স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের আবহাওয়া কী দ্রুতই না বদলে গেল! গত বছর আন্তোনিও কন্তের চেলসি খেলতো রক্ষণাত্মক ফুটবল। যেখানে রক্ষণই দলের মূল নীতি। এমনকি মৌসুম শেষে দেখা যেত স্ট্রাইকার থেকে ফুল-ব্যাক বা মিডফিল্ডাররা বেশি গোল পাচ্ছে। কন্তের এ ট্যাকটিসে অনেক চেলসি সমর্থকই বিরক্ত হতেন। চাইতেন ভিন্ন ধরনের এক চেলসিকে। মাউরিজিও সারি নতুন কোচ এসে যেন এক তুড়িতে সবকিছু বদলে দিলেন। ধীর গতির খেলার ধরনকে বদলে চেলসি এখন দ্রুতগতির আক্রমণাত্মক ফুটবলে অভ্যস্ত হচ্ছে। অন্তত গত দুই প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ এমনটাই বলে। কিন্তু শুধু খেলার ধরন বদলে দিলেই তো শিরোপা জেতা সম্ভব নয়। আবার চেলসিতে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় নেই, যেমনটা সারি চান। তবুও প্রিমিয়ার লিগে প্রথম মৌসুম কেমন কাটতে পারে তার?
সারির ফুটবল দর্শন
বর্তমান সময়ে আক্রমণাত্মক ফুটবল মানেই পজিশনাল ফুটবল। পজিশন না হারিয়ে কিভাবে প্রতিপক্ষে প্রতি-আক্রমণ রুখে দেওয়া যায় তা নিয়েই সকল কোচ কাজ করছেন। আর এই পজিশনাল ফুটবলের নতুন ধারণা নিয়ে প্রিমিয়ার লিগে এসেছেন নাপোলির প্রাক্তন কোচ সারি।
সারির ট্যাকটিস মানেই গোল উৎসব। তবে এই গোলের উৎসবের সাথে মানিয়ে নিতে হলে কোনো তারকা ফুটবলারের দরকার নেই। শুধুমাত্র দলে থাকা খেলোয়াড়দের নিজেদের উপর বিশ্বাস ও কোচের দিকনির্দেশনাকে ঠিকমতে অনুসরণ করতে হবে। নাপোলিতে থাকতেও তাকে রক্ষণে মনোযোগ দিতে দেখা যায়নি। তাই চেলসিতে যে রক্ষণ নিয়ে কাজ করবেন, তা বলাটা খুব যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে সমস্যা একটাই, সারি তার নিজস্ব পদ্ধতির ফুটবল দর্শনই চেলসির জন্য প্রয়োগ করবে। কিন্তু রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে অভ্যস্ত চেলসির ফুটবলাররা তার আক্রমণাত্মক পজিশনভিত্তিক ফুটবলের সাথে আদৌ মানিয়ে নিতে পারবেন কি না; তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়।
মাঠে সারি সাধারণত ৪-৩-৩ ফর্মেশন ব্যবহার করেন। যেখানে মধ্যমাঠে কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার নেই। সবাই প্রথাগত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে পজিশনাল ফুটবলের ক্ষেত্রে দলের উইংগারদের তাদের নিজস্ব পজিশন বা বেশ ছড়িয়ে খেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু সারি এখানে কিছুটা ভিন্ন। তিনি তার উইংগারদের স্ট্রাইকারের কাছাকাছি নিয়ে আসেন, যাতে উইংগাররা মধ্যমাঠে নজর রাখতে পারেন এবং সেই ফাঁকে দলের ফুল-ব্যাকদের উইংগারের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আক্রমণে সহায়তা করতে পারে।
