চ্যাম্পিয়ন্স লিগ (২০১৭-১৮) কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগের যত হালহকিকত

ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ধুন্ধুমার লড়াই আর রোমাঞ্চে ঠাসা এ আসরের আসল আকর্ষণ হলো নক আউট পর্ব। দুই লেগের এই লড়াইয়ের দ্বিতীয় লেগটি থাকে নানা অংকে ভরপুর। ম্যাচশেষে কেউ অগ্রগামিতা ধরে রাখায় উদ্বাহু হয় আর কেউ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস রচনা করে। ২০১৭-১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় পর্বের চারটি ম্যাচের খুঁটিনাটি নিয়ে এই লিখাটি।

রোমা বনাম বার্সেলোনা

প্রথম লেগের ফলাফল: বার্সেলোনা ৪-১ রোমা

মেসি সুয়ারেজ যেকোনো ডিফেন্সের জন্যই ত্রাস; Source: insajderi.com

ক্যাম্প ন্যু তে রোমার সেমিফাইনালের স্বপ্নে ছেদ পড়ে যায় মূলত ৫৫ মিনিটের মধ্যে, যখন তারা দুটো আত্মঘাতী গোল হজম করে বসে। যখন আপনি বার্সার সাথে খেলেন, তখন আপনার রক্ষণের বিন্দুমাত্র ভুলও বড় হয়ে ধরা দেবে। এডিন জেকোর করা অ্যাওয়ে গোলটি কাগজে কলমে ফিরে আসার ক্ষীণ আলো হয়ে দেখা দিলেও বাস্তবতা তা নয়। সপ্তাহান্তের লিগের ম্যাচেও রোমা ঘরের মাঠে খোদ ফিওরেন্তিনার কাছে হেরেছে, সর্বশেষ তিন ম্যাচে তাদের কোনো জয় নেই। তাদের আশার পালে হাওয়া দিতে পারে একটি তথ্য, অ্যাওয়ে ম্যাচে বার্সার গোল সংখ্যা খুবই কম। অলিম্পিয়াকোস ও জুভেন্টাসের সাথে গোলশূন্য থাকা বার্সা মোট চার অ্যাওয়ে ম্যাচে করেছে ২ গোল। রোমা ফিরে পাচ্ছে তাদের মাঝমাঠের প্রাণশক্তি রাজডা নাইঙ্গোলানকে।

বার্সা সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারিগর ভালভার্দে: Source: The False 9

রোমার উল্লসিত হওয়ার কারণও খুবই অল্প। রোমার সতর্ক ধাঁচের ফুটবল খুব বড় ব্যবধানের জয় এনে দেয় না বললেই হয়। ন্যূনতম ৩-০ গোলের জয় চাই রোমার। এদিকে লেগানেসের সাথে মেসির যে রূপ দেখা গেছে তাতে রোমা ডিফেন্সের কোনো গোল না হজম করার আশা মোটামুটি সুদূরপরাহত। আর বার্সা ১ গোল দিয়ে দেয়া মানেই রোমাকে জিততে গেলে করতে হবে ৫টি, যা ভালভার্দের মতো অসাধারণ ট্যাকটিশিয়ানের রক্ষণের বিপক্ষে প্রায় অসম্ভব। একটা প্রচলিত কথা আছে যে, বার্সা যে ম্যাচ ভালো না খেলে জিতে, সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় থাকে পিকে। যতই সমালোচনা থাক, ক্যাম্প ন্যুতে পিকে ছিলেন অনবদ্য। পিকে-উমতিতিকে পেরিয়ে ৩ গোল (বা অধিক) করে জয়ের আশা আপাতত বাস্তবসম্মত ঠেকে না।

সম্ভাব্য লাইন আপ:

রোমা (৪-৩-৩)

এলিসন;
পেরেস, ফ্যাজিও, মানোলাস, কোলারভ;
পেল্লেগ্রিনি, রসি, নাইঙ্গোলান;
ফ্লোরেঞ্জি, জেকো ও শারাউইয়ি।

বার্সেলোনা (৪-৪-২)

স্টেগান;
রবার্তো, পিকে, উমতিতি, আলবা;
দেম্বেলে, বুস্কেটস, রাকিটিচ, ইনিয়েস্তা;
মেসি ও সুয়ারেজ।

