এই মণিহার আমার নাহি সাজে…

ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন দুর্দান্ত। ভারতের বিপক্ষে ১৩১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলে অভিষেকেই জাত চিনিয়েছিলেন, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন তাকে বলা হচ্ছে ‘দ্য নেক্সট বিগ থিং’। সে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাটিং করতে না হলেও পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আবার বাস্তবের সপাট কষাঘাতে মাটিতে নেমে এসেছিলেন, আউট হওয়ার আগে করতে পেরেছিলেন মোটে চার রান। এরপরও একটা লম্বা সময় ধরে ছিলেন প্রচণ্ড অধারাবাহিক। এতটাই যে প্রথম টেস্ট শেষে যেখানে তার গড় ছিল ১৩১, একাদশ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সেটা নেমে এসেছিল ২৭.৯৪ অবধি! 

এরপরই বুঝি ঘুম ভাঙল তার। প্রথম এক হাজার রান করতে যেখানে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৮ টেস্ট অবধি, পরের এক হাজার করলেন ১৪ টেস্টেই। এরপর হয়ে উঠলেন আরো দুর্বার, তিন হাজারের মাইলফলক ছুঁলেন মাত্র সাত টেস্টেই! দিন যত গেছে, রানের সাথে সাথে গড়টাও হয়েছে আরো হৃষ্টপুষ্ট, মস্তিষ্কও হয়েছে আরো ক্ষুরধার। মুখভরা নাম ‘ফ্যান্টাস্টিক ফাইভ’ ক্লাবের একজন হয়ে উঠেছেন, সেয়ানে সেয়ানে পাল্লা দিচ্ছেন স্টিভ স্মিথ-বিরাট কোহলি-জো রুটদের সাথে। 

এই যাহ, নামটা বলা হয়নি। কেইন উইলিয়ামসন, নিউ জিল্যান্ডের ‘ওয়ান্ডারকিড’ থেকে যাত্রা শুরু করে যিনি হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ইমেজের একজন খেলোয়াড়। 

Image Credit: Arko Saha

এবার আরেকজনের গল্প শোনা যাক। ক্রিকেটবিষয়ক অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতে তার প্রোফাইলের প্রথম লাইনটা শুরু হয়েছে তাকে ‘নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের ফালক্রাম’ উপাধি দিয়ে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সার্ভিস দিয়ে চলেছেন, খেলে ফেলেছেন ১০৮ টেস্ট, পেয়েছেন নজরকাড়া সাফল্য, বিক্রমের সঙ্গে খেলেছেন পরপর দুটো বিশ্বকাপ, ভাঙাচোরা দলটার মিডল অর্ডার নির্ভরতার সাথে একাই সামলেছেন বহুদিন, এমনকি জাতীয় দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ক্যারিয়ারের পুরোটা জুড়েই ছিলেন ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি। ঠিক কতটা ধারাবাহিক ছিলেন, সেটার একটা স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব বুঝি দেখা যায় গড়েও; ৫১তম টেস্টে প্রথমবার ছুঁয়েছিলেন ৪৫ গড় (৪৫.৩৬), ১০৮তম ম্যাচ শেষে সেই গড়টা দাঁড়িয়েছে ৪৫.৫৬! 

বোকা বোকা শোনাচ্ছে বোধকরি কথাটা। তাহলে চলুন, বরং তার ক্যারিয়ার গ্রাফেই একবার নজর বুলিয়ে আসা যাক! নিচের ছবিটাতে এক পলক তাকালেই বুঝতে পারবেন, পয়তাল্লিশের কাছে গিয়েই যেন আটকে গিয়েছে তার ক্যারিয়ার-গ্রাফ। আবারও নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, রস টেইলর। 

Image Credit: Arko Saha

ডেভন কনওয়ে তো রীতিমতো আরেক কাঠি সরেস। জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ডে, উদ্দেশ্য ছিল নিজের ভাগ্য বিনির্মান। যেই কনওয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় বিভাগে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েও মূল দলের অপেক্ষায় দিনাতিপাত করতেন, নিউ জিল্যান্ডে পাড়ি জমানোর চার বছরের মাথায় তারই টেস্ট অভিষেক হলো লর্ডসে। সেই অভিষেকের ক্যানভাস তিনি রাঙালেন ডাবল সেঞ্চুরির রঙে, খেলে ফেললেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালও। জোহানেসবার্গ থেকে ওয়েলিংটন হয়ে লর্ডস… কনওয়ে নিজের জীবনের গল্পটা নাতি-নাতনীদের বেশ রসিয়ে রসিয়েই করতে পারবেন বৈকি! 

