেসাওরা। কিন্তু মার্সেলোর পাস থেকে গ্যাব্রিয়েল জেসুসের করা গোলটি অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে যায়। এর পরের মিনিটেই কৌতিনহোর অসাধারণ পাস থেকে কোস্টারিকার গোলরক্ষক কেইলর নাভাসকে একা পেয়ে গিয়েছিলেন নেইমার, কিন্তু নেইমার ঠিকমতো বলের দখল নিতে না পারায় সে যাত্রায় কোস্টারিকাকে বাঁচিয়ে দেন নাভাস।
এরপর কোস্টারিকার রক্ষণ ভাঙ্গতে না পেরে দূরপাল্লার শট নিয়ে গোল আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছিল ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু কৌতিনহো, মার্সেলোদের সেসব দুর্বল শট কোস্টারিকার রক্ষণে তেমন ত্রাস ছড়াতে পারেনি। প্রথমার্ধে ব্রাজিলের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলা উইলিয়ানের জঘন্য পারফর্মেন্স। এ কারণে ব্রাজিলের রাইট উইং পুরো প্রথমার্ধ জুড়েই ছিল ভীষণ নিষ্প্রভ। সবমিলিয়ে প্রথমার্ধ শেষ হয় ০-০ স্কোরলাইনে।
নিজের দলের এই বেহাল দশা দেখে তিতে নড়েচড়ে বসেন। তিতে সাধারণত দ্বিতীয়ার্ধের ৬০ মিনিটের আগে খেলোয়াড় পরিবর্তন করেন না। কিন্তু এ ম্যাচে তিতে সে কাজটাই করেন। জঘন্য খেলতে থাকা উইলিয়ানকে দ্বিতীয়ার্ধে আর নামাননি তিতে। তার বদলে জুভেন্টাসের উইঙ্গার ডগলাস কস্তাকে মাঠে নামান তিনি। এই একটি সিদ্ধান্ত পুরো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, রাইট উইং দিয়ে কস্তা একাই ত্রাস ছড়াতে শুরু করেন। কস্তার অসাধারণ ক্রসে হেড করে ব্রাজিলকে গোল প্রায় এনেই দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। কিন্তু তার হেডার বারে লেগে ফিরে আসে। এর পরের মিনিটেই মাত্র ১৫ গজ দূরে ফাঁকায় বল পান কৌতিনহো, কিন্তু তার নেওয়া শট কোস্টারিকার এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে মাঠের বাইরে চলে যায়। গোল না পেলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এই আক্রমণের ধারা ব্রাজিলকে বেশ আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
৫৭ মিনিটে রাইট উইং থেকে নেইমারকে অসাধারণ এক পাস বাড়িয়ে দেন পাউলিনহো। কিন্তু নেইমারের নেওয়া শট বাজপাখির মতো উড়ে গিয়ে ফিরিয়ে দেন কেইলর নাভাস। এর দুই মিনিট পর আরেকটা সহজ সুযোগ পান নেইমার, কিন্তু সে যাত্রায় নেইমারের নেওয়া শট গোলবার ঘেঁষে চলে যায়। এভাবে মিসের মহড়া দেওয়ার কারণে টানা আক্রমণ চালিয়েও কিছুতেই গোলের দেখা পাচ্ছিল না ব্রাজিল। খেলার ৬৮ মিনিটে সবচেয়ে বড় জুয়াটা খেলেন তিতে। দুর্দান্ত খেলতে থাকা পাউলিনহোকে তুলে নিয়ে রবার্তো ফিরমিনোকে মাঠে নামান তিতে। একজন বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের বদলে একজন স্ট্রাইকারকে নামালে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ কিছুটা দুর্বল হবে এটা জেনেও ডেডলক ভাঙ্গার জন্য এই ঝুঁকিটা নেন তিতে।