ম্যানচেষ্টার সিটি বনাম লিভারপুল

আগের লেগের ফলাফল: লিভারপুল ৩-০ ম্যানসিটি

যদি এই মৌসুমে ইংলিশ লিগের অধিক আলোচ্য বিষয়ের একটি তালিকা করা হয়, তবে সেই তালিকায় অগ্রে থাকবে ম্যানসিটির আক্রমণ আর লিভারপুলের রক্ষণের কথা। সন্দেহাতীতভাবে এই মৌসুমের সেরা আক্রমণভাগ ম্যানসিটির আর মৌসুমের একটা বড় সময় ধরে ভঙ্গুর রক্ষণের জন্য সমালোচিত লিভারপুল। অথচ প্রথম লেগের ম্যাচে যেন সব বদলে গেল। ভ্যান ডাইক আসায় লিভারপুলের রক্ষণ বেশ কিছুকাল যাবতই বেশ শক্ত কিন্তু সিটির এই আক্রমণের সামনে যে এতটা নিরেট থাকবে তা কেউই ভাবেননি। সালাহ নৈপুণ্যে ৩-০ গোলে প্রথম লেগ জিতে নেয় লিভারপুল।

পেপ গার্দিওলার সিটি ছিল নিজের ছায়া হয়ে। কোনো অ্যাওয়ে গোল হজম না করে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে লিভারপুল। কিন্তু তাদের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে আসে প্রথম লেগের নায়ক মোহাম্মদ সালাহর চোট। গতকাল চোট কাটিয়ে অনুশীলনে ফিরলেও পুরো সুস্থ হয়ে নামতে পারবেন কিনা তা নিশ্চিত না।

এই মৌসুমে সালাহই লিভারপুলের মূল ভরসার নাম: Source: filgoal.com

মৌসুমের মাঝপথে কৌটিনহো বার্সায় চলে যাওয়ার পরেও লিভারপুল ভেঙে পড়েনি মানে-ফিরমিনো-সালাহ এই ত্রয়ীর জন্য। দারুণ উপভোগ্য এই ত্রয়ী যেকোনো সময় গোল দিয়ে দিতে পারে যেকোনো দলকে। আর সিটির মাঠে লিভারপুল ১ গোল দিলেই সিটিকে পরিশোধ করতে হবে ৫ গোল। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন দিয়ে সাজানো সিটি রক্ষণ আশানুরূপ খেলতে পারছে না ইদানীং। লিভারপুল তক্কে তক্কে থাকবে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই অ্যাওয়ে গোল পেতে। সিটির জন্য সুখবর হলো আগুয়েরোর ফিরে আসা। সিটি এই মৌসুমে এতটাই মুক্ত ছন্দে গোল করছে যে, কোনো লিডই সিটির সাথে নিরাপদ না।

ডাগ আউটে মস্তিস্কের লড়াইয়েও থাকবে উত্তেজনা: Source:The Liverpool Offside

কিন্তু লিভারপুল কোচ ক্লপও কম চতুর না। যেভাবে সিটিকে মাঝমাঠে আটকে নিয়ে বাজিমাত করেছেন, এমন ট্যাকটিকাল মাস্টারক্লাসের পুনরাবৃত্তি হলে সিটির বিদায়ঘন্টা বেজে যাবে। স্টার্লিং এর বদলে গুন্ডোগানকে খেলানোর কৌশলটা পেপ এর জন্য কাজে দেয় নি। এমনকি ৩-২ গোলে হারা ম্যানচেস্টার ডার্বিতে সিটি সুযোগ তৈরিতে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে থাকলেও তাদের রক্ষণের দৈন্য স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল সেই ম্যাচে। লিভারপুলের সাথে অ্যাওয়ে গোল না থাকাটা সিটির জন্য সবচেয়ে কাল। হয়তো ম্যাচ সিটি জিতে নেবে কিন্তু দুই লেগ মিলিয়ে সেমিতে উঠতে লিভারপুলই ফেভারিট।

সম্ভাব্য লাইনআপ

ম্যানসিটি (৪-৩-৩)

এডারসন;
ওয়াকার, ওটামেন্ডি, লাপোর্তে, ডেলফ;
ডি ব্রুনে, ফার্নান্দিনহো, সিলভা;
স্টার্লিং, আগুয়েরো ও সানে।

লিভারপুল (৪-৩-৩)