কাইল জেমিসন ঠিক মেঘে ঢাকা পড়তে শেখেননি, এসেই নিজের নামটাকে সবার কাছে তুলে ধরেছেন বেশ কুশলতার সঙ্গেই। ক্যারিয়ারের আট ম্যাচ শেষে ১৪ গড়ের সামান্য উপরে রেখেছেন, ব্যাট হাতেও গড়টা রেখেছেন ৪২। টসে জিতে অধিনায়ক ফিল্ডিং বেছে নিলে গুনে গুনে উইকেট নিয়েছেন ১২ গড়ে, টসে হেরে বল হাতে নিয়েও অধিনায়ককে স্বস্তি এনে দিয়েছেন ১৩ গড়ে। 

বোলিংয়ের কথা যখন এলোই, ট্রেন্ট বোল্ট-টিম সাউদি জুটির কথা তো আসতেই পারে। বর্তমান ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জুটিগুলোর মধ্যে একটি গড়ে তুলেছেন দু’জন মিলে। ৬০ টেস্টে তারা গুনে গুনে তুলেছেন ৫০০ উইকেট। ‘জুটি’ শব্দটার মান রাখতেই বোধহয় দু’জন উইকেটও তুলেছেন পাল্লা দিয়ে; সাউদি নিয়েছেন ২৪৮ উইকেট, বোল্ট ২৫২! হিসেবটা যখন শুধু জেতা টেস্টগুলোর মধ্যে হয়, তখন দু’জনের পাল্লাটা সমান ভারী; দু’জনেই নিয়েছেন ১৬৩ উইকেট করে! দু’জন একসাথে খেলেছেন, এমন ম্যাচগুলোতে নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে ৪৮.৯% শতাংশ উইকেটই তুলে নিয়েছেন তারা দু’জন মিলেই। আর হিসেবটা যখন কেবল ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়, সেই পরিসংখ্যান হয়ে ওঠে আরো দুর্দান্ত – ৫৯.৫২%! 

Image Credit: Arko Saha

বোল্ট-সাউদির সঙ্গে একই ব্রাকেটে আসে আরো একজনের নাম – নিল ওয়াগনার। জ্যারড কিম্বার ভালোবেসে তার নাম দিয়েছেন ‘দ্য আল্ট্রামডার্নিস্ট’। ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন নেহায়েত বেগার খেটে; প্রথম টেস্টে উইন্ডিজের বিপক্ষে ২২৮ স্ট্রাইকরেটে ১৪৪ গড়ে বোলিং করেছিলেন ৩৮ ওভার, ঝুলিতে পুরতে পেরেছিলেন ‘সবেধন নীলমণি’ কিয়েরন পাওয়েলের উইকেটটা। নেহায়েত মামুলি এক সূচনার পর প্রথম ১২ টেস্টে সাকুল্যে উইকেট পেয়েছিলেন ৩৯টি, তাতে ৩৮ ছুঁইছুঁই গড়ের পাশাপাশি স্ট্রাইকরেট নেমে এসেছিল ৬৬.৬২ অবধি। 

বোলার হিসেবে প্যাকেজে খুব বেশি কিছুও ছিল না; তিনি না মরনি মরকেলের মতো লম্বা, না আছে কামিন্সের মতো আগুনে গতি, না বলে আছে অ্যান্ডারসনের মতো সর্পিল মুভমেন্ট, সিম বোলার হিসেবেও তার খুব একটা খ্যাতি নেই, এমনকি নতুন বল পর্যন্ত খুব একটা হাতে নেন না। তবে একটা জিনিস পারেন খুব ভালোমতো, গাধার খাটুনি খাটতে। আর সেটা করেই তিনি হয়ে উঠেছেন নিউ জিল্যান্ড টেস্ট দলের অপরিহার্য অংশ। এতটাই যে বোল্ট-সাউদি যেসব ম্যাচে খেলেছেন, সেসব ম্যাচে তাদের থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই তিনিও। ও আচ্ছা, স্ট্রাইকরেট কিংবা গড়ের দিক থেকেও কিন্তু বোল্ট-সাউদি থেকে বেশ এগিয়ে তিনি! 

Image Credit: Arko Saha

কিংবা বিজে ওয়াটলিং? দেখলেন, এত এত স্টারদের ভিড়ে তিনি যেন হারিয়ে যেতেই বসেছিলেন। খেলায় গ্ল্যামারটা ঠিক নেই, নেহায়েতই সাদাসিধে টেকনিক, পরিসংখ্যানও খুব আহামরি নয়। তবু ম্যাককালাম গ্লাভসজোড়া ছাড়ার পর থেকে তিনিই ছিলেন উইকেটের পিছনে নিউ জিল্যান্ডের এক নম্বর পছন্দ। তিনি ব্ল্যাক ক্যাপসদের ‘ক্রাইসিস ম্যান’; অন্যপ্রান্ত থেকে সব দুমড়েমুচড়ে যাবে, তিনি ঠিকই দাঁত কামড়ে পড়ে থাকবেন ক্রিজে। বোলারকে হতাশার চূড়ান্ত উপহার দেবেন, একের পর এক বল ছেড়ে যাবেন, আর সুযোগ বুঝে দু-একটা বল থেকে আদায় করে নেবেন প্রাপ্য রানটুকু। ব্যস, এই হলো তার ব্যাটিংয়ের সূত্র।  