কিন্তু এখানেও তার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি দুই উইংয়ের ফাঁকা স্থান পূরণ করতে দুজন ফুল-ব্যাক পাঠান না। পাঠান একজনকে এবং অন্য ফুল-ব্যাক রক্ষণ পাহারা দিতে দুজন সেন্ট্রাল-ডিফেন্সের সাথে তিনজনের রক্ষণের লাইনআপ তৈরি করে। এবং বর্তমান চেলসি দলে ফুল-ব্যাকের আক্রমণের দায়িত্ব পালন করছেন মার্কাস আলোনসো। দুজন সেন্টারব্যাকের সাথে যোগ দিয়ে তিনজনের রক্ষণ তৈরি করছেন সিজার আজপিলিকুয়েতা। পজিশন হারানোর পর প্রতিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাক ঠেকাতে এ পদ্ধতি দারুণ কার্যকরী।
‘সারিবল’ বলে একটি ফুটবল ট্যাকটিসের কথা প্রচলন আছে। এ সিস্টেমের ফুটবল দ্রুতগতি ও পজিশন ফুটবলের কথা বলে, অনেকটা পেপ গার্দিওয়ালার টিকিটাকার মতো। তার টিকিটাকা ফুটবল সম্পর্কে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সার্জিও বুসকেটস এ ফুটবল ধারণায় বিশেষ একটি ভূমিকা পালন করেন। সারির ট্যাকটিসেও এমন একজন ফুটবলার আছেন, যাকে মধ্যমাঠের মধ্যমণি বলা হয়, তাকে কেন্দ্র করেই আক্রমণের সূচনা হয়। তিনি হলেন জর্জিনহো, যাকে নাপোলি থেকে উড়িয়ে এনেছে সারিই। জর্জিনহো যেমন আক্রমণে সহায়তা করেন, তেমনই দুজন সেন্ট্রাল-ব্যাক ডিফেন্ডারের মাঝে তৃতীয় সেন্ট্রাল-রূপে আবির্ভূত হন। তাই জর্জিনহো বর্তমান চেলসি দল ও সারির স্কোয়াডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
পজিশনাল ফুটবল খেলতে গেলে দলের প্রত্যেক সদস্যকে পাস দেওয়াতে দক্ষ থাকতে হবে। কারণ ছোট ছোট পাসেই মূলত আক্রমণের সূচনা হয়। এবং প্রয়োজনের ফলে অনেক সময় গোলরক্ষকের কাছে পাস দেওয়াটা জরুরি হয়ে পরে। তাই এ ধরনের ফুটবল ট্যাকটিসের সাথে এমন একজন গোলরক্ষক জরুরি যে তার গোলবার সামলানোর পাশাপাশি পায়েও দক্ষ। পাসিংয়ে দক্ষতা থাকা এ জাতীয় গোলরক্ষককে বলা হয় সুইপার গোলকিপার। আন্তোনিও কন্তের দলে গোলরক্ষককে পাসিংয়ে দক্ষ থাকার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু থিবো কর্তোয়া চেলসি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানোর ফলে সারির সামনে সুযোগ থাকে একজন সুইপার গোলরক্ষককে দলে টানার। সেজন্যই বিশ্বরেকর্ড গড়ে চেলসি কিনেছে কেপা আরিজাবালাগাকে। কেপা পাসিংয়ে ভালো, কিন্তু অনভিজ্ঞ। তবে কোচের প্রত্যাশা পূরণ করতে কেপার বেশি বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। ডাইভ, থ্রোয়িং সক্ষমতা ও পায়ে খেলার অভ্যাস থাকার কারণে কেপা দ্রুতই প্রিমিয়ার লিগ ও নতুন কোচের সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নেবেন।
মধ্যমাঠ ও রক্ষণ উন্নতিতে সারির ভূমিকা
মধ্যমাঠে সারি সাধারণত দুজন ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার ও একজন বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারকে ব্যবহার করেন। এখানে বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করবেন জর্জিনহো এবং কান্তেকে আরও অতিরিক্ত পজিশনে দেখা যাবে। ফলে এ মৌসুমে তার গোল বা অ্যাসিস্টের সংখ্যা বিগত মৌসুমগুলোর তুলনায় বেশি হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো রস