কারিউস;
আর্নল্ড, লভরেন, ভ্যান ডাইক, রবার্টসন;
চেম্বারলিন, উইনালডাম, মিলনার;
সালাহ, ফিরমিনো ও মানে।

রিয়াল মাদ্রিদ বনাম জুভেন্টাস

আগের লেগের ফলাফল: জুভেন্টাস ০-৩ রিয়াল মাদ্রিদ

সেই রাতটা ছিল শুধুই রোনালদোময়। নিজের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো বিপক্ষের মাঠে এত বড় অভিবাদন পাওয়া রোনালদো কী করেছেন সেই রাতে তার জন্য সেই ওভারহেড কিকের একটি ছবিই যথেষ্ট। জুভেন্টাস গত দশ বছরে ইতালির সবচেয়ে ধারাবাহিক দল।

ঐতিহাসিকভাবেই ইতালিয়ান দলগুলোর রক্ষণ হয়ে থাকে প্রচন্ড শক্তিশালী। আর অপদিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চালু হওয়ার পর রিয়াল মাদ্রিদ কখনো দুই লেগের নক আউটে জুভেন্টাসকে হারাতে পারেনি। আগেও এমন অনেক জুজু কাটিয়ে আসা জিজু (জিদান এর ডাক নাম) তুরিনের মাটিতেই জুভেন্টাসকে ৩-০ গোলে হারিয়ে মূলত এক পা সেমি ফাইনালে দিয়ে রেখেছেন। জুভেন্টাসের সামনে এক অসাধ্য সাধনের চ্যালেঞ্জ।

রোনালদোর সেই বিখ্যাত ওভারহেড গোল; Source: the-star.co.ke

লিগে সবচেয়ে দারুণ অ্যাওয়ে রেকর্ড জুভেন্টাসের। কিন্তু খেলাটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মঞ্চে যেখানে রিয়াল অন্যরূপের একদল। জুভদের জন্য বড় সুখবর, কার্ডের গ্যাড়ায় পরে রামোস মাঠের বাইরে। নাচো ইঞ্জুরড। ভারানের সঙ্গী হতে পারতো উদীয়মান তরুণ ভালেহো। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নেয়ার সেই সময়ে সে নিজেই চোটের কবলে। অনুশীলনে ফিরলেও নিশ্চিত নয় খেলা। সেক্ষেত্রে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার থেকে সেন্টার ব্যাকে শিফট হতে হবে ক্যাসেমিরোকে। নড়বড়ে ডিফেন্সের সামনে থাকবে দুই ‘মার্কম্যান’ মানজুকিচ ও হিগুয়েন। সেক্ষেত্রে রিয়ালের মাঝমাঠে নামবেন কোভাচিচ, ক্রুস, মড্রিচ ও ইস্কো। বলাই বাহুল্য, বল নিয়ন্ত্রণে রিয়াল এগিয়ে থাকবে। জুভেন্টাসের জন্য আরেক সুখবর পিয়ানিচের ফেরা, কিন্তু সেই সাথে রয়েছে বড় দুঃসংবাদ,কার্ডের জন্য খেলতে পারবেন না ডিবালা। যার উপর সবচেয়ে বেশী আশা নিয়ে নামে জুভেন্টাস সেই ডিবালার অনুপস্থিতিতে রামোস-হীন রক্ষণ বেশ একটু স্বস্তি পাবে। জুভেন্টাসের সেমিতে যেতে হলে পর্বতসম বাঁধা পেরোতে হবে, যা মোটামুটি অসম্ভবই বলা যায়।

ডিবালার অনুপস্থিতিতে আক্রমণের মূল দায়িত্ব হিগুয়েনেরই: Source:Squawka

সম্ভাব্য লাইন আপ

রিয়াল মাদ্রিদ (৪-৩-১-২)

নাভাস;

কারভাহাল, ক্যাসেমিরো, ভারানে, মার্সেলো;

মড্রিচ, কোভাচিচ,ক্রুস;

ইস্কো;

রোনালদো ও বেনজেমা।

জুভেন্টাস (৪-২-৩-১)

বুফন;

সিজিলিও, কিয়েল্লিনি, বেনাশিয়া, সান্দ্রো;

পিয়ানিচ, খেদিরা;

কুয়াদ্রাদো, কস্তা, মানজুকিচ;