বরাবরই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা ক্যারিয়ারে তার অর্জনও নেহায়েত কম নয়। কমপক্ষে ২৫ টেস্ট খেলা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি আছেন সেরা দশের মধ্যে, তার পিছনে পড়েছেন ধোনি-অ্যালেক স্টুয়ার্ট থেকে শুরু করে খোদ ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ কিংবদন্তি ব্রেন্ডন ম্যাককালামও! অথচ কখনো লাইমলাইটে আসা হয়নি তার। বিদায়টাও তাই কিছুটা যেন নিভৃতেই হয়ে গেল। 

Image Credit: Arko Saha

***

এমন সব ‘মিসফিটের দল’ নিউ জিল্যান্ডই কি না শেষমেশ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিল বিরাট কোহলির ‘অতলসাগর গভীরতা’র ভারতকে ফাইনালে হারিয়ে! তবে এর পেছনে ফেলে আসা ইতিহাসটাও খুব একটা সুখকর নয় বৈকি। একদিনে বদলায়নি ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’দের ইতিহাস, তাদের ঝুলিতে আছে পরপর দুই বিশ্বকাপের ফাইনালে হারানোর বেদনা, আছে সুপার ওভারেও সমানে সমান লড়ে শেষ পর্যন্ত বাউন্ডারির সংখ্যার ব্যবধানে বিশ্বকাপ হারানোর হৃদয়বিদারক স্মৃতি। চলুন ঘুরে আসা যাক কিউইদের সেই যাত্রাপথে। 

বিশ্বকাপের আগে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা চলে, চায়ের কাপে ঝড় ওঠে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে, এমনকি ‘চোকার’ তকমা নিয়ে সেই আলোচনায় কোনো এক ফাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকাও জায়গা করে নেয়। তবু সেই আলোচনায় আসে না নিউ জিল্যান্ড। তারা কারো আলোচনায় নেই, শিরোপার দৌড়ে থেকেও তাদের নাম কোথাও নেই। দারুণ শুরু করার পর শেষমেশ টুর্নামেন্টে ইতি টানবে কোয়ার্টার ফাইনালে, বড়জোর সেমিফাইনালে – রীতিমতো যেন সবার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তাদের ব্যর্থতার এই সরগম। ফেভারিটের তকমা তাই তাদের গায়ে লাগে না; তারা হয় ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’, কেউ কেউ ভালোবেসে নাম দেন ‘ডার্ক হর্স’। ইতিহাসও সেটার পক্ষেই সায় দেয়; ২০১১ সাল অবধি অনুষ্ঠিত ১০ বিশ্বকাপের ছয়টিতেই তারা খেলেছে সেমিফাইনাল! 

ফরম্যাট বদলায়, নিউ জিল্যান্ডের ভাগ্য বদলায় না। ২০০৭ সালে শুরু হয় ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি, সেই আসরেও তাদের দৌড় থামে সেই সেমিফাইনালেই। পরের চার আসরে অবস্থা হয় আরো শোচনীয়, গ্রুপপর্ব অনায়াসে পার করলেও সেমিফাইনালের আগেই থেমে যায় তাদের দৌড়। ২০১৬ সালে কিছুটা উন্নতি হয় বটে, তবে ঘুরেফিরে দৌড় সেই সেমিফাইনাল অবধিই! 

ত্যক্তবিরক্ত ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’রা রাস্তা খোঁজে ফাইনালের, উপায় মেলে না। মাত্র পাঁচ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশে কি তবে আর আসবে না কোনো বৈশ্বিক শিরোপা?    

***

নিউ জিল্যান্ডে রাগবি খেলাটাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ক্রিকেট সেটার ধারেকাছেও নেই, বলাই বাহুল্য। এমন এক দেশে প্রথম যখন পা দিলেন ক্যান্টারবুরিকে কোচিং করাতে আসা দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভ নসওয়ার্দি, দেখতে পেলেন নিপাট ভদ্রলোকিতে ভর্তি পরিশ্রমী এবং স্নিগ্ধ মানসিকতার কিছু মানুষ, দুরন্ত সাফল্যেও যাদের পা মাটি থেকে বিন্দুমাত্র উপরে ওঠে না, স্রেফ মন দিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে জানে। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিতে খুব বেগ পেতে হলো না, কিউইরা তো ক্রিকেটবিশ্বের ‘সত্যিকারের ভদ্দরলোক’ বলেই আজীবন পরিচিত!  