বাকরেলিকে নিয়ে। তিনি রক্ষণের দিক থেকে দুর্বল। আক্রমণে গিয়ে সময়মতো তার পজিশনে ফেরত এসে রক্ষণ সামলাতেও তিনি সেভাবে দক্ষ না। তাই দলে দরকার ছিলো আরও একজন মিডফিল্ডার। কিন্তু স্থায়ীভাবে কেনার সময় না থাকার কারণে আপাতত এক মৌসুমের জন্য চেলসিতে ধারে এসেছেন মাতেও কোভাচিচ, যিনি আক্রমণ ও রক্ষণ উভয় পজিশনে সমানভাবে পারদর্শী। হয়তো এ মৌসুম পরে কোভাচিচ রিয়াল মাদ্রিদে ফেরত যাবেন। কিন্তু ততদিনে সারি অবশ্যই খুঁজে নেবের তার পছন্দসই মিডফিল্ডারকে।
একজন প্রথাগত ডিফেন্ডারের কাজ প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানো। তাই সেন্ট্রাল-ব্যাক ডিফেন্ডারেরা স্লাইড ট্যাকল, ম্যান মার্কিং, বল ক্লিয়ারেই বেশি বিশ্বাসী। কিন্তু সারির রক্ষণের সৈনিকদের বল পায়েও দক্ষ থাকতে হবে। তাই চেরিসটেনসেনের মতো ডিফেন্ডারকে উপেক্ষা করে তিনি ব্যবহার করছেন ডেভিড লুইজ আর রুদিগারকে। কারণ তারা প্রথাগত ডিফেন্ডারের দায়িত্বের পাশাপাশি বল পায়েও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
দলের দুর্বল অংশ
দলের যে অ্যাটাকিং লাইনআপ তা প্রতিপক্ষের জন্য যথেষ্ট ভয়াবহ। হ্যাজার্ড, মোরাতা, উইলিয়ানের পর পেদ্রোর মতো খেলোয়াড় থাকার পরেও ছন্দটা যেন এসেও আসতে চাইছে না। সারির ট্যাকটিসে উইং ছেড়ে উইংগারেরা মধ্যমাঠের সামান্য ভেতরে খেলবেন। হ্যাজার্ড সেটা ঠিকমতো করতে পারলেও অন্যপাশে উইলিয়ান সেটা আদৌ করতে পারবেন কি না সন্দেহ। আর একজন স্ট্রাইকারকে যে রূপে চেলসি কোচ চান, আলভারো মোরাতা তেমন নন। নিচে নেমে এসে আক্রমণে সহায়তা বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অঞ্চলে নেমে এসে ফুল-ব্যাকদের সাথে বোঝাপড়ার মতো বিষয়গুলোতে তিনি দক্ষ না। একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার হবার কারণে তার সীমাবদ্ধতা ডি-বক্সের ভেতর। গোল করতেই তার পারদর্শিতা। তাই এ পজিশনে ভুগতে হতে পারে চেলসিকে। কারণ সারির ট্যাকটিসে একজন অযোগ্য খেলোয়াড় সকল পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারে।
তবে মোরাতা যদি সত্যিই ব্যর্থ হন, তাহলে সারির ভিন্ন একটি কৌশল ভাবার অবকাশ আছে। তিনি মাঠে ৪-৩-৩ ফর্মেশন ব্যবহার করলেও খেলার ভাবগতি বুঝে ফর্মেশনে পরিবর্তন আনেন, এমনকি খেলোয়াড়ের পজিশনও অদল-বদল করেন। তাই পেদ্রো এবং উইলিয়ানকে উইংগার হিসেবে ব্যবহার করে হ্যাজার্ডকে ফলস নাইন হিসেবে খেলেতে পারেন, যেভাবে নাপোলিতে থাকার সময় মার্টেন্সকে ব্যবহার করতেন।
ব্যাংকার থেকে ফুটবল কোচ বনে যাওয়া মাউরিজিও সারির কৌশল অত্যন্ত জটিল এবং বুদ্ধিদীপ্ত। তার মতো একজন সুদক্ষ, চিন্তাশীল কোচ ডাগআউটে থাকা মানে নির্ভরতা। চেলসিকে তিনি বদলে দিতে পারবেন। তবে তার জন্য প্রয়োজন সময় এবং একটি সফল ট্রান্সফার উইন্ডো। এ মৌসুমে যদি চেলসির সাফল্য সেভাবে না আসে, তবে হতাশ হবেন না। কারণ আগামী মৌসুমই হতে পারে মাউরিজিও সারির।
ফিচার ইমেজ: Planetfootball