তিতের এই সিদ্ধান্ত বেশ ভালোমতোই কাজে লাগে। ফিরমিনো মাঠে নামায় দলের আক্রমণে আরো গতি আসে। ম্যাচের ৭৮ মিনিটের সময়ে খেলার সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি আসে। কস্তার অসাধারণ থ্রু পাসে জেসুসের বুদ্ধিদীপ্ত ফ্লিকে ডিবক্সে সুবিধাজনক অবস্থায় বল পান নেইমার। কিন্তু কোস্টারিকার গঞ্জালেসের কাছ থেকে বাঁধা পেয়ে ডিবক্সে পড়ে যান নেইমার। রেফারি সাথে সাথে পেনাল্টির বাঁশি বাজান। মূল নাটক শুরু হয় এরপরেই, ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি জানান যে- গঞ্জালেস নেইমারকে যে ধাক্কাটা দিয়েছিলেন সেটা তার পড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। নেইমার পেনাল্টি পাওয়ার জন্যেই ইচ্ছা করে পড়ে গিয়েছিলেন। অথচ তখন পেনাল্টির আশায় পড়ে না গিয়ে নেইমার চাইলেই গোলমুখে শট নিতে পারতেন। রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন।
পেনাল্টির সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়ার ক্ষোভে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন নেইমার। ৮১ মিনিটে বাজে আচরণের জন্য হলুদ কার্ড দেখেন ব্রাজিলের নাম্বার টেন। সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফিলিপে কৌতিনহোও হলুদ কার্ড দেখেন। ম্যাচের অবস্থা পুরোপুরি জট পাকিয়ে যায়, কোস্টারিকার খেলোয়াড়েরা অহেতুক সময় নষ্ট করতে শুরু করায় দুদলই বারবার বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিল। খেলার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল এসব হট্টগোলের মাঝে হতাশার এক ড্র এর মাধ্যমে ব্রাজিল এই ম্যাচ শেষ করবে।
কিন্তু সেটি হয়নি। ইনজুরি সময়ের প্রথম মিনিটে মার্সেলোর ক্রস থেকে হেড করে জেসুসের দিকে বল বাড়িয়ে দেন ফিরমিনো। ফিরমিনোর পাস জেসুস রিসিভ করে কিছুটা সামনে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাতে ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে তিনি শটটা নিতে পারেন। সবাই ভেবেছিল জেসুসই শট নিবেন, কিন্তু ডিবক্সের বাইরে থেকে দৌড়ে এসে আনমার্কড কৌতিনহো আচমকা গোলমুখে শট নেন। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা নাভাস এই শটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তার পায়ের ফাঁকা দিয়ে গোল করে অবশেষে ডেডলক ভাঙ্গেন ফিলিপ কৌতিনহো। গোলের পর স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের ভক্তরা উল্লাসে ফেটে পড়েন।
গোল খাওয়ার পর কোস্টারিকা গোল শোধ দেওয়ার জন্যে আক্রমণে গিয়েছে, কিন্তু তেমন সুবিধা তারা করতে পারেনি। বরং পাল্টা আক্রমণে ইনজুরি সময়ের সপ্তম মিনিটে ডগলাস কস্তার পাস থেকে গোল করে ব্রাজিলের জয় নিশ্চিত করেন নেইমার। ৯০ মিনিট গোলের জন্য মাথা খুঁটে মরা ব্রাজিল ইনজুরি সময়ে পেয়ে যায় দুই গোল! কোস্টারিকার বিপক্ষে এই জয়ের ফলে ব্রাজিলের দ্বিতীয় রাউন্ডের পথটা অনেকটাই মসৃণ হয়ে গেলো। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র এর পর কোস্টারিকার বিপক্ষে এই ২-০ গোলের জয় ব্রাজিল শিবিরে স্বস্তির এক হাওয়া হয়েই এসেছে।
ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের পারফর্মেন্স নিয়ে বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয় গোলরক্ষক অ্যালিসনের কথা। পুরো ম্যাচে একটি সেভও অ্যালিসনকে করতে হয়নি! তবে নিজের সুইপিং দক্ষতা দিয়ে দলকে এ ম্যাচে সাহায্য করে গিয়েছেন তিনি। ব্রাজিল হাইলাইন ডিফেন্সে খেলায় বেশ কয়েকবার কোস্টারিকা লব থ্রু বাড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু অ্যালিসন তা এগিয়ে