আপনি ক্রিকেটের পাঁড় সমর্থক হলেও আপনার রিক চার্লসওয়ার্থের নাম শোনার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। অবশ্য তাতে আপনাকে দোষ দেওয়া চলে না, তিনি তো আদতে একজন অস্ট্রেলিয়ান হকি কোচ! তবু নসওয়ার্দির মতে, রিক একাই বদলে দিয়েছেন নিউ জিল্যান্ডের মানসিক হালচাল,

“নিউ জিল্যান্ডাররা কী ভাবে, সেসব আমি জানি না। কিন্তু আমার মতে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের হাই-পারফরম্যান্স ম্যানেজার হিসেবে রিক চার্লসওয়ার্থের নিয়োগটা ছিল টার্নিং পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটা।”

রিক চেয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায় থেকে সবটুকু আগাছা তুলে ফেলতে, একটা পরিচ্ছন্ন কাঠামো তৈরি করে ক্রিকেটকে একদম নতুন করে একটা সূচনা দিতে। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটকে পরবর্তী পর্যায়ে নেওয়ার জন্য গোটা সিস্টেমকে একটা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটে আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখাতে। সেটার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, এমনকি সামর্থ্যে না কুলালেও! নসওয়ার্দি বলছিলেন,

“আমার একটা জিনিস খুব চোখে লেগেছিল একবার। ফিল্ডিংয়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান তার কাছে ছিল না; ক্যাচ, মিস করা চান্স, ডিরেক্ট হিট… কিচ্ছু না। কিন্তু তিনি গোঁ ধরে বসে আছেন, সেরা ফিল্ডারকে তিনি পুরষ্কার দেবেনই। পরিসংখ্যান দেখানোর জো নেই, অথচ তিনি কি না তার জায়গাতে অটল!” 

রিক চার্লসওয়ার্থ; Image Credit: Getty Images

রিক বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্ব ক্রিকেটে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সবদিক থেকেই নিজেদেরকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কাজ করেও যাচ্ছিলেন বটে, তবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নজরে পড়ে যাওয়ার পর তারাই তাকে নিয়ে গেল নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কাজে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত করতে। 

স্রেফ তিন-চার বছর ছিলেন, অথচ ততদিনেই ভবিষ্যতের ভিত্তিটা গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন রিক। কাজটা ততদিনে তুলনামূলক সহজ হয়ে গেছে, নতুন সব কোচ নিয়োগ করে দারুণ এক কাঠামোর মধ্যে হাই-পারফরম্যান্স সেশনে দুর্ধর্ষ সব প্রতিভাকে হাতেকলমে আধিপত্য শেখানোর সহজপাঠ ততদিনে পেয়ে গেছে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট। 

কিন্তু সমস্যাটা বাঁধল অন্যখানে। নিউ জিল্যান্ডের মানুষ রীতিমতো বিনয়ের অবতার, তারা একেবারে মাটির মানুষ; আগ্রাসন তাদের যেন ছুঁতে পারে না। চিরায়ত অজি মানসিকতার রিক দেখলেন, এ তো দেখি সাঙ্ঘাতিক বিপদ হলো! আধিপত্য দেখানোর জন্য তো আগ্রাসনটাও চাই। এমন মাটির মানুষ হলে বিশ্ব ক্রিকেটে এরা ছড়ি ঘুরাবে কীভাবে! অতএব, এবার ভিন্ন পথ বেছে নিতে হলো; আগ্রাসনের বদলে তাদের সঙ্গী হলো ‘হার না মানা’ মানসিকতা। কিউইরা যতই গোবেচারা হোক না কেন, পরাজয় মেনে নেওয়া তাদের জন্য ভীষণ মুশকিল। আর সেটাই বেছে নিলেন রিক, খেলোয়াড়দের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে শুরু করলেন এই মানসিকতাটুকুই। 

তারপরও কথা থেকে যায়। কেই-বা হারতে চায়? হার মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে কারই-বা? জিততে চায় সবাই, সবটা দিয়ে। তাহলে জেতে না কেন? মানসিকতার সঙ্গে সক্ষমতার মেলবন্ধনও তো হওয়া চাই। শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার স্পৃহার সাথে সাথে শেষ বলের আগে ম্যাচ-ভাগ্য বদলে দেয়ার দক্ষতা যদি না থাকে, তাহলে ‘হার না মানা’ মানসিকতা দিয়েই-বা কী হয়?