হিগুয়েন।

বায়ার্ন মিউনিখ বনাম সেভিয়া

প্রথম লেগের ফলাফল: সেভিয়া ১-২ বায়ার্ন মিউনিখ

স্প্যানিশ যেকোনো দলের জন্যই সেভিয়ার মাঠ এক কঠিন পরীক্ষার জায়গা। শেষ ষোলোতে ম্যানইউকে বিদায় করে আসা সেভিয়াও নিজেদের মাঠে বায়ার্নকে দিয়েছিল সম্ভাব্য কঠিনতম স্বাগতবার্তা। প্রথমে এগিয়ে গেলেও নাভাসের আত্মঘাতী গোলে এবং থিয়াগোর হেডারে ম্যাচ জিতে নেয় বায়ার্ন। ঠিক যেন রোমার মতো অবস্থা! এমন সব ম্যাচে আত্মঘাতী গোলের মূল্য বেশ চড়া, উপরন্তু যখন আপনাকে বায়ার্নের মাঠে খেলতে হবে পরের ম্যাচ।

নাভাসের আত্মঘাতী গোলের মূল্য দিতে হবে সেভিয়াকে ভালোভাবেই; Source: FourFourTwo

বায়ার্নের মাঠ এলিয়াঞ্জ এরেনাতে জয় পাওয়া মোটামুটি অসাধ্য ব্যাপার। এ মৌসুমে লিগে নিজেদের মাঠে অপরাজিত, পিএসজি সহ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চার প্রতিপক্ষকে নিজেদের মাঠে গুণে গুণে দিয়েছে ১৪ গোল। ডাগআউটে রয়েছেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন কোচ জাপ হেইঙ্কেস যিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১৩ ম্যাচ টানা অপরাজিত। টালমাটাল বায়ার্নের হাল ধরে নিয়ে গেছেন তার নিজেরই অমর কীর্তি ট্রেবল জয়ের পুনরায় সম্ভাবনার দুয়ারে। বায়ার্নের বেঞ্চ এতটা শক্তিশালী যে, এটা অনুমান করা কঠিন যে, কারা মাঠে নামতে যাচ্ছেন। আলাবা, ভিদাল, কোম্যান ও নয়ের শংকায় আছে চোটের কারণে বাদ পড়ার।

হেইঙ্কেসের ছোঁয়ায় বায়ার্ন ছুটছে দারুণ গতিতে; Source: The18

সেভিয়া শেষ ষোলোতেও ঘরের মাঠে ড্র করে ম্যানইউর মাঠে তাদের হারিয়ে এসেছিল। এটা নিশ্চয়ই তাঁদের অনুপ্রেরণা দেবে। কিন্তু সবসময় হালের ‘মোটিভেশনাল স্পিচ’ এ কাজ হয় না। ঘরের মাঠে মোটামুটি অদম্য এক বায়ার্নের সাথে তারা খেলতে নামবে লিগের মাঠে সেল্টা ভিগোর কাছে ৪-০ গোলে হারার স্মৃতি নিয়ে। আবার বায়ার্ন গত তিনবারই নক আউট পর্বে বাদ পড়েছে তিন স্প্যানিশ দলের কাছে হেরে। এবার সামনে আরেক স্প্যানিশ দল সেভিয়া, বায়ার্নের থলিতে অ্যাওয়ে গোল দুটো থাকলেও গোল ব্যবধান মাত্র ১।

সম্ভাব্য লাইন আপ

বায়ার্ন মিউনিখ (৪-২-৩-১)

উলরেইখ;

কিমিচ, হামেলস, বোটেং, আলাবা;

থিয়াগো, জাভি মার্তিনেজ;

মুলার, জেমস, রিবেরি;

লেওয়ানডস্কি।

সেভিয়া (৪-২-৩-১)

সোরিয়া;

নাভাস, কারিকো, লেনগ্লেট, এস্কুদেরো;

এনজোজি, বানেগা;

ভাজকেজ, কোরেয়া, সানাবরিয়া;

বেন ইয়াদের।

তবে কি আবার বায়ার্ন স্প্যানিশ দেয়ালে ঠেকে বিদায় নেবে নাকি হেইঙ্কেসের দুর্দম্য গতিতে এগিয়ে চলার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে? দেখা যাবে বুধবার রাতে।

ফিচার ছবিসত্ত্ব: scoopress.ma

Related Articles

Exit mobile version