এসে প্রতিহত করেছেন। তাছাড়া ম্যাচে শতভাগ সফল পাসিং রেটের কারণে আলাদা করে প্রশংসা পেতেই পারেন তিনি। দুই সেন্টারব্যাক মিরান্ডা ও থিয়াগো সিলভা নিজেদের দায়িত্বে অটল ছিলেন, কোস্টারিকার পাল্টা আক্রমণ এই দুজনের কারণে ধোপে টেকেনি। লেফটব্যাকে মার্সেলো নিজের সেরাটা দিয়েছেন। প্রথম গোলে তার নিখুঁত ক্রসের বড় একটি ভূমিকা ছিল। রাইটব্যাক ফ্যাগনার প্রথমার্ধে বেশ অগোছালো ছিলেন, তবে দ্বিতীয়ার্ধে উইলিয়ানের বদলে কস্তা নামার পর ফ্যাগনারের খেলাতেও বেশ পরিবর্তন আসে।
হোল্ডিং মিডফিল্ডে ক্যাসেমিরো নিজের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। তবে এ ম্যাচে দলের আক্রমণে তিনি আরেকটু সাহায্য করতে পারতেন। গত ম্যাচের তুলনায় এ ম্যাচে বেশ ভালো খেলেছেন পাউলিনহো, দুটি গোলের সুযোগ তার পাস থেকেই তৈরি হয়েছিল। আগের ম্যাচে দূরপাল্লার শটে গোল করা কৌতিনহো এ ম্যাচেও বেশ কিছু দূরপাল্লার শট নিয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। তবে দলের প্রয়োজনীয় সময়ে গোল করে ম্যাচসেরার পুরস্কারটি কৌতিনহোই জিতে নিয়েছেন। যদি খারাপ খেলার কথা বলতেই হয় তাহলে বলতে হবে উইলিয়ানের কথা। প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবার স্পেস পাওয়া সত্ত্বেও জঘন্য সব ক্রস করেছেন উইলিয়ান। এছাড়া বেশ কয়েকবার দৃষ্টিকটুভাবে বল হারিয়েছিলেন তিনি। এ কারণেই তিতে তার উপর বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কস্তাকে নামান।
বিশ্বকাপে নিজের অভিষেক ম্যাচেই জাত চিনিয়েছেন কস্তা। রাইট উইং দিয়ে একাই ঝড় তুলেছেন। এ ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ছিল তার মাঠে নামাটা। নেইমারের গোলের অ্যাসিস্টটাও কস্তার কাছ থেকেই এসেছে। হতাশ করেছেন নেইমার, গোল করার বেশ কিছু সহজ সুযোগ নষ্ট করেছেন তিনি। ব্রাজিলের জন্য স্বস্তির ব্যাপার নেইমারের গোল পাওয়া, এই গোল থেকে আত্মবিশ্বাস পেয়ে নেইমার তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারবেন- এটাই সেলেসাও ভক্তদের প্রত্যাশা।
গত ম্যাচের তুলনায় এ ম্যাচে বেশ উজ্জ্বল ছিলেন জেসুস। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে নিচে নেমে দলকে সাহায্যও করেছেন। কৌতিনহোর করা গোলে জেসুসের বল রিসিভ করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে টানা দুই ম্যাচ গোল না পাওয়ায় পরের ম্যাচে গোল করার জন্য জেসুস যে মুখিয়ে থাকবেন তা বলাই বাহুল্য। আর সবশেষে বলতে হয় রবার্তো ফিরমিনোর কথা। জেসুসের বদলি হিসেবে তাকে খেলানো হবে এমনটাই পরিকল্পনা থাকলেও ফিরমিনোকে নামানো হয় পাউলিনহোর বদলে। তবে অপ্রত্যাশিত পজিশনে খেলতে নেমেও নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে গিয়েছেন ফিরমিনো। কৌতিনহোর গোলে ফিরমিনোর হেডটা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। কোস্টারিকার বিপক্ষে ২-০ গোলের এই জয় সেলেসাওদের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে, এই আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে পরের ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল জিততে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ফিচার ইমেজ : Evening Standard