***

নিউ জিল্যান্ডের এই দলটায় সমন্বয় হয়েছে একদল সুদক্ষ ক্রিকেট কুশীলবেরও। বছরের পর, দশকের পর দশক ধরে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট প্রতীক্ষায় কাটিয়েছে এমন একটি সোনালী প্রজন্মের! তারও আগে কত সোনালী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখিয়েও সত্যি করতে পারেনি, অথবা কখনো কখনো স্বপ্নের রঙ পেতে পেতেও আর পাওয়া হয়নি। ভেঙে গেছে ঘুম, হয়ে গেছে সুখস্বপ্নের ব্যথাতুর পরিসমাপ্তি।

গল্প হোক তেমনি একটা প্রজন্মের। গতির রাজা — শেন বন্ড। শোয়েব আকতার, ব্রেট লি’র সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা করেন। তবে অন্য দু’জনের সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য তার আচার-আচরণে। অন্যরা যেখানে প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে চান না, সেখানে বন্ড বিনয়ের অবতার। তিনি বাউন্সার দেন, কিন্তু তা যেন ব্যাটসম্যানের কোনো ক্ষতি না করে। আপাদমস্তক এই ভদ্রলোক নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের আজকের যে ব্র্যান্ড — তার আদর্শ বিজ্ঞাপন যেন! প্রতিপক্ষকে একদম ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে দিতে চাইলেও, পদ্ধতিটা কিছুতেই অসভ্য ও অশ্লীল নয়, বরং তা বড্ড শালীন। ক্রিস কেয়ার্নস, ন্যাথান অ্যাস্টল ঝড় তোলেন, চোখে চোখ রেখে শাসান প্রতিদ্বন্দ্বীকে, কিন্তু তা ভদ্রতার সীমারেখা ছাড়িয়ে যায় না। ড্যানিয়েল ভেট্টরী, স্কট স্টাইরিস, মার্শাল ভ্রাতৃদ্বয়, ক্রেইগ ম্যাকমিলান, ক্রিস হ্যারিস… সবাই প্রতিভায় দারুণ, লড়তে চান শেষ পর্যন্ত। তাদের অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিং — ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের অধিকারী। ব্যাটিংয়ে যেন নিবেদিত শিল্পী, নেতৃত্বে ইস্পাতকঠিন, তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার জুড়ি মেলা ভার। তারপরও সে দলটার কোথায় যেন খামতি ছিল, ঘাটতি ছিল কোথাও, ঠিক জমেনি তাই। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের আক্ষেপও তাই ফুরোয়নি। বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের অবিসংবাদিত সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন দলটা কদাচিৎ দেখলেও, সে স্বপ্ন পেখম মেলার পূর্বেই ভূপাতিত হয়েছে বারংবার।

সোনালী প্রজন্মের দলটায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সম্মিলন; Image Source: Getty Images

সেই ১৯৩০ সনে, দলটা যখন প্রথম টেস্ট খেললো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ঠিক একই সময়ে ইংল্যান্ডের আরেকটি দল টেস্ট খেলছিল উইন্ডিজের বিপক্ষে। ইংলিশ ক্রিকেটের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে ‘টেস্ট’ দিয়ে ক্রিকেটের সূচনার পর, বহু বছর দলটা ‘দ্বিতীয়’ হয়েই ছিল, প্রথম আর হতে পারেনি!

***

আদ্যিকালের গল্প থাক, ফেরা যাক বর্তমানে। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সূচনা হয় শ্রীলঙ্কায়। শুরুতেই হোঁচট সেখানে। চতুর্থ ইনিংসে ২৬৮ অনায়াসে তাড়া করে বসল স্বাগতিক দল। দু’টি মাত্র টেস্ট। পিছিয়ে থাকা দলের জন্য ফিরে আসা খুব কঠিন। শ্রীলঙ্কায় এক দশক ধরে সিরিজ হার নেই নিউ জিল্যান্ডের, দ্বিতীয় টেস্টে প্রবল বিক্রমে ফিরে অব্যাহত রাখল সেই ধারা। টম ল্যাথামের ‘ড্যাডি হান্ড্রেড’ আর বিজে ওয়াটলিংয়ের ‘সেঞ্চুরি’ এই দুইয়ে চড়ে রাবণের লঙ্কায় শেষ হলো সিরিজ ১-১ সমতায়। মোট পয়েন্টের অর্ধেক ঝুলিতে পুরলো নিউ জিল্যান্ড।

