বলতে পারবেন, সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড (এখন পর্যন্ত) দেখেছিল কোন বিশ্বকাপ? অথবা এক খেলাতেই সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড দেখানো হয়েছিল কোন বিশ্বকাপে? অথবা কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে রেফারীর ‘নির্দয়’ লাল কার্ড প্রদর্শন আজও এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি হয়ে আছে?
এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরই প্রোথিত আছে এক বিশ্বকাপসকাশে, ফেদেরাসিওঁ অ্যাঁতেরন্যাসিওনাল দ্য ফুতবল্ আসোসিয়াসিওঁ, অর্থাৎ ফিফার ১৮তম ফুটবল বিশ্বকাপ আসরে। ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপের আছে সর্বোচ্চ ২৮টি লাল কার্ডের (সাথে ম্যাচপ্রতি ৫.৩৯ গড়ে মোট ৩৪৫টি হলুদ কার্ডের কথা না বললে অন্যায় করা হবে হলুদ কার্ডের প্রতি) বিশ্বরেকর্ড; আছে (বিশ্বকাপের) এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি চারটি লালকার্ড আর চার চারে ষোলটি হলুদ কার্ডের রেকর্ড। ইতিহাসে পর্তুগাল আর নেদারল্যান্ডের মাঝে হওয়া এই ‘যুদ্ধ‘ ব্যাটল অব নুরেমবার্গ নামে বিখ্যাত। কিন্তু এতো কিছু ছাপিয়ে এই বিশ্বকাপ সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে তার সমাপনীতে। এর ট্র্যাজেডি গেঁথে ছিল ফাইনালের একমাত্র লালকার্ডের বেদনায়। এক কিংবদন্তীর বিয়োগাত্মক প্রস্থান ভাগ্য লিখে দিয়েছিল এক দেশের হর্ষ আর আরেক মানচিত্রের বিষাদ। ২০০৬ সালের নয় জুলাই ছিল রবিবার। সেদিনের বার্লিনের রাত কারো জন্য হয়ে এসেছিল শনি, আর কারো জন্যে মঙ্গল। চলুন, আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসি আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগের সেই দিন থেকে যেদিন ইতিহাসের অন্যতম জীবন্ত কিংবদন্তী জিনেদিন জিদান তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে লাল কার্ড দেখে বহিষ্কৃত হন; তার দেশ ফ্রান্স বঞ্চিত হয় দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব থেকে আর ইতিহাস জন্ম দেয় এক স্মরণীয় ফাইনালের।
আর্জেন্টাইন রেফারি হোরাসিও মার্সেলো এলিজোন্ডোর বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে জমে ওঠে বার্লিনের ফাইনাল। প্রথমার্ধের মাত্র ৭ মিনিটের মাথায় ডি-বক্সের ভিতর ফ্রান্সের ফ্লোঁরা মালুদাকে ফেলে দেন ইতালির ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জি। এলিজোন্ডোর বাঁশি নিশ্চিত করে ফ্রান্সের পেনাল্টি। তুখোড় বুদ্ধির জিদান সেই শুটআউট থেকে ইতালির বিশ্বখ্যাত গোলকিপার জিয়ানলুইজি বুফনকে বোকা বানান। বারে লেগে গোললাইন অতিক্রম করা বল এগিয়ে দেয় ফ্রান্সকে।
কিন্তু সেই অগ্রযাত্রা বেশিক্ষণ টেকেনি। খেলার ১৯ মিনিটে মাতেরাজ্জির হেড ইতালিকে সমতায় ফেরায়। আন্দ্রে পিরলোর (ফ্রান্সের আবিদালের পায়ে লেগে পাওয়া) কর্নার কিককে গোলপোস্টের প্রায় ৬ গজ দূর থেকে তিনি গোলে পরিণত করেন।
দুই দলই নির্ধারিত ৯০ মিনিটের ভিতরই আরো কয়েকবার সুযোগ পায়। যেমন- খেলার ৩৫ মিনিটে পিরলোর কর্নার থেকে ইতালির লুকা টনির লাফানো হেড ক্রসবারের উপরের অংশে লেগে মাঠ ছাড়ে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দারুণভাবে বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়া থিয়েরি হেনরি পারেননি দলকে এগিয়ে নিতে। ৫২ মিনিটে পেনাল্টি বক্সের ভিতর জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা মালুদাকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাকল