গর্ডন গ্রিনিজের উত্তরসূরী কে হবেন?
ঢাকার বিসিবি অফিসে কানাঘুষা চলছে বাংলাদেশের কোচ নিয়ে। আগস্টে নিয়োগ দেয়া হবে। হিসেব-নিকেষ করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পরবর্তী কোচ হতে চলেছেন অস্ট্রেলিয়া অথবা সাউথ আফ্রিকা থেকে।
সিলেকশন করা কোচদের লিস্টে অনেকের নামই আছে, কিন্তু সবার উপরে আছেন সাউথ আফ্রিকান অলরাউন্ডার এডি বারলো। এর মাঝে তৎকালীন বিসিবি প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী দৈনিক ভোরের কাগজকে একটি বিবৃতি দেন,
‘হ্যাঁ, এটি সত্যি যে, তিনি (এডি বারলো) আসছেন। আমাদের মাঝে কথা চলছে। কিন্তু এটি এইটা বুঝায় না যে, তাকেই একমাত্র হিসেবে বিবেচনা করছি আমরা।’
তিনি আরো জানান,
‘আমাদের তালিকায় আরো অনেকেই আছেন, তাদের সাথে কথা বলার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিব।’
আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলী বাখারের সাথে বিসিবি প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেনের আলোচনার পর বাংলাদেশে আসেন এডি বারলো, এবং নিয়োগপ্রাপ্ত হন গর্ডন গ্রিনিজের উত্তরসূরী হিসেবে। এবং প্রথম এসাইনমেন্ট হিসেবে পান ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজ।
১৯৪০ সাল, আগস্ট ১২। প্রিটোরিয়া, ট্রান্সভিল, সাউথ আফ্রিকায় জন্ম নেন আফ্রিকার অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার এডগার জন বারলো, সংক্ষেপে এডি বারলো। পরিচিত ছিলেন ‘বান্টার’ হিসেবে। এখানে জেনে রাখা ভালো, নিউল্যান্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের এক প্রান্তের নাম ছিল ‘বান্টার এন্ড’, কিন্তু প্রতিপক্ষ ক্লাব দলগুলোর আপত্তি থাকার কারণে তা পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো একদিনের ম্যাচ না খেললেও খেলেছেন ৩০ টেস্ট। ৪৫.৭৪ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২,৫১৬ রান, সাথে পকেটে পুরেছেন ১৫টি অর্ধশতকের সাথে ৬টি শতক। সর্বোচ্চ ২০১ রান। আর দুই প্রান্তে নিজের অসাধারণ বোলিংয়ে তুলে নিয়েছেন বিপক্ষদলের ৪০ উইকেট। বেস্ট ৫/৮৫। এডি বারলো ১৯৬৩-৬৪ সালে প্রথম আফ্রিকান ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই সিরিজে একটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ সাকুল্যে ৬০৩ রান করেন।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৮৩ ম্যাচে ১৮,২১২ রান করেন, গড় ৩৯.১৬। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওনার শতক আছে ৪৩টি, আর অর্ধশতক এর ঠিক দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৮৬টি। আর বোলিংয়ে ৫৭১ উইকেট, যার মাঝে ১৬ বার আছে ৫ উইকেটের দেখা, আর ২ বার ১০ উইকেট।
২০০০ সালে এডির আকস্মিক স্ট্রোকের সাথে শরীরের একপাশ অচল হয়ে যাওয়া, আর এরপর জায়গা হলো হুইল চেয়ারে। কিন্তু না, হুইল চেয়ারে বসেও থেমে থাকেননি তিনি। ‘৯৯ এর নিয়োগের পর থেকে ২০০০ সাল অবধি কাজ করে গিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কাছে তিনি ছিলেন শুধু একজন কোচই না, কারো কাছে বন্ধু, বা কারো কাছে বাবার সমতুল্য। আর আমাদের জাতীয় দলে থাকার সময় তার পাশে সবসময় ছিল তার স্ত্রী কলি বারলো৷
ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাট হলো টেস্ট। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, উইন্ডিজদের টেস্ট খেলা দেখার সময় টিভি সেটের সামনে থেকে উঠতে মন চায় না। ২৬ জুন, ২০০০ বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম দিন। কারণ, এইদিন আমরা পেয়েছি সেই রাজকীয় ফরম্যাটের স্ট্যাটাস। অনেকেই বলবেন, এই স্ট্যাটাস লাভের পেছনে সাবের হোসেন চৌধুরীর অবদান রয়েছে। কিন্তু পর্দার অন্তরালে রয়েছেন সেই প্রিয় এডি বারলো, যার পরামর্শে আমরা পেয়েছিলাম কাঙ্ক্ষিত টেস্ট স্ট্যাটাস৷
আচ্ছা, এডি বারলোর কোন ছবিটা আপনার চোখে সবসময় ভাসে? নিঃসন্দেহে ২০০৫ সালে ডার্বিশায়ারে তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচের দিন এডির সেই কান্নার ছবিটা। চার বছর আগে হুইল চেয়ারে বন্দী বারলো সংবাদ সম্মেলনে প্রথমবার বাংলাদেশের জন্য কেঁদেছিলেন, চার বছর পর আবারও কাঁদলেন। বাংলাদেশে আসবেন তিনি, প্রচুর ইচ্ছে ছিল দেশে ফিরার। এডি বারলোর কাছে বাংলাদেশ একটি ভালবাসা, একটি আবেগের নাম, যা কখনোই তার পেশাদারিত্বকে ছুঁতে পারেনি। তাই তো নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে বাংলাদেশের খেলা দেখার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ডার্বি থেকে লর্ডস। কিন্তু আসতে পারেননি এই ভালবাসার দেশে।
২০০৫ এর ডিসেম্বর তিনি চলে গেলেন পরপারে। এক এক করে পেনি সঞ্চয় করেও একবারের জন্যও আসতে পারলেন না ভালবাসার দেশে।
মাত্র দুই বছরের বাংলাদেশের কোচিং ক্যারিয়ারেই আপন করে নিয়েছেন দেশকে, দেশের মানুষদের। দেশের মানুষরাও যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, সেটা কখনও ভোলার নয়। দেশের ক্রিকেটে এই মানুষের নাম থাকবে সবসময়, সবার মনে।
ভাল থাকবেন, এডি বারলো।