পরের অভিযান অস্ট্রেলিয়া। তার মাঝে স্বদেশের আঙিনায় ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জিতলেও তা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ নয়। ট্রান্স-তাসমান ট্রফি নিউ জিল্যান্ড সর্বশেষ যখন জিতেছিল, এই দলটার অনেকের জন্মই হয়নি তখন। তিনটি দশক ধরে নিরেট দাপট অস্ট্রেলিয়ার। মাঝে মধ্যে বড়জোর ড্র করা গেছে, জেতা আর হয়নি। টানা সাতটি সিরিজে অপরাজিত এবং সর্বশেষ দশটির মধ্যে সাত সিরিজেই বিজয়ের রেকর্ড সঙ্গী করে প্রতিবেশির বনেদি ক্রিকেট আঙিনায় পা রাখে কিউই ক্রিকেট। কিন্তু মন্দ কপাল এবারও। তিনটি টেস্টেই চূড়ান্ত লজ্জা ও বিশাল মার্জিনের পরাজয় জোটে অতিথি দলের। ল্যাবুশেন-ওয়ার্নারের দুরন্ত ফর্ম, স্টার্ক-লায়নের দুর্দান্ত নৈপূণ্যে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট স্বদেশে ফেরে এক বিশাল অশ্বডিম্ব নিয়ে। পাঁচটি টেস্ট থেকে ষাট পয়েন্ট, যা কি না মোট পয়েন্টের মাত্র কুড়ি শতাংশ! এই দল আদৌ চ্যাম্পিয়নশিপের দৌঁড়ে টিকবে?

তাহলে বলিউড সিনেমার ডায়লগ ধার করে বলতে হয়, পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!

Image Credit: Getty Images

নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট-গ্রীষ্মে অতিথি হয়ে এল ভারত। দারুণ দারুণ ফাস্ট বোলার তৈরি করে বিশ্বের সর্বত্র লড়াইয়ের রসদ মজুত করেছে দলটা, ব্যাটিংয়েও বড় বড় নাম। পরপর দু’টি টেস্টে নিউ জিল্যান্ড খুবই ভদ্র ভাষায় জানিয়ে দিল, উঠোনটা তাদের, এখানে বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ বা গতিময় পেসারদের মাস্তানি মোটেই সহ্য করা হবে না। ২-০ তে সিরিজ জিতে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে ফেরার সাথে সাথে কাইল জেমিসন নামের এক দীর্ঘকায় প্রতিভাকে উপস্থাপন করা হল শ্বেত-অঙ্গনে। অভিষেক সিরিজেই ম্যাচসেরা ছাব্বিশের তরুণ। তখনো পঞ্চাশ শতাংশ পয়েন্ট মাত্র ঝুলিতে। চ্যাম্পিয়নশিপ বোর্ডে অবস্থান চতুর্থ। প্রথম তিনটি স্থান দখলে রেখেছে ইংল্যান্ডের ষাট শতাংশ, ভারতের পঁচাত্তর শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়ার বিরাশি শতাংশ পয়েন্ট।

তারপর প্রায় দশ মাসের বিরতি কিউই ক্রিকেটে। বিশ্বক্রিকেটও স্থবির অনেকটা। বহু সিরিজ বাতিল হয়েছে, বহু পয়েন্ট খোয়া গেছে। তাসমান পাড়ের নোনাজল গড়িয়ে গড়িয়ে কোন পাড়ে গিয়ে ঠেকেছে ঠিক নেই। করোনা মহামারি পেরিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে মাঠে ফিরল তারা, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জোড়া টেস্টে অপদস্থ করে ছাড়ল। বুঝিয়ে দিল, ব্যাটে-বলে জঙ ধরেনি কারো, বরং অনাকাঙ্ক্ষিত এই অবসরে নিজেদের আরো শাণিয়ে নেয়া হয়েছে। উইলিয়ামসনের আড়াইশো, নিকোলসের পৌনে দুইশো, সাউদির ফাইফার, সবশেষে জেমিসনের মিলল সিরিজ সেরার স্বীকৃতি। বাষট্টি শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে নিউ জিল্যান্ড তখন উড়ছে।

ক্রিকেট-গ্রীষ্মের এই পর্যায়ে আতিথ্য নিল পাকিস্তান। উইলিয়ামসন উইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট খেলেননি, পিতৃত্বকালীন ছুটিতে গিয়েছিলেন। তবু ল্যাথামের নেতৃত্ব কক্ষচ্যুত হতে দেয়নি দলটাকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে পায়ের ভাঙা আঙ্গুল নিয়ে ওয়াগনারের অদম্য বোলিং, এবং শেষ বেলায় দারুণ রোমাঞ্চ ছড়িয়ে শেষ হাসি নিউ জিল্যান্ডের। দ্বিতীয় টেস্টে আবারও দ্বিশতক অধিনায়কের। দলটায় বুঝি ধারাবাহিকতা, ক্ষ্যাপাটেপনা, নিবেদন, নৈপূণ্য, অসামান্যতা… সব মিলেমিশে একাকার। দুই টেস্টেই জয় দিয়ে সত্তর শতাংশ পয়েন্ট অর্জন করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার জোরালো দাবি নিয়ে উপস্থিত হয় নিউ জিল্যান্ড।