করলেও রেফারি তা গুরুতর মনে না করে এড়িয়ে যান। ম্যাচের ৬১ মিনিটে ইতালি লুকা টনির দূরপাল্লার হেডে এগিয়ে যেতে পারতো যদি না নীরস চেহারার সহকারি রেফারি অফসাইডের সংকেত না দিতেন। অবশ্য ফ্রান্সের পক্ষেই জয়ের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। গোলপোস্টে তাদেরই ছিল অধিকসংখ্যক শট। ইতালির যেখানে ৬টি শট (যার ভিতর দুটি মাত্র গোলমুখে), সেখানে ফ্রান্সের ১৪টির ভিতর সাতটিই ছিল গোলমুখে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে খেলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। বুফন অতিরিক্ত সময়ের ১৩ মিনিটে দুর্দান্তভাবে নিশ্চিত গোলের দিকে যাওয়া জিদানের একটি হেড ডান হাতে রুখে দেন। কিন্তু এই ম্যাচের আসল মুহূর্ত যে তখনো আসেনি।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে জিদান মাতেরাজ্জির আপত্তিকর মন্তব্যে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং পিছন ঘুরে মাতেরাজ্জির বুকে বসিয়ে দেন ইতিহাসবিখ্যাত এক ঢুঁস! মাঠের রেফারি এটি খেয়াল না করলেও খেয়াল করেন চতুর্থ অফিসিয়াল স্পেনের মেদিনা কান্তালেখো লুইস। তিনি এলিজোন্ডোকে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করেন। ম্যাচ কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে; মাঠেই মাতেরাজ্জির প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
স্বদেশী সহকারি রেফারির সাথে আলোচনা করে খেলার ১১০তম মিনিটে এলিজোন্ডো জিদানকে লাল কার্ড দেখান।
জিদানের সহযোদ্ধারা রেফারিকে ঘিরে ধরেন; রেফারিকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেন। জিদানও কথা বলেন এলিজোন্ডোর সাথে। ফ্রান্সের কোচ রেমন্ড ডমেনেখ রেফারির এই সিদ্ধান্তে বিদ্রূপাত্মক হাততালি দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। বাম বাহু থেকে অধিনায়কের আর্ম-ব্যান্ড খুলে স্যানিয়লের হাতে দিয়ে জিদান বের হয়ে আসেন ৬৯, ০০০ দর্শকের অলিম্পিয়া স্টেডিয়াম থেকে।
আট বছর আগে যে বিশ্বকাপ ট্রফিটি তুলে ধরেছিলেন সগৌরবে, ছিলেন সেই গৌরবের রূপকার; আজ সেই ১৩.৬১ পাউন্ডের আরাধ্য জিনিসটার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান ফ্রান্সের কিংবদন্তী ফুটবলার জিনেদিন জিদান। তিনি বিশ্বকাপ ফাইনালে লাল কার্ড পাওয়া চতুর্থ খেলোয়াড়, অতিরিক্ত সময়ের ক্ষেত্রে প্রথম।
খেলা অতিরিক্ত সময়েও অমীমাংসিত থাকায় টাইব্রেকারে গড়ায়। আর সেখানে সবকটি শট লক্ষ্যভেদ করে ৫ – ৩ ব্যবধানে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ইতালি।
পরবর্তীতে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। মার্সেল ম্যাথিয়েরের নেতৃত্বে ফিফার পাঁচ সদস্যের ডিসিপ্লিনারি কমিটি জিদান ও মাতেরাজ্জি দুজনকেই তলব করে। জিদানকে তার কাজের জন্য তিন ম্যাচের জন্য নিষেধাজ্ঞা আর ৭,৫০০ সুইস ফ্র্যাঁ জরিমানা করা হয়। কিন্তু জিদান আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেওয়ায় তাকে বিকল্প হিসেবে তিন দিন শিশু-কিশোরদের সাথে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য আদেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে মাতেরাজ্জিকে বারবার উসকানিমূলক কথা বলার দায়ে ইতালির জাতীয় দলের হয়ে দুটি ম্যাচ আর পাঁচ হাজার সুইস ফ্র্যাঁ জরিমানা করা হয়। ডিসিপ্লিনারি কমিটির সামনে দুই খেলোয়াড়ই স্বীকার করেন যে, মাতেরাজ্জির উক্তি বিকৃত ছিল; কিন্তু বর্ণবাদী ছিল না।
কী বলেছিলেন মাতেরাজ্জি?