***

লর্ডসের মঞ্চে দুই ফাইনালিস্টের একটি নিউ জিল্যান্ড নিশ্চিত হওয়ার পরও অনেকের সংশয়, ভ্রু-কুঞ্চন কমেনি। বাঁকা ঠোঁটে অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী — নিউ জিল্যান্ডের ফাইনাল; জয় দূর কি বাত, এই ম্যাচ খেলারই যোগ্য নয় দলটা। নেহায়েৎ ভাগ্যগুণে পৌঁছে গেছে এতটা।

নিউ জিল্যান্ড ব্যাটিংয়ের দুই-প্রাণভোমরা; Image Source: Getty Images

সংশয়বাদীদের দোষ কী আর বলুন? আর বছর কয়েক পর ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ প্রাপ্তির শতবর্ষ উদযাপন করবে তারা, অথচ বিশ্বমানের ক’টা ক্রিকেটার দিয়েছে বিশ্বক্রিকেটে? দুর্দান্ত, অসাধারণ, চমৎকার, প্রতিভাবান ক্রিকেটার বহু দিয়েছে অবশ্যই, কিন্তু বিশ্বক্রিকেটের রথী-মহারথী পর্যায়ে উচ্চারিত হয় তেমন ক’টা নাম আছে তাদের? সবেধন নীলমণি এক ‘রিচার্ড হ্যাডলি’ ছাড়া আরেকটু হাতালে বোধহয় ড্যানিয়েল ভেট্টোরির নামটাও কেউ কেউ নেবেন। অবশ্য পালটা প্রশ্ন আসতেও পারে, পাঁচ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি দেশ থেকে ক’জন ক্রিকেটার আর বেরুবে? সেক্ষেত্রে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের দীর্ঘশ্বাস আর আফসোস কী শুনতে পায় কেউ? গ্লেন টার্নার, ক্ল্যারি গ্রিমেট, স্ট্যু ডেম্পস্টারদের মতো অসাধারণ সব ক্রিকেটার হারানো নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট যেন ফিসফিস করে বলতে চায় — ক’জন ক্রিকেটার হারিয়েছি সে হিসেব তো কেউ করল না!

অবশ্য নিউ জিল্যান্ডে যে ক্রিকেট একসময় অপেশাদার বা পেশা হিসেবে অনিশ্চিত ছিল, তা এখন আর নেই। রস টেলর কিউই ক্রিকেটের ব্যাটিং-প্রাণভোমরা, তিনি যখন পেশাদার ক্রিকেট শুরু করছেন, তখনও অপেশাদার অবস্থায় নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট। কিন্তু সময়ের সাথে বদলে গেছে তা। ক্রিকেট নিউ জিল্যান্ডে অত্যন্ত সম্মানজনক ও সুনিশ্চিত পেশা হিসেবে বিবেচিত আজকাল। কাইল জেমিসনের মতো দীর্ঘকায় তরুণ, যিনি কি না রাগবি-বাস্কেটবল খেলতে পারতেন অনায়াসে, শুরুটা ব্যাটসম্যান হিসেবে করলেও বনে গেছেন বোলার। ক্যারিয়ারটা একটু বিলম্বে শুরু হয়েছে যদিও। ডেভন কনওয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বাজি ধরেছেন ক্রিকেটে, স্বদেশ ছেড়েছেন সহায়-সম্পদ সমস্ত লগ্নি করে গন্তব্য বেছে নিয়েছেন নিউ জিল্যান্ড।

দলটার একেকজন একেক রকম, যেন একদম আলাদা অন্যজন থেকে, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র-ধরণ-ব্যক্তিত্ব-বেড়ে উঠা। ল্যাথাম-উইলিয়ামসন ছেলেবেলা থেকেই কিউই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ, বোল্ট-সাউদিও তা-ই। তবে চারজনের জীবনধারা একই সুর-ছন্দে গাঁথা নয়। নিল ওয়াগনার বহু সাধ্য-সাধনার পর পৌঁছেছেন এই পর্যায়ে, কনওয়ে-জেমিসন-ওয়াটলিংয়ের গল্পেও কত ভিন্নতা। রস টেলর অধিনায়কত্ব হারিয়ে বিপর্যস্ত ছিলেন, ক্রিকেট কতটা উপভোগ করতে পারবেন তা নিয়ে ছিল সংশয়। সব থেকে প্রবীণ তিনি, সবার চেয়ে উদ্যমীও।

দলটা যেন অনেকটা ভিন্ন ভিন্ন ফুল নিয়ে অভিন্ন ও অনিন্দ্য সুন্দর একটি মালা গাঁথার মতো।