খেলার অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষভাগ। কেউ আর কোনো গোল করতে না পারলে এই ট্রফির নিষ্পত্তি হবে টাইব্রেকারে। এমন সময় মূল খেলা থেকে সবার নজর চলে গেলো এক পার্শ্ব ঘটনায়। হঠাৎ মাঠে পড়ে থাকতে দেখা গেলো ইতালির একমাত্র গোলদাতাকে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বের হল এই কান্ডের হোতা ম্যাচের আরেক গোলদাতা জিদান। জার্সি ধরে টানাটানির এক পর্যায়ে জিদান মাতেরাজ্জিকে বলেন, “তুমি যদি এতোই আমার জার্সিটা চাও, তো খেলার পর (এটা) নিও।” জবাবে মাতেরাজ্জি খুব খারাপ একটা কথা বলে বসেন, “আমি বরং তোমার বোনকে (এক্ষেত্রে) অগ্রাধিকার দেবো।” ব্যস, এতেই ক্ষেপে যান জিদান। ফলস্বরূপ পেছন ঘুরে মাথা দিয়ে মেরে বসেন মাতেরাজ্জির বুকে। পরে অবশ্য মাতেরাজ্জিও স্বীকার করেন যে, তিনি জিদানের বোনকে নিয়ে কুরূচিপূর্ণ কথা বলেছিলেন। অবশ্য ইতালিয়ান ডিফেন্ডার এও দাবি করেন যে, তিনি আসলেই জিদানের বোন আছে কিনা এটা জানতেন না। কেবল স্লেজিং হিসেবেই নাকি কথাটি বলেছিলেন তিনি।
এক নজরে ২০০৬ জার্মান বিশ্বকাপ ফাইনাল
ইতালি বনাম ফ্রান্স
তারিখঃ ৯ জুলাই, রবিবার (স্থানীয় সময় রাত আটটায়)
স্টেডিয়ামঃ অলিম্পিয়া স্টেডিয়াম (বার্লিন)
দর্শক সংখ্যাঃ ৬৯, ০০০
ফলাফলঃ ইতালি ১ (৫) – ফ্রান্স ১ (৩)
হাফ টাইমঃ ১ – ১
গোলদাতাঃ
- ফ্রান্সঃ জিদান (৭; পেনাল্টি থেকে)
- ইতালিঃ মাতেরাজ্জি (১৯; কর্নার থেকে হেডে)
পেনাল্টি শুট আউট (প্রথমে ইতালি)
- ইতালিঃ পিরলো (√), মাতেরাজ্জি (√), রসি (√), দেল পিয়েরো (√), গ্রোসো (√)
- ফ্রান্সঃ উইলটর্ড (√), ত্রেজেগে (X), আবিদাল (√), স্যাগনল (√)
বলের দখলঃ
- ইতালিঃ ৫১%
- ফ্রান্সঃ ৪৯%
রেফারিঃ হোরাসিও মার্সেলো এলিজোন্ডো (আর্জেন্টিনা)
সহকারী রেফারিঃ গার্সিয়া দারিয়ো এবং ওতেরো রোডলফো (দুই আর্জেন্টাইন)
চতুর্থ অফিসিয়ালঃ মেদিনা কান্তালেখো লুইস (স্পেন)
অফসাইডঃ
- ইতালিঃ ৪
- ফ্রান্সঃ ২
কর্নার কিকঃ
- ফ্রান্সঃ ৭
- ইতালিঃ ৫
সেইভঃ
- ইতালিঃ ৬
- ফ্রান্সঃ ১
ফাউলঃ
- ফ্রান্সঃ ২৪ বার
- ইতালিঃ ১৫ বার
হলুদ কার্ডঃ চারটি
- ইতালিঃ একটি; জামব্রোত্তা (৫)
- ফ্রান্সঃ তিনটি; স্যাগনল (১২), ম্যাকেলেলে (৭৬), মালুদা (১১১)
লাল কার্ডঃ একটি
- ফ্রান্সঃ জিদান (১১০)
ফাইনালের পথে ইতালি
গ্রুপ ‘ই’ ছিল ইতালির গ্রুপ। ১২ জুন ঘানাকে ২-০ গোলে হারিয়ে, ১৭ জুন দ্বিতীয় ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১ – ১ গোলে ড্র করে আর ২২ জুন শেষ ম্যাচে চেক রিপাবলিককে ২-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপচ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউট স্টেজে ওঠে ইতালি। ২৬ জুন শেষ ষোলতে অস্ট্রেলিয়াকে একমাত্র গোলে হারিয়ে ওঠে কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে ইউক্রেইনকে ৩ – ০ গোলে হারিয়ে নিশ্চিত করে সেমিফাইনাল। ৪ জুলাই প্রথম সেমিফাইনালে জার্মানিকে ২ -০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ইতালিয়ানরা।
ফাইনালের পথে ফ্রান্স
অন্যদিকে ফ্রান্সের ছিল গ্রুপ ‘জি’। ১৩ জুনের প্রথম ম্যাচ তারা সুইজারল্যান্ডের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। ১৮ জুনও একই কান্ড ঘটে ফ্রান্সের সাথে; এবার দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। ২৩ জুনের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তারা ২-০ গোলে টোগোকে হারিয়ে গ্রুপ রানার-আপ হয়ে শেষ ষোলতে ঠাই নেয়। শেষ ষোলতে তারা স্পেনকে হারায় ৩ -১ গোলে। কোয়ার্টার ফাইনালে ১ জুলাই ব্রাজিলকে বিদায় করে দেয় একমাত্র গোলে। আর ৫ জুলাই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে একমাত্র গোলে পর্তুগালকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে জিদানের ফ্রান্স।
ফিফার পূর্ণরূপের এই বাংলা ভার্সন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফরাসি ভাষার সহকারি অধ্যাপক জনাব বিপুল চন্দ্র দেবনাথ কর্তৃক নিরীক্ষাকৃত