***

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা যদি করা হয়, প্রথম সারির অনেকটা জুড়েই থাকবে এই প্রজন্মের ক’জন। রস টেলর সাড়ে সাত হাজার টেস্ট রান নিয়ে স্বদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সাত হাজার পেরোনো উইলিয়ামসন আছেন তার পেছনেই। ওডিআই ক্রিকেটেও সাড়ে আট হাজার রান নিয়ে টেলর সর্বাগ্রে, ছ’হাজার পেরিয়ে ছুটছেন উইলিয়ামসনও। সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেটধারী হ্যাডলির পর ভেট্টোরি বাদ দিলে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখলে নিয়েছেন সাউদি ও বোল্ট। ষষ্ঠ স্থানে ওয়াগনার। এই সময়ের বিধ্বংসী বোলিং জুটির কথা যদি বলা হয়, সাউদি-বোল্ট খুব সম্ভব প্রথমেই থাকবেন। অ্যান্ডারসন-ব্রড অনিয়মিত প্রায়, বিশ্বের যেকোনো কন্ডিশন-পিচ-ভূখণ্ডে রাজত্ব করার মতো জুটি এখন এই একটিই। ওয়াগনারকে জুড়ে নিলে ত্রয়ী হয়, সেক্ষেত্রে স্টার্ক-হ্যাজলউড-কামিন্স ত্রয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন হয়তো, কিন্তু বোল্ট-সাউদি-ওয়াগনার তারপরও অবিশ্বাস্য। ইদানিং যোগ হয়েছেন আবার কাইল জেমিসন; আরো দুর্বার, আরো দুরন্ত। ভারতের পেস-ব্যাটারি ছাড়া নিউ জিল্যান্ডের বৈচিত্রপূর্ণ এই পেস-চতুষ্টয়ের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার নেই আর কেউ।

নিউ জিল্যান্ডের পেস-চতুষ্টয়; Image Source: Getty Images

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট তবু প্রাপ্য স্বীকৃতি পায় না। লর্ডসের ফাইনালে পরিষ্কার ফেভারিট ভারত। কোনো সুযোগই নেই নিউ জিল্যান্ডের। শেষদিনের ক্রিকেট রোমাঞ্চেও ভারত এগিয়ে, নিউ জিল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা মাত্র ২৭ শতাংশ। সেই সাতাশ শতাংশই শতভাগ শতাংশে রূপান্তর করে নিউ জিল্যান্ড। তখনো জিকির উঠে — একটিমাত্র ম্যাচ অমন হতেই পারে, তিন ম্যাচের সিরিজ হলে বোঝা যেত, কার দৌঁড় কতদূর!

***

মাঝারী মেধার ছাত্র থাকে কিছু। পেছনের বেঞ্চিতে বসে না, প্রথম সারিতেও না। ফেইল-টেইল তেমন করে না, টেনেটুনে পাসও না, মোটামুটি ভালোই নাম্বার পায়, কিন্তু প্লেস পাওয়ার মতো না। শিক্ষকের সুনজরে থাকে না তারা, কুনজরেও না। ফাঁকিবাজিতে প্রবল উৎসাহ, খেলাধুলাতেও সাগ্রহে অংশগ্রহণ, টুকটাক পড়াশোনাও চলে। বন্ধুরা ‘ফেল্টুস’ বলে এড়িয়ে যায় না, আবার ‘ভালো ছাত্র’ বলে খাতিরও করে না। স্যারের প্রিয়ভাজনও নয়, চক্ষুশূলও নয়। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট যেন সেই মাঝারী মেধার ছাত্রের মতো। দলটাকে ‘ভালো দল’ বলা যায়, তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো না।

গৃহশিক্ষকের কঠোর নজরদারি, পরিবার ও বাবা-মা’র নিবিড় পর্যবেক্ষণ, আর ছাত্রের নিঃসীম মনযোগে কখনো-সখনো প্রথম স্থান অধিকার করে নেয় মধ্যম সারির ছাত্রটি। তখন কারোরই বিশ্বাস হতে চায় না তা। বন্ধুদের চোখে অবিশ্বাস, স্যাররাও ঠিক মেনে নিতে পারেন না। এ্যাঁহ, টপার? কীভাবে সম্ভব?

প্রথম টেস্ট জিততে নিউ জিল্যান্ডের লেগেছে ছাব্বিশ বছর, প্রথম সিরিজ জয় পায় ঊনচল্লিশ বছরে গিয়ে। বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের তকমা জোটে একানব্বই বছর পর। কে জানে, এই সম্মানের যে তারাই যোগ্য দাবিদার, তা প্রতিষ্ঠা করতে আরো কত বছর লাগবে! ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র-ধরণ-ব্যক্তিত্বে পূর্ণ দলটা আত্মবিশ্বাস ও তৃপ্তি নিয়ে বলতে পারবে — এই মণিহার আমারই যে সাজে!

This article is in Bengali language, on about how misfit New Zealand cricket team won the inaugural test championship.

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version